সাত দিনের মধ্যে ঠিকঠাক তদন্ত রিপোর্ট জমা না দিলে বীরভূমের পাড়ুইয়ে সাগর ঘোষ হত্যা-মামলায় তদন্তের দায়িত্ব সিআইডি-র থেকে কেড়ে নিয়ে কোনও নিরপেক্ষ সংস্থাকে দেওয়া হবে বলে জানিয়ে দিল কলকাতা হাইকোর্ট। বীরভূম জেলা পুলিশের তদন্তের সঙ্গে সিআইডি-র তদন্তের কোনও ফারাক আদালত খুঁজে পায়নি বলেও সোমবার জানালেন হাইকোর্টের বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত।
জেলা পুলিশের তদন্তে অসন্তুষ্ট হাইকোর্ট গত ২৩ ডিসেম্বরই ওই মামলার তদন্তভার সিআইডি-র হাতে তুলে দিয়েছিল। সাগর ঘোষ খুনে অভিযুক্ত হিসেবে ৭২ দিন জেল খাটার পরে ওই মামলার তদন্তভার সিআইডি-র হাতে তুলে দেওয়ার আর্জি জানিয়ে সম্প্রতি হাইকোর্টে মামলাটি করেছিলেন সাগরবাবুর গ্রামেরই নেপালকৃষ্ণ রায়, নবকৃষ্ণ রায় ও মানস রায়। তাঁদের অভিযোগ ছিল, পুলিশ তাঁদের বিরুদ্ধে খুনের মিথ্যা মামলা শুরু করেছে। কিন্তু এর পর সিআইডি-র তদন্তের গতিপ্রকৃতি দেখেও ক্ষুব্ধ ছিল হাইকোর্ট। মামলার প্রতিটি শুনানিতে তা স্পষ্ট হয়ে যায়। তদন্তে নেমে এখনও কেন সিআইডি প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান নেয়নি, গত শুক্রবার সেই প্রশ্ন তোলেন বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত। সিআইডি-কে নিহতের স্ত্রী, পুত্রবধূর বয়ান নিয়ে তা আদালতে পেশ করতেও নির্দেশ দেন। |
নিজেদের বাড়িতে নিহত সাগর ঘোষের স্ত্রী সরস্বতীদেবী ও পুত্রবধূ শিবানীদেবী। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী। |
এ দিন শুনানির সময় সিআইডি-র পক্ষ থেকে আদালতের হাতে নিহতের স্ত্রী সরস্বতীদেবী ও পুত্রবধূ শিবানীদেবীর গোপন জবানবন্দির প্রতিলিপি-সহ দু’টি মুখবন্ধ খাম তুলে দেন সরকার পক্ষের আইনজীবী শাক্য সেন। এত দিন পরে সিআইডি-র তদন্তকারী অফিসার সিলবন্ধ জবানবন্দি জমা দিলেন ঠিকই। কিন্তু আদালতে পেশ হওয়ার আগে সেই খাম এক বার খুলে আবার সিল করে জমা দেওয়া হয়েছে কি না, তাই নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে।
খামের বিষয়বস্তু পড়ার পরে বিচারপতি সরকারি আইনজীবীর কাছে জানতে চান, গোপন জবানবন্দিতে নাম থাকা অভিযুক্তদের (নিহতের পরিবারের অভিযোগপত্রে প্রথম নাম রয়েছে বীরভূম জেলা তৃণমূলের সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের। পরের নামটি বীরভূম জেলা পরিষদের সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরীর) কি গ্রেফতার করা হয়েছে? সরকারি আইনজীবী দাবি করেন, অভিযুক্তদের অনেকেই ফেরার।
বিচারপতির পাল্টা প্রশ্ন, যাঁরা ফেরার নন, তাঁদের গ্রেফতার করা হয়নি কেন? আদালত নির্দেশ দিলে তবেই কি সিআইডি নড়েচড়ে বসবে? কার নির্দেশে সিআইডি-র তদন্ত এগোচ্ছে, এ দিন সেই প্রশ্নও তোলেন বিচারপতি। জানতে চান, ওই ঘটনায় যাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাঁদের শনাক্তকরণ (টিআই প্যারেড) হয়েছে কি? শাক্যবাবু জানান, এখনও হয়নি। ক্ষুব্ধ বিচারপতি মন্তব্য করেন, তদন্তে কী করতে হবে, তার সব ব্যাপারেই কি আদালতকে নির্দেশ দিতে হবে?
সিআইডি-কে হাইকোর্টের তিরস্কার প্রসঙ্গে এ দিন মন্তব্য করতে চাননি তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। দলের কাজে মুকুলবাবু এ দিন ছিলেন ভুবনেশ্বরে। যোগাযোগ করা হলে তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য, “এই বিষয়ে আজ কোনও মন্তব্যই করব না। যা বলার, পরে বলব।” যদিও সোমবার রাতে অনুব্রত মণ্ডল বলেন, “আমি তো পুলিশকে বলিনি যে, আমাকে গ্রেফতার কোরো না! পুলিশ কেন গ্রেফতার করছে না, তা তারাই বলতে পারবে।” তাঁর দাবি, গোটাটাই বামফ্রন্টের সাজানো ও মিথ্যা মামলা। আর সভাধিপতি বিকাশবাবুর মন্তব্য, “যে দিন খুনের ঘটনা ঘটে, সে দিন আমি আর অনুব্রতদা কোথায় ছিলাম, সেটা পুলিশ জানে। আর তার জন্যই পুলিশ আমাদের গ্রেফতার করছে না।”
এ কথা শুনে নিহতের ছেলে হৃদয় ঘোষের প্রতিক্রিয়া, “আমরা কখনওই দাবি করিনি, ওঁরা (অনুব্রত-বিকাশ) আমাদের বাড়ি ঢুকে বাবাকে খুন করে গিয়েছেন। কিন্তু, ওই খুন যে তাঁদের নির্দেশে হয়েছে, ষড়যন্ত্রের মূলে যে তাঁদেরই মাথা রয়েছে, তা নিরপেক্ষ তদন্ত হলেই প্রমাণিত হয়ে যাবে।”
বিরোধীরা অবশ্য বীরভূমে অনুব্রত মণ্ডলদের দাপটের জন্য স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী-সহ তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের ‘প্রশ্রয়’কেই দায়ী করেছে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মহম্মদ সেলিমের কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী কখনও বলেন ছোট ছোট ছেলেদের কাজ, কখনও বলেন দামাল ছেলেরা একটু দুষ্টুমি করবেই। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী এমন বললে পুলিশ-প্রশাসনও একটু দুষ্টুমি আড়ালের চেষ্টা করবে! তারই ফল ভুগছে বীরভূম।” কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়ারও বক্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রীর স্নেহ ও মমতায় সুশীল বালকেরা দুষ্টু, দামাল ছেলেতে পরিণত হয়েছে। এদের সংখ্যা রোজ বাড়তে থাকলে বাংলার অবস্থা কী যে দাঁড়াবে!”
সাগর ঘোষ হত্যা মামলায় প্রথম থেকেই হাইকোর্টে তীব্র ভর্ৎসনার মুখে পড়েছে পুলিশ এবং সিআইডি। গত ১০ ডিসেম্বর সিআইডি তদন্তের আর্জি জানিয়ে করা মামলার প্রথম শুনানির দিন বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় নিহতের স্ত্রী ও পুত্রবধূর সঙ্গে নিজে কথা বলেছিলেন। তাঁরা হত্যার ঘটনার সময় কাদের দেখেছেন, তা-ও তিনি জানতে চান। দু’জনেই কয়েক জনের নাম জানান। তাঁরা এ-ও দাবি করেন, পাড়ুই থানার পুলিশ তাঁদের জোর করে সাদা কাগজে সই করিয়ে নেয়। সেই কাগজেই এফআইআর লেখা হয়। বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় সব জেনে পুলিশের বিবেক নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ভর্ৎসনার মুখে সরকারি আইনজীবী এজলাসেই স্বীকার করেন, এই ঘটনায় লোভ কাজ করেছে। সিআইডি-র হাতে দায়িত্ব দিয়ে বিচারপতি এক মাসের মধ্যেই একটি রিপোর্ট জমা দিতে বলেন। এর পরে সাগর ঘোষের পরিবার ওই মামলায় পক্ষ হয়। সিআইডি তদন্তে অনাস্থা প্রকাশ করে তাঁরা সিবিআই তদন্তের আর্জি জানান। |
|
আমি তো পুলিশকে বলিনি যে, আমাকে গ্রেফতার কোরো না!
পুলিশ কেন গ্রেফতার করছে না, তা তারাই বলতে পারবে।
অনুব্রত মণ্ডল, বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি |
|
পরবর্তীতে মামলাটি বিচারপতি দীপঙ্কর দত্তের এজলাসে আসে। গত ২৪ জানুয়ারি হাইকোর্টে সেই রিপোর্ট জমা না দিয়ে মামলার তদন্তে আরও সময় চেয়ে আবেদন করে সিআইডি। অসন্তুষ্ট বিচারপতি সে দিনই প্রশ্ন তুলেছিলেন, তদন্তকারী দল এখনও কেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, সাগরবাবুর স্ত্রী-পুত্রবধূর বয়ান নেয়নি। এর পরেই সিআইডি পাড়ুইয়ে গিয়ে নিহতের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে। সিউড়ি জেলা আদালতে সাগরবাবুর স্ত্রী, পুত্রবধূ-সহ ৪ জনের জবানবন্দি নেয়।
সোমবার সরকারি আইনজীবী সরস্বতীদেবী ও শিবানীদেবীর যে জবানবন্দি হাইকোর্টে জমা দেন, তা বিচারপতি দত্তকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। আগে হাইকোর্টের কাছে ওই দুই মহিলা যে বয়ান দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে জমা দেওয়া জবানবন্দি পুরোপুরি না মেলায় বিস্ময় প্রকাশ করেন বিচারপতি। নিহতের পরিবারের আইনজীবীর কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন, ঘটনার ২ প্রত্যক্ষদর্শী মহিলার কেউ-ই নিরাপত্তা পাননি। বীরভূমের এসপিকে বিচারপতি বলেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁদের নিরাপত্তা দিতে হবে। এই নির্দেশ পালন না করলে সোমবার তিনি এমন কড়া নির্দেশ দেবেন, যা পুলিশ মনে রাখবে। যদিও নিরাপত্তা প্রসঙ্গে বীরভূমের এসপি অলোক রাজোরিয়া বলেন, “বিষয়টি আমাদের এক্তিয়ারভুক্ত নয়। যা বলার ও করার সিআইডি করবে।”
এর পরেও সিআইডি আদালতের কাছে কিন্তু আর একটা সুযোগ পাচ্ছে। সোমবার সিআইডি-র তদন্তকারী অফিসারকে আরও এক বার পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট জমা দিতে হবে হাইকোর্টে। সেই রিপোর্টে সন্তুষ্ট না হলে তিনি যে তদন্তভার নিরপেক্ষ সংস্থার হাতেই দিয়ে দেবেন, এ দিন তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন বিচারপতি দত্ত। অনেকের মতে, সিবিআইয়ের হাতে তদন্তভার দেওয়ারই ইঙ্গিত রয়েছে এই কথায়।
|
হাইকোর্টের সাত প্রশ্ন |
• মামলার প্রধান অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হয়নি কেন?
• ধৃতদের টিআই প্যারেড করানো হয়নি কেন?
• কেন নিরাপত্তা দেওয়া হয়নি সাগর ঘোষের পরিবারকে?
• আদালতকে কি প্রতিটি বিষয়েই নির্দেশ দিতে হবে?
• সিআইডি কি খুনের তদন্ত করতে জানে না?
• কার নির্দেশে সিআইডি এ ভাবে তদন্ত করছে?
• তা হলে কেন নিরপেক্ষ সংস্থার কাছে তদন্তভার যাবে না? |
|