|
|
কালীঘাট মন্দিরের মামলাঃ ২৪ বৎসর পরে নিষ্পত্তি |
|
|
|
আদিগঙ্গার বুকে অনেক পলি জমেছে গত ২৪ বছর ধরে। কিন্তু কালীঘাট মন্দিরের মামলা মেটেনি, এই গত ১লা নভেম্বরের আগেও। ১৯৩৭ সালার মামলা। মেজ আদালত থেকে বড়, তারপরে আরও বড়, এমন করে নানা শাখা প্রশাখা মেলে সে মামলা এগিয়ে গিয়েছে দু দুটো যুগ ধরে। এই গত বুধবারে দেওয়া সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতির রায় ২৪ বৎসরের এই দীর্ঘ মামলাটির অবসান ঘটালো।
মূল মামলাটিতে অভিযাগ ছিল এই যে, কালীঘাট মন্দিরের বিগ্রহের সেবাপূজা ও সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে অব্যবস্থা চলে আসছে। তাই আবেদন ছিল, মহামান্য আদালত ও ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে উপযুক্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করান।
অভিযোগটি এনেছিলেন শ্রীজীবনধন মুখার্জী ও অপর চার ব্যক্তি। এনেছিলেন শ্রীশ্রী কালীমাতা ঠাকুরাণীর নামে। কালীঘাটের কালীমন্দিরের প্রায় ৩০০ সেবাইতের মধ্যে মুখার্জীরা অন্যতম হিস্যাদার।
মূল মামলা রুজু হয়েছিল জর্জকোর্টে। আপিলের সুড়ঙ্গ বয়ে তা হাজির হল হাইকোর্টে, প্রধান ধর্মাধিকরণে। তখন ১৯৫৭ সাল। জর্জকোর্ট বাদীর পক্ষে রায় দিয়ে আগেই একটি পরিকল্পনা রচনা করেছিলেন। হাইকোর্ট সেই পরিকল্পনাটিকে একটু বদলালেন। পরিবর্তিত পরিকল্পনাটি হল ঃ মন্দিরের বিগ্রহের সেবা পূজা ও সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের ভার থাকবে ১২ জন সেবাইত ও ৬ জন জমসাধারণের প্রতিনিধিদের হাতে। সেবাইতদের ৬জন প্রতিনিধিকে মনোনীত করবেন সেবাইতদের সঙ্ঘ। আর জনসাধারণের প্রতিনিধিদের মধ্যে জেলা জজ মনোনীত করবেন দুজনকে। কলকাতা পৌরসভা পাঠাবেন এরজনকে, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ ও ভারত বণিক সভা প্রত্যেকে একজন করে পাঠাবেন দুজনকে। আর সংস্কৃত শিক্ষা পরিষদ, সংস্কৃত কলেজ ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তিনজনে মিলে পাঠাবেন একজনকে। এঁদের সবাইকে নিয়ে গঠিত হবে টেম্পল কমিটি। কমিটির প্রেসিডেন্টকে মনোনীত করবেন জেলা জজ নিজে। মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের ও মন্দির পরিচালনার যাবতীয় দায়িত্ব বর্তাবে এই কমিটির ওপর। আর মন্দিরের যা আয় হবে, তার শতকরা ৫০ ভাগ পাবেন সেবাইতেরা। বাকী ৫০ ভাগ যাবে টেম্পল কমিটির কাছে।
কিন্তু হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে অভিযোগ করলেন শ্রীশ্রী কালীমাতা ঠাকুরাণীর পক্ষে শ্রী জীবনধন মুখার্জী। তাঁর মূল অভিযোগ ছিল চারটি। তার মধ্যে একটি হল, মন্দির কমিটিতে সেবাইতদের গ্রহণ করা অবৈধ। কারণ দেবোত্তর সম্পত্তির পরিচালনা কমিটিতে সেবাইতদের গ্রহণ করা বিধিবহির্ভূত। আর একটি হল, সেবাইতদের বেতনের ব্যবস্থা (মন্দিরের আয় বাবদ শতকরা ৫০ ভাগ) অত্যন্ত অসঙ্গত। সেই সঙ্গে আরও আবেদন ছিল, আদালতের আয় যতদিন না বের হয়, ততদিন মন্দিরের জন্য একজন অ্যাডমিনিস্ট্রেটর নিয়োগ করা হোক।
মন্দির কমিটিতে সেবাইতদের সংখ্যা ১২ জন আর জনসাধারণের প্রতিনিধির সংখ্যা মাত্র ৬জন। এই ব্যবস্থাকে অসম ব্যবস্থা বলে অভিযোগ করেছিলেন অভিযোগকারিণী।
“আমি মেনে নিচ্ছি যে, মন্দিরের ম্যানেজিং কমিটিতে সেবাইতদের সংখ্যা অধিক।” শেষের অভিযোগটি স্বীকার করে নিয়ে রায় দিয়েছেন শ্রী জে আর মুধোলকর। সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি। তিনি রায় দিলেন ১৮ জন নয়, মন্দির কমিটির সদস্য সংখ্যা কমিয়ে ১১ জন করা হবে। কমিটির মধ্যে সংখ্যাধিক্য থাকবে জনসাধারণের প্রতিনিধির। তাঁদের সংখ্যা হবে ৬ জন, আর সেবাইতদের ৫ জন। জনসাধারণের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করবেন, ভারত চেম্বার্স অফ কমার্স, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ, কলকাতা পৌরসভা ও বঙ্গীয় সংস্কৃত শিক্ষা পরিষদ ও সংস্কৃত কলেজের প্রতিনিধিরা মিলে একজন। কমিটির সভাপতিকে মনোনীত করবেন ২৪ পরগণার জেলা জজ।
অন্যান্য অভিযোগগুলি বিচারপতি নাকচ করে গেল।
১৯৫৭ সাল থেকেই কাজ করে যাচ্ছে মন্দির কমিটি। মন্দিরের মধ্যেই তাঁদের অফিস। কমিটির হিসাবপত্র রাখবার জন্য আছেন একজন হিসাবরক্ষক।
কালীঘাট কালীমন্দিরের হিস্যাদার অনেক। প্রতিদিন পালা পড়ে তাঁদের। কোন তিথিতে মন্দিরের কত আয় হতে পারে, তা আগে থেকেই পরিমাপ করে দেন মন্দির কমিটি। সেই তারিখে যার পালা, তিনি আগে থেকেই সেই দিনের আয়ের অর্ধেক টাকা কমিটির কাছে জমা দেন। আর দেব-দেবীর ভোগ বাবদ দৈনিক ৯৫ টাকা করে কমিটির তহবিল থেকে দেওয়া হয় সেবাইতের হাতে।
এতো গেল শুধু প্রণামীর আয়। অন্যান্য আয়ের বেলা আলাদা ব্যবস্থা। ভক্তরা দেবীকে যে কাপড় চোপড় দেন, কুড়ি টাকার বেশী হলেই তা পাবেন মন্দির কমিটি। সোনার অলঙ্কার সবই মন্দির কমিটির। তবে রূপোর বেলা ১০ ভরি পর্যন্ত পাবেন সেবাইত। পুজোর জন্য মণিঅর্ডার, পার্শেল, ইনসিওর ইত্যাদি এলেই তার শতকরা ৫০ বাগ পাবেন কমিটি, বাকীটা সেবাইত। কোন ভক্ত যদি দান পাঠান এবং তাতে যদি মন্দির সংস্কারের জন্য বা ‘বাঙালী ভোজের’ জন্য লেখা থাকে, তবে সেই অর্থ ব্যায়ের দায়িত্ব বহন করবেন মন্দির কমিটি।
প্রকাশ, সুপ্রীম কোর্টের রায় অনুযায়ী মন্দির কমিটি আবার পুনর্গঠিত হবে, কিন্তু দায়িত্বের পরিবর্তন নাকি হবে না।
|
|
|