শেষ অবধি সিআইডি-র হাতেই গেল সাগর ঘোষ হত্যা মামলার তদন্তভার। সোমবার এই নির্দেশ দিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়।
ওই খুনে অভিযুক্ত হিসেবে ৭২ দিন জেল খাটার পরে সম্প্রতি ওই মামলার তদন্তভার সিআইডি-র হাতে তুলে দেওয়ার আর্জি জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেন বাঁধ নবগ্রামেরই নেপালকৃষ্ণ রায়, নবকৃষ্ণ রায় ও মানস রায়। তাঁদের দাবি, পুলিশ তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা শুরু করেছে। ঘটনার রাতেই পুলিশ যে চার জনকে গ্রেফতার করেছিল, তাঁরা হলেন নিহত সাগরবাবুর নাতি, স্কুলছাত্র প্রিয়রঞ্জন ঘোষ এবং ওই গ্রামেরই বাসিন্দা নেপালবাবু, তাঁর ভাই নবকৃষ্ণ ও ছেলে মানস। কারও নামই নিহতের পুত্রবধূ শিবানী ঘোষের দায়ের করা অভিযোগপত্রে ছিল না। ওই মামলার শুনানিতে আগে সাগরবাবুর স্ত্রী সরস্বতী ঘোষ এবং পুত্রবধূকে ডেকে পাঠিয়েছিল আদালত। এ দিন তাঁদের তরফের আইনজীবী সঞ্জীব দাঁ-র অভিযোগ, “সাগরবাবুর ছেলে হৃদয় ঘোষ নির্দল হিসেবে দাঁড়ানোয় তৃণমূলের কিছু নেতার মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। তাতেই চক্রান্ত করে সাগর ঘোষকে হত্যা করা হয়। যদিও নিহতের পরিবারের দায়ের করা এফআইআর-কে মূল্য না দিয়ে পুলিশ নিজের করা এফআইআর অনুযায়ী তদন্ত চালাতে থাকে। যে তদন্তে কোনও দিনই প্রকৃত সত্য প্রকাশিত হবে না।”
হৃদয়বাবু বলেন, “এটা আমাদের নৈতিক জয়। পুলিশ যে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে নিজের মতো করে এফআইআর লিখিয়েছিল, তা প্রমাণ হল। বিচারপতি আমাদের এফআইআরকেই গুরুত্ব দিলেন।” তাঁর মা-র বক্তব্য, “ ঘটনাটা চোখের সামনে দেখা। সেই মতো অভিযোগও করেছিলাম। এ বার সিআইডি তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের ধরুক। ওরা শাস্তি পেলে শান্তি পাব।” |
এ দিন শুনানির শেষেই বিচারপতি জেলা পুলিশের হাত থেকে তদন্ত ভার তুলে দেন সিআইডি-কে। চার সপ্তাহের মধ্যে সিআইডি-কে তদন্তের অগ্রগতির রিপোর্ট হাইকোর্টে জমা দিতে হবে।
পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়নপত্র জমাকে কেন্দ্র করে জেলায় জেলায় রাজনৈতিক হিংসার আবহে বিতর্ক বেধেছিল বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের মন্তব্যে। পঞ্চায়েত ভোটের ঠিক আগে রামপুরহাটে নিয়ে দলের একটি কর্মিসভায় অনুব্রত বলেন, “আপনারা মনোনয়ন জমা দিন। কিন্তু, কংগ্রেস-সিপিএম আমাদের শত্রু। কাউকে মনোনয়ন ফাইল করতে দেবেন না। দরকার হলে আমাকে ডাকবেন। আমি আপনাদের পাশে থাকব!” অনুব্রত-র বক্তব্য প্রকাশ্যে আসতেই সরব হন বিরোধীরা। তাঁদের বক্তব্য ছিল, অনুব্রত-র মন্তব্য উস্কানিমূলক। এতে হিংসা আরও বাড়বে। পরে অনুব্রত দাবি করেন, “আমি ও-রকম কিছু বলিনি।”
গত ২১ জুলাই রাতে পঞ্চায়েত ভোটের ঠিক আগে পাড়ুইয়ের বাঁধ নবগ্রামে দুষ্কৃতীদের হাতে গুলিবিদ্ধ হন সাগরবাবু। পরে বর্ধমান মেডিক্যালে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর ছেলে হৃদয় স্থানীয় কসবা পঞ্চায়েতে নির্দল প্রার্থী (বিক্ষুব্ধ তৃণমূল) হিসাবে লড়ছিলেন। ঘটনায় প্রথম থেকেই জেলা পুলিশের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ উঠেছিল। পরিবারের অভিযোগ ছিল, তৃণমূলের সদস্য হলেও টিকিট না পেয়ে হৃদয়বাবু পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ান। ওই আক্রোশেই ভোটের ঠিক আগের রাতে তৃণমূলের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর আশ্রিত দুষ্কৃতীরা হৃদয়কে খুন করতে তাঁর বাড়িতে হানা দেয়। যদিও ওই দুষ্কৃতীদের নিশানায় পড়ে যান তাঁর বাবা, বৃদ্ধ সাগর ঘোষ। অভিযোগে নাম রয়েছে অনুব্রত-র। নিহতের পরিবারের আরও দাবি, দোষীদের না ধরে পুলিশ নিরপরাধদেরই গ্রেফতার করেছে।
গত ১০ ডিসেম্বর সিআইডি তদন্তের আর্জিতে করা মামলার প্রথম শুনানির দিন বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় নিহতের স্ত্রী ও পুত্রবধূর সঙ্গে নিজে কথা বলেন। তাঁরা হত্যার ঘটনার সময় কাদের দেখেছেন, তা জানতে চান। দু’জনেই কয়েকজনের নাম জানান। তাঁরা এ-ও দাবি করেন, পাড়ুই থানার পুলিশ তাঁদের জোর করে সাদা কাগজে সই করিয়ে নেয়। সেই কাগজেই এফআইআর লেখা হয়। পরে, সাগর ঘোষের পরিবারের লোকেরা অনুব্রতকে প্রধান অভিযুক্ত করে একটি এফআইআর দায়ের করেন। ওই দিনই বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়ও ওই খুনের ঘটনার তদন্তে পুলিশি গাফলতি দেখে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিচারপতি রীতিমতো ঘটনায় পুলিশের বিবেক নিয়েই প্রশ্ন তোলেন। এমনকী, ভর্ৎসনার মুখে পড়ে সরকারি আইনজীবী এজলাসেই স্বীকার করেন, এই ঘটনায় ‘লোভ’ কাজ করেছে।
এর আগে বীরভূম পুলিশকে কার্যত ‘তিরস্কার’ করেছিলেন সিউড়ির মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম)। উস্কানিমূলক বক্তৃতার জেরে অনুব্রত-র বিরুদ্ধে বীরভূমের জেলাশাসককে মামলা করার নির্দেশ দেয় নির্বাচন কমিশন। কিন্তু, মামলা শুরুর ক্ষেত্রে পুলিশি গাফিলতি নজরে পড়ে খোদ সিজেএমের-ই। তৎকালীন পুলিশ সুপারকে দেওয়া লিখিত নির্দেশে তিনি বলেছিলেন, ‘এটি পুলিশের দিক থেকে নিষ্ক্রিয়তা।’ বিষয়টি হাইকোর্টের নজরেও আসায় আশার আলো দেখছিলেন নিহতের পরিবার। এ দিন আদালতের নির্দেশে তাঁদের সেই আশায় পূর্ণ হল।
তবে হাইকোর্টের এ দিনের রায় নিয়ে বিশেষ কিছু বলতে চাননি অনুব্রত মণ্ডল। ফোনে শুধু বলেন, “আইন আইনের পথে চলবে।” অন্য দিকে, জেলার এসপি সি সুধাকর বলেন, “হাইকোর্টের নির্দেশ হাতে পেলেই এই নিয়ে কথা বলব।” নেপালবাবুরা অবশ্য বলেন, “হাইকোর্টের এই নির্দেশের পরে আশা করছি এ বার সুবিচার পাব। সিআইডি নিরপেক্ষ ভাবে ঘটনার তদন্ত করলে প্রকৃত অপরাধীরা ধরা পড়েবে।”
|