শাসক তৃণমূল বলছে, তাঁর স্বীকারোক্তিকে হাতিয়ার করে তাঁকে গ্রেফতার করেই আইনি প্রক্রিয়া শুরু করা হোক! বামফ্রন্টের শরিকদের মধ্যে ফরওয়ার্ড ব্লকের তরফে কোচবিহার থেকে দাবি উঠছে, দিনহাটা-কাণ্ড নিয়েও ভুল স্বীকার করতে হবে। লোকসভা ভোটের কয়েক মাস আগে রাজনৈতিক শিবির হঠাৎ সরগরম তিন বছর আগের নেতাই-কাণ্ড নিয়ে! সৌজন্যে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ভুল স্বীকার!
বিতর্ক যা-ই হোক, মেদিনীপুরে গিয়ে জেলা সম্পাদক দীপক সরকারকে মঞ্চে বসিয়ে বুদ্ধবাবু সচেতন ভাবেই নেতাইয়ের ঘটনায় ভুল কবুল করেছেন বলে সিপিএম সূত্রের খবর। মাওবাদী মোকাবিলায় পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা সিপিএম নেতৃত্ব বাম জমানায় যে কৌশল নিয়ে চলছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী এবং দলের অন্যতম শীর্ষ নেতা হিসাবে তার সঙ্গে সব ক্ষেত্রে আদপেই সহমত ছিলেন না বুদ্ধবাবু। নেতাইয়ের ঘটনার পরে সেই বিরোধ চরমে উঠেছিল। গত বিধানসভা ভোটের আগে জেলা নেতৃত্বের হঠকারিতার জন্য দলকে বড় মাসুল দিতে হবে, মন্তব্য করেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী। দীপকবাবুদের প্রতিরোধ কৌশলের বিরুদ্ধে তার পরেও দলের মধ্যে সরব থেকেছেন বুদ্ধবাবু। কিন্তু জেলা নেতৃত্বও অনড় থেকেছে! পঞ্চায়েত ভোটে পশ্চিম মেদিনীপুর-সহ জঙ্গলমহলে বামেদের ভরাডুবির পরে জেলা নেতৃত্বে বদলের দাবি দলের অন্দরেও জোরালো হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত মেদিনীপুরে গিয়ে নেতাই নিয়ে খোলাখুলি ভুল স্বীকার করে জেলা নেতৃত্বের মুখরক্ষার পথ বুদ্ধবাবু বন্ধ করলেন বলেই সিপিএম সূত্রের ব্যাখ্যা। |
নেতাই কাণ্ডে প্রকৃত অভিযুক্তদের শাস্তির দাবিতে সোমবার মেদিনীপুর শহরে তৃণমূলের মিছিল।—নিজস্ব চিত্র। |
দল এবং ফ্রন্টের অন্দরে অবশ্য প্রশ্ন উঠছে, ভুল স্বীকারের জন্য লোকসভা ভোটের আগে এই সময়টা বেছে নেওয়া হল কেন? এর ফলে তো তৃণমূল আবার নেতাই নিয়ে উল্টো প্রচার চালানোর অস্ত্র পেয়ে গেল! সিপিএমের এক রাজ্য নেতার বক্তব্য, “ভুল স্বীকারের আগে থেকেই তৃণমূল নেতাইয়ের কথা বলছে। নন্দীগ্রামে সিবিআই চার্জশিট তৃণমূলের বিরুদ্ধে যাওয়ার পরে ওরা আরও বেশি করে নেতাইটা আঁকড়ে ধরেছে! এই অবস্থায় বুদ্ধবাবু মনে করেছেন, আমাদের ভুল আমাদের স্বীকার করে নেওয়াই ভাল। এতে কোনও অগৌরব নেই!”
সিপিএমের একাংশের ইঙ্গিত, বুদ্ধবাবুর রবিবারের মন্তব্যের পরে এ বার পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা নেতৃত্বে পরিবর্তনের বল গড়াতে শুরু করবে। এই বছরেরই শেষ দিকে স্থানীয় স্তরে সম্মেলনের প্রক্রিয়া শুরু হবে সিপিএমে। বুদ্ধবাবুর নেতৃত্বে আলিমুদ্দিনের প্রভাবশালী অংশের চাপ এর পরে আর জেলা নেতৃত্বের পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব হবে না বলেই দলের অন্দরে মনে করা হচ্ছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা সম্পাদক দীপকবাবু অবশ্য এখনও মুখরক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। দীপকবাবুর যুক্তি, বুদ্ধবাবুর মন্তব্যের ঠিক ব্যাখ্যা করা হচ্ছে না। নেতাইয়ে ঘটনার দিন তৃণমূল ও মাওবাদী মিলে সংগঠিত মিছিল করে যে পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, তাতে আতঙ্কিত হয়ে গুলি চালানো হয়েছিল। দলের সমর্থকদের কাজ নিশ্চয়ই ভুল। কিন্তু সেটা জেলা বা কোনও নেতৃত্বের পরিকল্পিত নয়। সিপিএমেরই এক রাজ্য নেতা আবার পাল্টা বলছেন, “গোটা পশ্চিম মেদিনীপুরে দলের কর্মী-সমর্থকদের যে আক্রমণ এবং মিথ্যা মামলার মুখে এখন পড়তে হয়েছে, তার মূলে ওই ভুল লাইন! বিরোধীরা হাতিয়ার পেতে পারে বুঝেও ওই কর্মী-সমর্থকদের কথা ভেবেই বুদ্ধবাবু কথাটা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন।”
স্পষ্ট ভাবে ‘ভীষণ ভুল’ বলে দেওয়ার পরে আপাতত বুদ্ধবাবুকে অবশ্য ঘরে-বাইরে নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় যেমন সোমবার বলেছেন, “নেতাই-কাণ্ডে বুদ্ধবাবুর ভুল স্বীকার করা মানেই অন্যায় মেনে নেওয়া। আইন অনুযায়ী তাঁর শাস্তি পাওয়া উচিত!” আবার ফ ব-র কোচবিহার জেলা নেতৃত্ব প্রস্তুতি নিচ্ছেন, কাল, বুধবার দিনহাটার ‘শহিদ’দের স্মরণসভায় ওই ঘটনার জন্যও বুদ্ধবাবুর ভুল স্বীকারের দাবি তোলা হবে। ফ ব-র কোচবিহার জেলা সম্পাদক উদয়ন গুহের কথায়, “উনি নন্দীগ্রাম, নেতাই নিয়ে দুঃখপ্রকাশ করলেও দিনহাটাকে তালিকায় রাখেননি। ব্রিগেডের সভায় দেখা হলেও সামনাসামনি একই অনুরোধ জানাব।” সিপিএম নেতারা অবশ্য জানাচ্ছেন, ২০০৮ সালের ওই ঘটনা নিয়ে বামফ্রন্টের বৈঠকে উদয়নবাবুরা কখনও তেমন দাবি তোলেননি। আরএসপি-র রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অশোক ঘোষের দাবি, “নেতাজি বা রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ন নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি ভুল স্বীকার করলেও তাদের দলিলে নথিভুক্ত করেনি। নেতাই নিয়ে ভুল স্বীকার আন্তরিক হলে সেটা নথিভুক্ত করা হোক।” সিপিআই রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য দেবাশিস দত্তের মতে, “বিষয়টা একেবারেই সিপিএমের নিজস্ব। তবে ভুল স্বীকার আরও আগে হলে ভাল হত।”
পক্ষান্তরে ফব-র রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য জয়ন্ত রায় বলছেন, “নানা কথা উঠতে পারে। কিন্তু নেতাইয়ের ভুল স্বীকার করে রাজনৈতিক নেতা হিসাবে সৎ সাহসের পরিচয় দিয়েছেন বুদ্ধবাবু।” |