|
|
৪ কার্তিক ১৪১৮ সোমবার ২১ নভেম্বর ২০১১
|
|
|
|
|
|
|
ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে, আলো ফুটছে, প্রাণ জাগছে... |
একটা সময় ছিল, যখন বলা হত, বাঙলা আজ যা ভাবে
সারা ভারত আগামীকাল তাই ভাবে! সে দিন গিয়েছে।
সভ্যতার সেই ইতিহাসে যে সমস্ত কৃতীর অবদান অনস্বীকার্য,
এই সংখ্যায় তাঁদের অন্যতম সলিল চৌধুরীর জীবনগাথা।
|
|
|
‘ভাল শিল্পী হতে হলে ভাল রাঁধিয়ে ও ভাল মনের মানুষ হতে হবে। রান্না হওয়া চাই আর্টিস্টিক। দেখ না আমি যে দিন কষা মাংস রাঁধি বাচ্চারা সে দিন কত ভাত খায়!’ কথাগুলি সলিল চৌধুরীর। সব্জির সঙ্গে সঠিক উপকরণ না দিলে যেমন রান্না সুস্বাদু হয় না, তেমনই সুরের জাদুকর সলিল চৌধুরী জানতেন কথা ও সুরের গভীর রসায়ন। তাঁর সেই সব কালজয়ী গান আজও মানুষের মনে চির সবুজ।
জন্ম দক্ষিণ ২৪ পরগনার গাজীপুরে মামার বাড়িতে ১৯২৫ সালের ১৯ নভেম্বর। বাবা চিকিৎসক জ্ঞানেন্দ্রনাথ চৌধুরী, মা বিভাবতী দেবী।
সারা জীবনে পেয়েছেন বহু পুরস্কার। ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড (১৯৫৭), বিএফজেএ অ্যাওয়ার্ড (১৯৭২), নিজের পরিচালনায় ‘পিঞ্জরে কে পঞ্ছী’র জন্য উত্তরপ্রদেশ জার্নালিস্ট অ্যাওয়ার্ড (১৯৮৫), আলাউদ্দিন স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৫), সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড (১৯৮৮), ক্রিয়েটিভ মিউজিকের জন্য মহারাষ্ট্র গৌরব পুরস্কার (১৯৯০) উল্লেখযোগ্য।
তাঁর গান বাংলা ছাড়াও মালয়ালম, তামিল, তেলেগু, কন্নড়, গুজরাতি, মরাঠি, ওড়িয়া, অসমিয়া ও পঞ্জাবি ভাষায় পরিবেশিত হয়েছিল।
স্ত্রী সবিতা চৌধুরীর কথায়: ওঁর জন্মদিনে বাড়িতে বহু মানুষ আসতেন। সবাইকে হয়তো চিনতামও না। আমি চটি গুনে হাঁড়িতে চায়ের জল বসাতাম। সকাল থেকে পায়েসের খোঁজ করতেন। পায়েস খেতে খুব ভালবাসতেন। অত্যন্ত প্রিয় ছিল ছাতু-মুড়ি। সারা মুখে ছাতু মেখে যখন খেতেন সেটি ছিল দেখার মতো।
সলিলের ৬০তম জন্মদিনটি খুব উল্লেখযোগ্য। আমাদের ‘আকাশদীপ’ ফ্ল্যাটে দ্বিজেনদা, বনশ্রী, ক্যালকাটা কয়্যারের ছেলেমেয়েরা, আমাদের দলের ছেলেমেয়েরা, আমার দুই ছেলে সুকান্ত ও সঞ্জয় এবং দুই মেয়ে অন্তরা ও সঞ্চারীকে নিয়ে সে দিনের পরিবেশ ছিল গমগমে। আর ছিল অভিজিতের ছেলে অমিত। হঠাৎ অমিতকে ডেকে সলিল চুপি চুপি বললেন, ‘একটা বাল্ব কিনে নিয়ে আয়, খুব দরকার।’ সেটিকে একটি ল্যাম্পস্ট্যান্ডে আটকে দিলেন। জন্মদিনের অনুষ্ঠান শুরু। সলিল বললেন, ‘সব আলো নিভিয়ে দাও। শুধু ওই বাল্ব জ্বলবে।’ কেক কাটা হল। ব্যাপারটা সকলের বুঝে ওঠার আগে বললেন, ‘দেখ আমার জন্মদিন পালন হচ্ছে। বলতো কত ওয়াটের বাল্ব জ্বলছে?’ বনশ্রী সে দিন ওঁকে কেক খাইয়েছিল।
ওঁর জন্মদিনে উপস্থিত থাকত দেবজ্যোতি, লাল্টু (গিটার), বাপি (গিটার), তাপস (অ্যাকোর্ডিয়ান)। আসলে সলিল চৌধুরীর মিউজিকের দল থাকলেই সেখানে সৃষ্টি হত স্বর্গ। আসতেন অরুণ ভাদুড়ি। চলত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুষ্ঠান।
আমি প্রবাসী বাঙালি। ছোটবেলা থেকেই কলকাতা আমার কাছে একবারে নতুন এক শহর। মাঝে মাঝে মা-বাবা ও ভাইদের সঙ্গে মামাবাড়ি কোন্নগরে যেতাম। কখনও কখনও কলকাতার চাংওয়াতে লাঞ্চ অথবা ডিনার করতাম। কিন্তু আমার স্বামী সলিল চৌধুরীর চোখ দিয়ে আমি দেখলাম এক সঙ্গীতের শহরকে। আর সে শহরের নাম কলকাতা।
১৯৫২তে নিজের গল্প ‘দো বিঘা জমিন’ নিয়ে বিমল রায়ের ডাকে গেলেন মুম্বই। এরই বাংলা ছবি ‘রিক্সাওয়ালা’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৫তে। পরের বছর ‘জাগতে রহো’র পাশাপাশি বিমল রায়ের ছবি ‘মধুমতি’ ওঁর জীবনে একটা ‘টার্নিং পয়েন্ট’।
থাকতাম মুম্বইতে। এক দিন অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে সলিল চৌধুরীর কথাতেই (১৯৫৮) ফোন এল আমার কাছে। রম্যগীতি গাইতে হবে। গাইলাম ‘হলুদ গাঁদার ফুল’ গানটি। সে দিন থেকে আমার নামের আগে ‘শিল্পী’ শব্দটি যুক্ত হল। ‘হলুদ গাঁদার ফুল’ গানটির কথা ও সুর সলিল চৌধুরীর। সেই প্রথম ওঁর গান বাংলায় রেকর্ডিং করলাম। কথা, সুর, ছন্দ নিয়ে নিরন্তর গবেষণা ছিল ওঁর রক্তে। সুরের ব্যাপারে বলি, ‘মধুমতি’ সিনেমার ‘ঘড়ি ঘড়ি মোরা দিল ধড়কে’ গানটির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দিয়ে বাঁধলেন ‘হলুদ গাঁদার ফুল’ গানটিকে। এই সিনেমায় ১১টি গানের সুর দিয়েছিলেন। ১৯৫৭-তে গানের জন্য লতাজি ও সুরের জন্য সলিল প্রথম ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পান।
১৭ বছর বয়স, ছাত্রজীবনের এক পরম অধ্যায়। বঙ্গবাসী কলেজ থেকে সলিল চৌধুরীর কৃষক আন্দোলন শুরু। তেভাগা আন্দোলনের জন্য সুরে কথায় প্রথম গান ‘হেই সামালো ধান হো’ উদ্বেলিত করে তুলল আন্দোলনকারী-সহ আপামর জনসাধারণকে। মানুষের মনে শিহরণ জাগানো ‘আর যুদ্ধ নয়, আর রক্ত নয়’, ‘ও আলোর পথ যাত্রী’, ‘প্রান্তরের গান আমার’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘রানার’, ‘ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা’, ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূ’, ‘একটি মোরগের কাহিনি’ এমন কত শত গান মানুষকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলল। যা আজও শুনলে বা গাইলে মন উজ্জীবিত হয়। আরও একটি উল্লেখযোগ্য গান ‘এই রোকো, পৃথিবীর গাড়িটা থামাও’। আধুনিক বাংলা ও হিন্দি গান ছাড়াও বহু সিনেমা এবং লোকসুরের গান মানুষের জীবনকে আরও গতিময় করে তুলেছে।
তিনিই তো সেই মানুষ যিনি একধারে সুরকার, গীতিকার, গায়ক ও কবি যিনি আমাদের জীবনে গানের পথ দেখিয়ে গিয়েছেন। সোনারপুরের কোদালিয়া গ্রামে দিদিমার সঙ্গে থাকতেই কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন আরও নিবিড় ভাবে। সভা চলাকালীন যে সব জাগরণের গান বেঁধেছেন, সুর করেছেন তার উদাহরণ উজ্জ্বল। ১৯৪৬-এর ২৯ জুলাই শহিদ মিনারের নীচে কয়েক লক্ষ মানুষের সামনে বাবার দেওয়া হারমোনিয়ামে সে দিন যে সব গান গেয়েছিলেন তাতে মানুষ কাঁধে করে কসবার বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলেন সলিল চৌধুরীকে।
কন্যা অন্তরা চৌধুরীর কথায়: আমার প্রার্থনা এই রকম বাবা-মা যেন জন্ম-জন্মান্তর ধরে পাই। ছোটবেলার কথা খুব মনে পড়ে। আমি কোনও গান করলেই আমাকে কোলে তুলে নিতেন বাবা। সেটাই ছিল আমার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। যখন আমাকে বলতেন, ছোট আম্মা কে? আমি ছুট্টে চলে আসতাম বাবার কাছে। পরে যখন আমার বোন সঞ্চারীর জন্ম হল তখনও বাবা বলতেন ওই কথাগুলো। বোন আর আমি দু’জনেই দৌড়ে আসতাম। আর বোনের সঙ্গে আমার ঝগড়া লেগে যেত।
বাবা বলতেন, সাধনা করে যাও। মানুষ এক দিন ঠিক বুঝতে পারবে। কিন্তু এখন যা সব দেখি তা যেন মেলাতে পারি না। তবুও মনের শান্তি, বাবা-মায়ের আদর্শ মেনে চলেছি।
বাবাকে তো ভোলা যায় না। তবুও এই নভেম্বর মাস বাবার জন্ম মাস। অনেক স্মৃতি, অনেক ফোন, অনেক মানুষের শুভেচ্ছা...। সলিল চৌধুরী ফাউন্ডেশন অফ মিউজিক-এর পক্ষ থেকে ‘সলিল রচনা সংকলন’-এর কাজ চলছে। থাকছে সারা জীবনে বাংলায় সুর করা যাবতীয় গান। সিনেমা, আধুনিক, অপ্রকাশিত বাংলা গান-সহ নানা জায়গা থেকে আমরা যা সংগ্রহ করতে পেরেছি সবই রাখার চেষ্টা করছি তাতে। সঙ্গে থাকছে সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতায় সুর দেওয়া সেই সব গান, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘অগ্নি কোণের তল্লাট’, অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা আমার ছোটবেলার গান ‘তেলের শিশি ভাঙলো বলে’ ছাড়া বহু কবিতাও থাকছে যেখানে বাবার কাজ কোনও না কোনও ভাবে জড়িয়ে আছে।
কল্যাণ সেনবরাট-এর কথায়: সলিল চৌধুরীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক গুরু-শিষ্যের। যখন কয়্যার শুরু করি তখন তিনি অভিভাবক হিসেবে পথ দেখিয়েছেন। আমাদের প্রথম ক্যাসেট ‘ঝঙ্কার’ ওঁর নিজের কোম্পানি সিএমআর (সেন্টার ফর মিউজিক রিচার্স) থেকে প্রকাশিত হয়। নিজেই উদ্যোক্তা ছিলেন। ৪টি গান ছিল ওঁর সুরে ও কথায়। কয়্যারের অনুষ্ঠানে সমবেত গানের জন্য সব সময় ডাকতেন। মহড়া চলত একটানা। হাতে কলমে শিখিয়েছেন সঙ্গীত পরিবেশন করা থেকে সঙ্গীত পরিচালনার যাবতীয় খুঁটিনাটি। একটি স্মৃতি আজ বড় মনে পড়ছে তাঁর এই জন্ম মাসে।
এক রবিবারে মন্টুদার (ঘোষ) সঙ্গে গিয়েছিলাম সলিল চৌধুরীর আকাশদীপ ফ্ল্যাটে। সেখানে গানবাজনা নিয়েই কথাবার্তা চলল। তারই মধ্যে মনে হয় তিনি বুঝে গিয়েছিলেন আমাদের দলের যা কিছু, সব গান দিয়ে ঘেরা। হঠাৎই পরের দিন বিকেলে নিজে গাড়ি চালিয়ে চলে এলেন আমাদের শিয়ালদহের বৈঠকখানার বাড়িতে। দলের ছেলেমেয়েরা হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ‘জন ব্রাউন’, ‘জন হেনরি’, ‘শঙ্খ চিল’ শোনাল। গান শুনে তিনি উচ্ছ্বসিত। কয়েকটি সলিলদারও গান শোনানো হল। ব্যস আর কথা নয়। গান চলল বিকেল পাঁচটা থেকে রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত। সলিলদা তখন মধ্য গগনে, আর আমি নিতান্তই সাধারণ এক মানুষ। যত দিন বেঁচেছিলেন তত দিনই অভিভাবকের মতো আমাদের পরামর্শ দিয়ে গিয়েছেন।
|
তথ্য: পাপিয়া মিত্র
নিজস্ব চিত্র। |
|
|
|