খুনের তদন্তের গতিপ্রকৃতি নিয়ে হাইকোর্ট যা বলছে-বলছে, ক্ষোভ চেপে রাখছেন না শিবানী ঘোষও।
২১ জুলাই চতুর্থ দফার পঞ্চায়েত ভোটের আগের রাতে বীরভূমের পাড়ুইয়ের বাঁধ নবগ্রামে খুন হওয়া সাগর ঘোষের পুত্রবধূ শিবানী। সোমবার তিনি বলেন, “আশঙ্কাজনক অবস্থায় শ্বশুরমশাইকে ফেলে রেখে জোর করে সই করিয়ে নেয় পুলিশ। তারা কেমন তদন্ত করবে তা সবাই জানে। যা তদন্ত হয়েছে, তাতে অপরাধীদেরই আড়াল করা হয়েছে। ঘটনাস্থলের রক্ত ধুয়েমুছে সাফ করার জন্য যে পুলিশ চাপ দেয়, তাদের কাছে কি নিরপেক্ষ তদন্ত প্রত্যাশা করা যায়?” তদন্তের এই অবস্থার পাশাপাশি পরিবারের নিরাপত্তা নিয়েও চিন্তিত শিবানী।
চিন্তায় মুখ শুকনো তাঁর শাশুড়ি সরস্বতী ঘোষেরও। গত ২১ জুলাই রাত থেকে তাঁর জীবন বদলে গিয়েছে। বৃদ্ধা গল্পের মতো বলে চলেন, “সকাল হলেই গোটা পরিবারের ভোট দিতে যাওয়ার কথা ছিল। রাত সওয়া ১১টা নাগাদ বাইরের দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। এত রাতে কে ডাকছে দেখতে উনি (সাগর ঘোষ) নিজেই এগিয়ে গিয়েছিলেন। গ্রিলের বারান্দায় পা রাখতেই পরপর দু’টো গুলি তলপেট ফুঁড়ে দিল। প্রাণ বাঁচাতে বারান্দার পাশেই রান্নাঘরে ঢোকার চেষ্টা করেছিলেন। সাগরবাবুকে প্রথমে বোলপুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে বর্ধমান মেডিক্যাল। সেখানে হাতের গুলি বের করা গেলেও পেটের গুলি বের করা যায়নি। দু’দিন পরেই শেষ হয় বৃদ্ধের লড়াই।
৬৪ বছরের সাগরচন্দ্র ঘোষের ছেলে তৃণমূল কর্মী হৃদয় ঘোষ দলের টিকিট না পেয়ে স্থানীয় কসবা পঞ্চায়েতে নির্দল প্রার্থী হয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। গোটা পঞ্চায়েত এলাকাতেই তৃণমূলের টিকিট পাওয়া প্রার্থীদের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন দলেরই বিক্ষুব্ধেরা। দলের মধ্যে বিরোধ যা ছিল, ছিল। স্থানীয় সূত্রের দাবি, আগুনে ঘি পড়ে বীরভূম জেলা তৃণমূলের সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের এক মন্তব্যে। কসবাতেই দলীয় প্রচারসভায় কর্মীদের উদ্দেশে বিরোধী তথা নির্দল প্রার্থীদের বাড়ি ভেঙে জ্বালিয়ে দেওয়ার ‘নির্দেশ’ দেন অনুব্রত। এমনকী, নির্দলদের সমর্থন করলে পুলিশকে বোমা মারার ‘পরামর্শ’ও দেন তিনি। সাগরবাবুর পরিবারের অভিযোগ, এর জেরেই তাঁদের বাড়িতে হামলা হয়।
ঘটনার রাত থেকেই পুলিশের ভূমিকায় প্রশ্ন উঠেছে। শিবানীদেবীর অভিযোগ, ওই রাতেই তাঁরা পাড়ুই থানায় অভিযোগ জানাতে যান। কিন্তু গুলিবিদ্ধ শ্বশুরমশাইকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেবে না, এই হুমকি দিয়ে পুলিশ তাঁদের দিয়ে সাদা কাগজে সই করিয়ে নেয়। পাড়ুই থানা ছ’জনের বিরুদ্ধে খুনের মামলা করে। গ্রেফতার হয় হৃদয়বাবুর একাদশ শ্রেণিতে পড়া ভাগ্নে, তাঁর মেয়ের গৃহশিক্ষক মানস রায়, মানসবাবুর বাবা নেপাল রায় ও তাঁর ভাই নবকৃষ্ণ রায়কে। চার জনই নিরপরাধ বলে হৃদয়বাবুরা জানান।
পুলিশের মামলায় অন্য যে দু’জনের নাম ছিল, সেই ভগীরথ ঘোষ ও সুব্রত রায় আজও গ্রেফতার হননি। যদিও এই দু’জন খুনের ঘটনায় জড়িত বলে নিহতের পরিবারের অভিযোগ। ঘটনার তিন দিন পরে শিবানীদেবী বীরভূমের তৎকালীন এসপি মুরলীধর শর্মার কাছে ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। তাতে প্রথম ও দ্বিতীয় নাম ছিল অনুব্রত মণ্ডল ও বিকাশ রায়চৌধুরীর। নাম ছিল ভগীরথ আর সুব্রতরও। কিন্তু অভিযোগপত্রটিকে আদৌ এফআইআর হিসেবে বীরভূম পুলিশ গণ্য করেছিল কিনা, তা নিয়ে জেলার পুলিশ-কর্তাদের কেউ-ই মুখ খোলেননি।
সোমবার বিকেলে জেলা সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরীকে নিয়ে অনুব্রতর বোলপুরে একটি ক্লাবের সরস্বতী পুজোর উদ্বোধন করার কথা ছিল। কিন্তু এ দিন আর কেউ-ই আসেননি। তবে অনুব্রতের দাবি, “গোটাটাই বামফ্রন্টের সাজানো। আমি কাউকে খুন করতে যাইনি! পুলিশ যা ভাল বুঝেছে, করেছে।”
পুত্রবধূকে পাশে নিয়ে বাড়ির দাওয়ায় বসে চোখের জল মুছতে মুছতে সরস্বতীদেবী বললেন, “২১ জুলাই রাতের ওই আতঙ্ক এখনও তাড়া করছে। কোথাও বেরোতে পারছি না। দুষ্কৃতীরা এখনও এলাকায় বোমাবাজি করছে। ওদের আতঙ্কেই রোজ মরছি।” ঘটনা হল, হাইকোর্টের নির্দেশের পরেও পুলিশ এ দিন রাত পর্যন্ত ওই পরিবারের জন্য কোনও নিরাপত্তার ব্যবস্থাই করেনি। কসবা অঞ্চলের তৃণমূল নেতা (বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী) নিখিল পাল বলেন, “আদালত যদি মনে করে সিবিআই-কে দিয়ে তদন্ত করাবে, খুবই ভাল হয়। কারণ, এত দিন অবধি প্রভাবিত তদন্তই হয়েছে।” |