|
|
৪ কার্তিক ১৪১৮ সোমবার ২১ নভেম্বর ২০১১
|
|
|
|
|
|
দেবালয় |
জয় মিত্র কালীবাড়ি |
এক সময়ে দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদারকুল বা সম্পন্ন ব্যবসায়ীরা কলকাতা ও সন্নিহিত এলাকায় গঙ্গার তীর বরাবার নির্মাণ করেছিলেন বহু সংখ্যক মন্দির-মসজিদ জাতীয় দেবাঙ্গন। অবহেলা, ঔদাসীন্য আর অর্থাভাবে সে সব দেবালয়ের কিছু কিছু ধ্বংসপ্রাপ্ত, বাকিগুলির অধিকাংশই হয় পরিত্যক্ত কিংবা জীর্ণ, কোনওটা আবার টিকে আছে নিজের মতো করে। বরানগর-মালপাড়ার কুঠিঘাট অঞ্চলের (বর্তমান ঠিকানা, ৩৯ হরকুমার ঠাকুর রোড) কৃপাময়ী কালীবাড়ি তেমনই এক কোনও রকমে টিকে থাকা মন্দির-চত্বর।
শোভাবাজার অঞ্চলের বাসিন্দা জয়নারায়ণ মিত্র, কৃপাময়ী কালীর বিগ্রহ-যুক্ত একটি নবরত্ন মন্দির ও বারোটি আটচালা শিবমন্দির নিয়ে এই মন্দির চত্বরটি নির্মাণ করেন ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে। দক্ষিণেশ্বরে রানি রাসমণির ভবতারিণী কালীমন্দির প্রতিষ্ঠারও পাঁচ বছর আগে। প্রতিষ্ঠাতার নাম অনুসারে এই কৃপাময়ী কালীর মন্দিরটি ‘জয় মিত্রের মন্দির’ নামেই পরিচিত। অঞ্চলের প্রবীণদের কাছ থেকে জানা যায়, প্রাচীন এই মন্দিরে আগে বিভিন্ন পুজোয় খুব সমারোহ হত। এখনও বারোমাস নিত্যপুজো এবং কালীপুজো হলেও আগের সে রমরমা আর নেই।
কলকাতা-সন্নিহিত এই অঞ্চলের তিনটি বিখ্যাত কালী মন্দিরের অন্যতম এই কৃপাময়ী কালীর মন্দির ‘জয় মিত্র কালীবাড়ি’ (প্রতিষ্ঠা: চৈত্র সংক্রান্তি ১২৫৭ বঙ্গাব্দ, ইংরেজি এপ্রিল ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দ)। অন্য দু’টি হল— ব্রহ্মময়ী কালীর মন্দির ‘প্রামাণিক কালীবাড়ি’ (প্রতিষ্ঠা: ১২৫৯ বঙ্গাব্দ, ইংরেজি ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দ) এবং ভবতারিণী কালীর মন্দির ‘দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি’(প্রতিষ্ঠা: ১২৬২ বঙ্গাব্দ, ইংরেজি ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দ)। কথিত আছে, শ্রীরামকৃষ্ণ ভবতারিণী কালীকে ‘মা’ বলে ডাকতেন এবং অন্য দুই কালীবাড়ির কৃপাময়ী কালী ও ব্রহ্মময়ী কালীকে ‘মাসি’ বলে ডাকতেন। শেষোক্ত মন্দির দু’টি গঠন-বৈশিষ্ট্যে নবরত্ন হলেও প্রথাগত নবরত্ন মন্দিরের থেকে কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির। এখানে চিরাচরিত বাঁকানো চালের শৈলী লঙ্ঘন করে দোতলা দালান-মন্দিরের কোণে কোণে পীঢ়ারীতির চূড়া বা রত্ন বসানো হয়েছে।
মূল কোনও কালী মন্দিরের সঙ্গে চার-ছয়-আট-বারো বা তারও বেশি আটচালা শিবমন্দির যুক্ত যে সমস্ত ‘টেম্পল কমপ্লেক্স’ সমগ্র দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে দেখা যায়, এটিও তার ব্যাতিক্রম নয়। কৃপাময়ী কালীর মূল ‘নবরত্ন’ মন্দিরটির অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভাল। মন্দিরগাত্রে রঙের প্রলেপ রয়েছে বটে, কিন্তু ত্রি-খিলান যুক্ত প্রবেশপথে ‘কলাগেচ্ছ্যা’ রীতির স্তম্ভগুলির গায়ে অপটু সংস্কারের ছাপ। দোতলা ছাদের প্রতি কোণে থাকা ছোট ছোট রত্নমন্দিরগুলির অবস্থাও ওই রকমই। মন্দিরের ঠিক সামনে একটি বড় নাটমন্দির ছিল কিন্তু তার ছাদ ভেঙে পড়েছে বহুকাল আগে। এখন রয়েছে শুধু গোলাকার থামগুলি। নবরত্ন মন্দিরের পাশে প্রতি সারিতে ছ’টি করে, মুখোমুখি দু’ সারি, মোট বারোটি আটচালা শিবমন্দির রয়েছে। প্রতিটি মন্দিরের গর্ভগৃহে রক্ষিত শিবলিঙ্গগুলি ‘অমরনাথ’, ‘বৈদ্যনাথ’, ‘পশুপতিনাথ’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘ভুবনেশ্বর’ প্রভৃতি বিভিন্ন নামে চিহ্নিত। সাম্প্রতিক সংস্কারের ফলে মন্দিরগুলির অবস্থা তুলনামূলক ভাল।
প্রতিষ্ঠাতা জয়নারায়ণ মিত্রের উত্তরসূরীদের অধিকাংশই থাকেন অন্য জায়গায়। ব্যতিক্রম অপর্ণা মিত্র। তিনি থাকেন এই মন্দিরের পাশের একটি বাড়িতে। অশীতিপর এই বৃদ্ধা তাঁর শ্বশুরকুলের এই মন্দিরের কথায় খুবই উচ্ছ্বসিত। অতীত দিনে কালীপুজো ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কেমন সমারোহ হত, তার বর্ণনা দিতে দিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তাঁর মুখ। শিব মন্দিরগুলির দুরাবস্থা আর মন্দির-চত্বরের অপরিচ্ছন্নতা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘‘কর্তাদের আমলে যথেষ্ঠ লোকবল তো ছিলই রোজগারপাতিও ভাল ছিল তাই মন্দিরের দেখাশোনা হত ভাল ভাবেই। কিন্তু এখন যত দিন যাচ্ছে মানুষের সময়ও কমে যাচ্ছে। আমাদের পরিবারের এখনকার প্রজন্মের ছেলেরা তাই নিয়মিত এখানে এসে দেখাশোনা করতে পারে না। আর টাকার অভাব তো আছেই। সরকারের কাছে কোনও দিনও এর জন্য টাকা আমরা চাইনি, রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যা করবার পরিবারের লোকেরা নিজেরাই তা করে নিয়েছেন। তবুও এতগুলো মন্দির নিয়ম করে সারিয়ে রাখতে গেলে অনেক টাকার দরকার। দেবোত্তর আয়ের সামান্য টাকা আর কিছু দান-প্রণামী থেকে যা আসে তাই দিয়ে যতটা করা যায় তাই আমাদের ছেলেরা করে।’’
|
তথ্য ও ছবি: গৌতম বসুমল্লিক
|
|
|
|