|
|
৪ কার্তিক ১৪১৮ সোমবার ২১ নভেম্বর ২০১১
|
|
|
|
|
|
|
যাদু লুকিয়ে আছে তার নামে |
ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য |
ল্যাবরেটরির দেওয়াল ঘড়িতে ঠিক ছ’টা বাজে। মনে মনে ভাবলাম তাড়াতাড়ি হাত চালিয়ে ‘স্যাম্পল’গুলো ‘রেডি’ করে ‘পিসিআর’টা সারারাত চালিয়ে দিতে পারলেই, নিশ্চিন্ত হয়ে আজকের মতো কেটে পড়া যাবে। সেই সকাল থেকে শুরু হয়েছে! বৃহস্পতিবার এমনিতেই ভীষণ চাপ থাকে। তার উপর ‘ল্যাব-মিটিঙে’ কি এক অজানা অদেখা ‘ডেটা’র জন্য বসের ঘ্যানঘ্যান, তার পরেই দৌড়তে হল সেমিনারে, মাঝখানে কোনও মতে দুপুরের খাওয়া সেরে ‘এক্সপেরিমেন্ট’ শুরু করেছি। কখন যে শেষ হবে! এক কাপ কফি খাওয়ারও ফুরসত ছিল না। নিজেকে সহস্রতম বারের জন্য কষে গালি দিলাম— ‘‘করো আরও ‘রিসার্চ’!’’ হুহু বাবা, মাথার চুল পেকে যাবে! বন্ধুবান্ধবের বিয়ে তো ভাল, তাদের ছেলেমেয়েদেরও বিয়ে-শাদি দেখতে হতে পারে ওই ‘থিসিস’ বস্তুটি ‘সাবমিট’ করার আগে।
বেরোনোর আগে বাইরের তাপমাত্রা জেনে নেওয়াটা এ দেশের দস্তুর, বিশেষ করে শীতকালে। কেটে পড়ব ভাবলেই কি শান্তি আছে? এখন মরো বরফ ভেঙে এই ৩ কিলোমিটার রাস্তা। তার পর হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি পৌঁছে করতে হবে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ! এখানে তো মাথা খুঁড়লেও একটা তুলসীপিসি বা কমলামাসি মিলবে না যে বলব, ‘‘আজ প্লিজ একটু বাসনটা মেজে দিয়ে যাও।’’ কেন যে মরতে কলকাতা ছেড়েছিলাম!
কলকাতা— শব্দটার ভেতরেই কী যেন এক যাদু! মুহূর্তে মনে হতে লাগল চারপাশটা কী রকম বদলে যাচ্ছে, ‘-৪০’ এর হাড় কাঁপানো ঠান্ডাটাও খুব একটা গায়ে লাগছে না আর, নরম পেঁজা তুলোর মতো গরম ওমে ভরে উঠছে সারা শরীর। আমার শহর এক নাম না জানা অতল মোহজালে জড়িয়ে ফেলছে আমায়, আবার, আবারও।
জন্ম থেকে সতেরো বছর বয়স অবধি আমার প্রথম সবকিছুর সাক্ষী এই শহর। খুব ছোট যখন, বাবাকে অফিসের কাজে প্রায় সারা ক্ষণই দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরে ঘুরে বেড়াতে হত। খুব মন খারাপ হত একা একা। মাথার উপর দিয়ে যে কোনও বিমান গেলেই মনে হত ওটাতে বাবা আছে, আর অভিমান হত কলকাতার আকাশটার উপর। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আকাশটার রং-ও পাল্টাতে থাকল। তখন রাস্তার মোড়ে মোড়ে এত শপিং মল ছিল না। আমার স্কুল ছুটি আর ঠিক তার পরের টিউশনের মধ্যের সময়টার জায়গা ছিল মেট্রো, রবীন্দ্রসদন-নন্দন চত্বর। ঊর্ধ্বশ্বাস ছুটের মাঝে এক ঝলক ঝোড়ো আড্ডাতে যে কী মুক্তি ছিল, সে এক আমিই জানি! আর জানে তারা, যাদের সঙ্গে হাহা হিহি চলত! শুধুই আড্ডা? না কি আরও কিছুর টানে ওরকম নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসত? বন্ধুদের সঙ্গে বকে চলেছি অবিরাম, মুখ চলছে ফুচকা ভেলপুরির সঙ্গে। আর চোখ দু’টো? তারাও তাদের কাজ করে চলেছে। সুযোগ পেলেই টুকুস করে দেখে নেওয়া, এখনও আসেনি কেন রে বাবা? আজ ওর ম্যাথস টিউশন থাকে না? ঝাড়ি মারতে শিখেছিলাম বটে তখন! পিএইচডি-টা কেন যে ওতেই করলাম না!
আমাদের বাড়িটা একেবারে বই-পাগল বাড়ি। দাদু আর বাবার নেশাটা চমৎকার শুষে নিয়েছি আমরা দু’বোনে। সারা বছর টাকা জমাতাম আর তার সবটুকুই ডানা মেলত বইমেলাতে। আমি আবার নতুন বইগুলো মাথার কাছে নিয়ে শুতাম গন্ধটাও মিস করব না বলে। কলকাতা বইমেলার যে কি টান, সে বোঝানো আমার কম্ম নয়! ‘কলকাতা কানেকশন’-এর ‘পাল্স’টাই আলাদা, কী রকম একটা ‘ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল’ ‘এফেক্ট’ নিয়ে আসে।
এক বার একটা মারাত্মক ভুল করেছিলাম। শহর ছেড়েছি সবে। এক বন্ধুকে খুব দরদ দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম কলকাতাতে দুর্গাপুজো ব্যাপারটা ঠিক কী, খায় না মাথায় দেয়! অনেক বারের বিফল চেষ্টার পর ‘দুঃখী-আত্মা’ হয়ে মনে মনে ভয়ংকর প্রতিজ্ঞা করেছি, আর না! কলকাতা থাকুক আমার বুকের ভেতর কোটরবন্দি, জনসমক্ষে আর আনছি না। কিন্তু কী যে ‘ম্যাজিক’ আছে ওই নামে, গলার কাছটা সময়ে অসময়ে এমন ব্যথা করে ওঠে! ধুত্, যত্তসব ভুলভাল! আমার মতো একজন কাঠখোট্টা বিজ্ঞানসাধিকার ও-সব আবেগ সাজে নাকি!
বলছি তো খুব বড় মুখ করে কিন্তু পারছি কোথায়? তাই কোনও কনফারেন্সে কেউ যদি বলে, ‘ওহ্, ইউ আর ফ্রম ক্যালকাটা? ওয়েন্ট দেয়ার ওয়ান্স, ভেরি লাইভলি সিটি।’— শুনে ‘সিলিন্ড্রিকাল ভিশন’টা অল্প ঝাপসা হয়ে আসে। সেই জন্যই বোধহয় সেপ্টেম্বর পড়তেই (এখানে যাকে বলে ‘ফল’-এর শুরু) ক’জন বন্ধু মিলে বেরিয়ে পড়ি যদি আরও কিছু ‘স্পনসরশিপ’ জোগাড় করা যায়— মা আসছেন তো! কেউ ইংরেজি না বুঝলে একটুও না দমে ভাঙাভাঙা ফরাসিতেই আঁকতে থাকি আমার শহরের উৎসবের চালচিত্র। আর আয়নায় নিজেকে না দেখেও পরিষ্কার বুঝতে পারি আমার মুখের আলোতেই ‘সিটি অফ জয়’কে ছুঁতে পারছে উল্টো দিকের মানুষটা। আর ফোনে বাবা-মাকে বারবার মনে করিয়ে দিই— ‘বাগবাজারে যে দিন যাবে মাকে বলতে ভুলো না কিন্তু আমার কথা। বোলো এ বারটা আর হল না, কিন্তু পরের বার, সেটা না হলে তারও পরের বার নিশ্চয়ই আসব।’
অবচেতনে কিসের তাড়ায় ফেসবুকে ‘স্প্রিং ব্রক’-এর ছবি ‘আপলোড’ করে ‘ক্যাপশন’ লিখি ‘ম্যাডলি বেঙ্গলি’, বলতে পারব না। আর কেনই বা তন্নতন্ন করে খুঁজতে থাকি সাম্প্রতিক বাংলা ছবি ‘ইতি মৃণালিনী’ অনলাইন পাওয়া যাচ্ছে কিনা? একেই কি বলে শেকড়ের টান— যা ডলার, পাউন্ড, ইউরোর হাজার প্রলোভনের ভেতরেও মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে পারে? দেশ-ছাড়া হয়েও যখন অকৃত্রিম আনন্দে চোখ ঝিকমিক করে ওঠে ‘কলকাতার বাঙালি’ আবিষ্কার করতে পারলে, বুঝতে পারি কোথাও যাইনি আমি, আজও সেখানেই আছি। বুকের শিরায় শিরায় জড়িয়ে থাকা এ এক এমন মায়া যা একটা করে দিন যায় আর বাড়তে থাকে। যদি হাতে কখনও একটু ফাঁকা সময় পড়ে থাকে, আনমনে জানলার বাইরে চেয়ে থাকি। কোনও এক অমোঘ নিয়মে সামনে এসে দাঁড়ায় সাড়ে বারো হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দূরে চলে যাওয়া শহরটা। মনে করিয়ে দেয় কী পেয়েছি, কী হারিয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে কানে কানে জিজ্ঞেস করতে থাকে, ‘কী ভাবছ? উত্তরটা পেলে?’ আর ঠিক তখনি প্রশ্নটাকে থমকে দিয়ে ‘ইউটিউবে’ বেজে ওঠে সেই গানটা ‘ফিরবে না সে কি ফিরবে না, ফিরবে না আর কোনওদিন’।
|
|
ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য
মন্ট্রিল, কানাডা |
জন্মেছিলাম কলকাতায়। তবে সেই সূত্রে আমি যেমন বাস করতাম কলকাতায়, তেমন কলকাতাও বাস করত আমার মনে, শরীরে। উচ্চমাধ্যমিকের পরই আমার প্রাণের শহর ছেড়ে প্রথম চলে যাওয়া, ভেলোরে। ‘ভেলোর ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি’ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে ‘বায়ো ফিজিক্স’-এ পিএইচডি করতে গিয়ে আবার শহর-বদল। এমনকী দেশ-বদলও বটে। তবু মনের ভেতর বাসা বেঁধে থাকা সেই শহরটাই কিন্তু আমার শহর। কলকাতা। যেখানে আমার বাবা-মা এখনও থাকেন। লেখালেখিটা এক কথায় ‘প্যাশন’। কিছু আন্তর্জাতিক পত্রিকাতেও লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তবে নিজের শহরের সঙ্গে সব সময়ের যোগাযোগটা রাখতে আনন্দবাজার পত্রিকাই ‘তরী’ আমার। রোজ সকালে সেটি পড়েই দিন শুরু হয়। ঘুরে বেড়ানো আর নতুন নতুন জায়গা খোঁজাটা আর এক নেশা। |
|
|
|
|
|