বই প্রকাশ বন্ধ করে বিতর্কে জড়াল গিল্ড
পাছে আলাপ-আলোচনায় রাজ্য সরকারের কোনও রকম সমালোচনা উঠে আসে, তাই নারী-নির্যাতন সংক্রান্ত একটি বই প্রকাশের পূর্বনির্ধারিত অনুষ্ঠান বাতিল করে দিল পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড। সোমবার গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় সরাসরি বলেন, “নারী নির্যাতন নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। বিষয়টা রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে যেত। সরকারের সমস্যা হতে পারত।”
এই ঘটনায় বিতর্ক ছড়িয়েছে বইপ্রেমীদের মধ্যে। প্রশ্ন উঠছে, রাজ্য সরকার কি গিল্ডকে এমন কোনও নির্দেশ দিয়েছিল? গিল্ড কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, সরকারের তরফে কোনও ফরমান তাঁদের কাছে আসেনি। তা হলে কীসের ভিত্তিতে তাঁরা অনুমান করলেন যে, বইটি নিয়ে আলোচনা হলে সরকারের সমস্যা হবে? সরকারের সমস্যা নিয়ে গিল্ডের এত মাথাব্যথাই বা কেন? ত্রিদিবের বক্তব্য, “রাজ্য সরকার বইমেলা আয়োজনে সাহায্য করে। পুলিশ-দমকল-পরিকাঠামো সব কিছু দেয়। রাজ্য সরকারকে সমস্যায় ফেলা আমাদের উচিত নয়।” অতীতে সলমন রুশদি, ইমরান খান বা তসলিমা নাসরিনদের নিয়ে বইমেলায় বিতর্ক হয়েছে। সে সব মনে রেখেই তাঁরা সতর্ক হয়েছেন বলে জানিয়েছেন ত্রিদিব।
কোন বই নিয়ে এত স্পর্শকাতরতা? সেতু প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে যশোধরা বাগচীর ‘পরিযায়ী নারী ও মানবাধিকার।’ এক বছর আগের মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায় স্মারক বক্তৃতার মুদ্রিত সংস্করণ। সোমবার মমার্ত প্রাঙ্গণে পুস্তিকাটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হওয়ার কথা ছিল। সেই মর্মে আগে থেকে মমার্ত ভাড়াও নেওয়া হয়েছিল। গিল্ড কর্তৃপক্ষ সে ক্ষেত্রে গোড়াতেই আপত্তি করেননি কেন? এ দিন দুপুরে তাঁদের টনক নড়ল কেন?
এখানে স্পষ্টই একটি বেনিয়মের দিকে আঙুল তুলছে গিল্ড। যার দায় অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারাও এড়াতে পারছেন না। সেটা কী? বইটি ছেপেছে ‘সেতু প্রকাশনী’। মমার্ত ভাড়া নেওয়া হয়েছিল ‘সার্চ’ নামে একটি সংস্থার নামে। অথচ এ দিন অনুষ্ঠান-মঞ্চে রাখা হয়েছিল ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ মঞ্চে’র ব্যানার, যাদের বইমেলায় কোনও স্টল নেই। স্মারক বক্তৃতাটির আয়োজন অবশ্য ওই মঞ্চের তরফেই করা হয়েছিল। মঞ্চের সদস্য শাশ্বতী ঘোষও স্বীকার করছেন, ‘সার্চ’-এর মাধ্যমে তাঁরাই মমার্তে অনুষ্ঠানের জায়গা ভাড়া নিয়েছিলেন। কিন্তু এক সংস্থার নামে প্রেক্ষাগৃহ ভাড়া করে অন্য সংস্থার অনুষ্ঠান করাটা নিয়মবিরুদ্ধ, জানাচ্ছে গিল্ড। সুতরাং ভাড়ার তিন হাজার টাকা ফিরিয়ে দিয়ে বই প্রকাশের অনুষ্ঠানটি বাতিল করে দেওয়া হয়।
গিল্ডের প্রাক্তন কর্তা অনিল আচার্য অবশ্য এই নিয়ম ভাঙার যুক্তিকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। তিনি বলছেন, “অন্যের নামে মঞ্চ ভাড়া নিয়ে অনুষ্ঠান বইমেলায় অনেক ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে।” কিন্তু গিল্ড সদস্যদের অনেকেই মনে করছেন, অনুষ্ঠানটির উদ্যোক্তারা নিজেদের গলদে গিল্ড কর্তৃপক্ষকে নিয়মের প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দিয়েছেন। বই প্রকাশ বাতিলের সিদ্ধান্ত সমর্থন না করেও এক প্রাক্তন গিল্ড কর্তার কথায়, “যারা অনুষ্ঠানের জায়গা ভাড়া নিয়েছিল, মঞ্চে তাদের ব্যানার থাকলেই বেনিয়মের যুক্তি খাটত না।” এ দিন দুপুরে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ মঞ্চের ব্যানার দেখেই বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর শুরু করেন গিল্ড কর্তারা।
কিন্তু শুধুমাত্র নিয়মের গেরোই যে এ দিনের অনুষ্ঠান বাতিলের কারণ নয়, সে কথা স্বয়ং গিল্ড সম্পাদকের কথাতেই পরিষ্কার। ত্রিদিব এ দিন এ কথাও বলেছেন যে, “বই প্রকাশের অনুষ্ঠানটি যাঁরা আয়োজন করছেন, তাঁদের একটা রাজনৈতিক রং রয়েছে।” কোনও রকম স্পর্শকাতর বিষয় কিংবা এমন কিছু যা রাজনৈতিক বা ধর্মীয় ভাবাবেগ উস্কে দিতে পারে--- তা ওঁরা গিল্ডের প্রেক্ষাগৃহে ঢুকতে দেবেন না। রাজনৈতিক রঙের অভিযোগ অবশ্য মানতে চায়নি নারী আন্দোলনের মঞ্চটি। তাদের বক্তব্য, ডান-বাম সব আমলেই ধারাবাহিক ভাবে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে তারা সরব। অন্য দিকে, রাজনৈতিক রং বাছার ক্ষেত্রে গিল্ড কর্তৃপক্ষ পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
কী রকম? কংগ্রেস বার্তা স্টলের সামনে থেকে রাজনৈতিক প্ল্যাকার্ড উঠিয়ে দিতে বলা হয়েছে। অথচ তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপত্র ‘জাগো বাংলা’র স্টলের বাইরে বড় টিভিতে ব্রিগেডে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তৃতার ছবি দেখানো হচ্ছে। ত্রিদিব অবশ্য এই বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত নন বলে জানিয়েছেন। খোঁজ নিয়ে দেখার কথা বলেছেন।
কিন্তু মেলার মাঠে সরাসরি রাজনৈতিক প্রচার করতে না দেওয়া আর সরকারের সমালোচনামূলক বইপত্র নিয়ে আলোচনা নিষিদ্ধ করা এক কথা নয়। সংস্কৃতি জগতের বিশিষ্ট জনেরা অনেকেই বইমেলা কর্তৃপক্ষের যুক্তি মানতে পারছেন না। প্রাবন্ধিক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “এ তো দেখছি, বই নিষিদ্ধ করারই সমতুল্য!” শমীকবাবুর মনে পড়ছে, তিনি ২০১০ সালে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, জয় গোস্বামী, শাঁওলী মিত্র, অর্পিতা ঘোষেদের সঙ্গে নন্দীগ্রাম-আন্দোলন নিয়ে গিল্ডের প্রেক্ষাগৃহেই আলোচনা করেছিলেন।
গত বছর বইমেলায় কলকাতা লিটেরারি মিটে নারী-নির্যাতন নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। সেখানে শর্মিলা ঠাকুর, অপর্ণা সেনদের কথায় দিল্লির নির্ভয়া-মামলা বা কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের ঘটনার প্রসঙ্গ উঠে এসেছিল। নবনীতা দেবসেন তাই বলছেন, “নারী নির্যাতন নিয়ে আলোচনা হলে রাজ্য সরকার সমস্যায় পড়বে কেন? সরকার তো নিজেরাই নারী নির্যাতনের বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট ভাবিত।”
যাঁর বই নিয়ে এত শোরগোল, সেই যশোধরা বাগচী এখন গুয়াহাটিতে। তিনি টেলিফোনে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে অস্বীকার করেন। শাশ্বতী ঘোষ জানিয়েছেন, যশোধরার বইটিতে ঘরছাড়া মেয়েদের ভিন রাজ্যে শ্রমের কাজ করতে যাওয়া থেকে শুরু করে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার মতো নানা বিষয় রয়েছে। তাঁর দাবি, “এ দিনের অনুষ্ঠানে প্রধানত গান-কবিতাই হতো। তাতে কার কী সমস্যা হতো, মাথায় ঢুকছে না।”
বস্তুত গিল্ড কর্তৃপক্ষ ঠিক কেন আগ বাড়িয়ে এমন পদক্ষেপ করতে গেলেন, সে প্রশ্নের মীমাংসা দিনের শেষেও হয়নি। অনিল আচার্যেরও প্রশ্ন, “গিল্ডের মাথারা কী করে বুঝলেন, অনুষ্ঠানটিতে সরকারের অসুবিধা হবে? সরকারের তরফে কি এমন কিছু ওঁদের বলা হয়েছিল?” ত্রিদিব বলছেন, সরকার নিজে কিছু বলেনি। কিন্তু তাঁর ব্যাখ্যা, ফ্রাঙ্কফুর্টে বিশ্বের বৃহত্তম বইমেলা থেকে শুরু করে সর্বত্রই সরকার বইমেলার পাশে দাঁড়ায়। কলকাতা বইমেলার ক্ষেত্রেও তাই হয়ে এসেছে। সুতরাং বইমেলার তরফেও সরকারের পাশে থাকার দায় রয়েছে। শমীকবাবু পাল্টা উদাহরণ দিয়ে বলছেন, “১৯৬৮ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে সরকার-বিরোধী গণরোষের ছাপ পড়েছিল। কিন্তু ফরাসি সরকার বা উৎসব কর্তৃপক্ষ কেউই জোর করে কিছু ঠেকায়নি।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.