একটা খটখট শব্দ শুনে নিজেই এগিয়ে গিয়েছিলেন গ্রিলের দরজা খুলতে। পরপর দু’টি গুলি তলপেট ফুঁড়ে দিয়েছিল হতভাগ্য বৃদ্ধের। প্রাণ বাঁচাতে কোনও রকমে পাশেই রান্নাঘরে ঢোকার চেষ্টা করেছিলেন। সেখানেও জানলা দিয়ে আরও একটি গুলি ছুটে এসে হাতে লাগতেই লুটিয়ে পড়েছিলেন অবসরপ্রাপ্ত স্কুলকর্মী সাগরচন্দ্র ঘোষ। দু’ দিনের লড়াই শেষ হয় হাসপাতালে।
গত ২১ জুলাই পঞ্চায়েত ভোটের ঠিক আগের রাতে বীরভূমের পাড়ুই থানার কসবা পঞ্চায়েতের বাঁধ নবগ্রামে নির্দল প্রার্থী (আদতে বিক্ষুব্ধ তৃণমূল) হৃদয় ঘোষের বাবার ওই খুনকে ঘিরে তোলপাড় হয়েছিল রাজ্য রাজনীতি। তার ঠিক আগেই অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে দু’বার বিতর্কিত মন্তব্য করে উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ উঠতে শুরু করেছিল বীরভূম জেলা তৃণমূলের সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে। এই পরিস্থিতি সাগর ঘোষ খুনের তদন্তে গাফিলতির অভিযোগও উঠতে শুরু করে।
নিহতের পরিবার প্রথম থেকেই দু’টি অভিযোগ করেছে। এক, পাড়ুই থানার পুলিশ তাঁদের দিয়ে সাদা পাতায় সই করিয়ে নিয়ে নিজেরাই এফআইআর লিখেছে। দুই, এফআইআরে প্রকৃত দোষীদের নাম না রেখে পুলিশ নিরপরাধ ব্যক্তিদের নাম ঢুকিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে কেস দিয়েছে। পুলিশ যে চার জনকে খুনের ঘটনায় ধরেছিল, তাঁদের মধ্যে তিন জন গোটা ঘটনার সিআইডি তদন্ত চেয়ে কলকাতা হাইকোর্টে আবেদন করেছিলেন। মঙ্গলবারই সেই মামলার শুনানির সময় হাইকোর্টের বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় বীরভূম পুলিশের ভূমিকায় তীব্র ভর্ৎসনা করে তাদের বিবেক নিয়েই প্রশ্ন তোলেন। বিচারপতির প্রশ্ন গোটা মামলায় পুলিশের গাফিলতির অভিযোগকেই মান্যতা দিল বলে মনে করছেন কসবা অঞ্চলের মানুষ। |

সাগরবাবুর মৃতদেহকে ঘিরে ভেঙে পড়েছে পরিবার। —ফাইল চিত্র। |
এর আগেও বীরভূম পুলিশকে কার্যত ‘তিরস্কার’ করেছিলেন সিউড়ির মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম)। উস্কানিমূলক বক্তৃতার জেরে অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে বীরভূমের জেলাশাসককে মামলা করার নির্দেশ দিয়েছিল রাজ্য নির্বাচন কমিশন। কিন্তু, সেই মামলা শুরুর ক্ষেত্রে পুলিশি গাফলতি নজরে পড়ে খোদ সিজেএমের-ই। তৎকালীন পুলিশ সুপারকে দেওয়া লিখিত নির্দেশে তিনি বলেছিলেন, ‘এটি পুলিশের দিক থেকে নিষ্ক্রিয়তা। যা হাল্কা ভাবে নেওয়া উচিত নয়।’
বিষয়টি এ বার হাইকোর্টের নজরেও আসায় আশার আলো দেখছেন নিহত সাগরবাবুর পরিবার। নিহতের ছেলে হৃদয় বা স্ত্রী সরস্বতীদেবী, কেউই অবশ্য মুখ খুলতে চাইছেন না। এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, ওই ঘটনার পর থেকেই আতঙ্ক তাড়া করে বেড়াচ্ছে পরিবারটিকে। তবে, এলাকার মানুষের একটা বড় অংশের আস্থা রয়েছে বিচারব্যবস্থার উপরে। বিশেষ করে মঙ্গলবার হাইকোর্ট যে ভাষায় জেলা পুলিশের সমালোচনা করেছে, তাতে আশার আলো দেখছেন তাঁরা। এবং মনে করছেন, হাইকোর্ট হস্তক্ষেপ করলে প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই হবে পুলিশকে। ঘটনা হল, মঙ্গলবারের শুনানিতেও গোটা বিষয়টিকে ‘অত্যন্ত গুরুত্ব’ দিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি।
এত দিন হৃদয়বাবুর নাবালক ভাগ্নে সহ-চার জনকে গ্রেফতার করা ছাড়া পুলিশ ওই খুনের মামলার তদন্তে কার্যত কোনও অগ্রগতিই করতে পারেনি। অথচ নিহতের পরিবারেরই দাবি, ওই চার জন ধৃত আদৌ খুনের ঘটনায় জড়িত নন। পুলিশ যে চার জনকে ধরেছিল, তাঁরা হলেন নিহত সাগরবাবুর নাতি, স্কুলছাত্র প্রিয়রঞ্জন ঘোষ এবং বাঁধ নবগ্রামেরই বাসিন্দা নেপাল রায়, তাঁর ভাই নবকৃষ্ণ রায় ও ছেলে মানস। প্রত্যেকেরই দাবি, পুলিশ তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা শুরু করেছে। এমনকী, নিহতের পরিবারের অভিযোগপত্রেও তাঁদের নাম ছিল না। এ দিন নিজের বাড়ির দাওয়ায় বসে বাঁধ নবগ্রামের নেপালবাবু বললেন, “আইনের রক্ষক হয়েও পুলিশ এমন আচরণ করছে! আমাদের এখন আর তাদের প্রতি বিন্দু মাত্র আস্থা নেই। সে জন্যই হাইকোর্টে নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়ে মামলা করেছি।”
ঘটনা হল, খুনের ঘটনায় জেলার তৎকালীন পুলিশ সুপারকে রেজিস্ট্রি ডাক মারফত পাঠানো সাগরবাবুর পুত্রবধূ শিবানী ঘোষের অভিযোগপত্রে (আইনত যা এফআইআর হিসেবেই গণ্য হওয়ার কথা) যে ৪১ জনের নাম ছিল, তার প্রথমটিই হল জেলার দাপুটে তৃণমূল নেতা অনুব্রত-র। বাকি ৪০ জন তাঁরই ঘনিষ্ঠ। ওই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলাই শুরু করা হয়নি বলে পুলিশ সূত্রেরই খবর। বিরোধী দলগুলি প্রথম থেকেই অভিযোগ করেছে, অনুব্রত-র নাম থাকাতেই শিবানীদেবীর অভিযোগপত্রকে গুরুত্ব দেয়নি পুলিশ। জেলা কংগ্রেসের এক নেতার মন্তব্য, “পুলিশ-প্রশাসন প্রথম থেকেই শাসক দলের ওই নেতাকে আড়াল করে এসেছেন। প্রকাশ্য সভায় পুলিশের উপরে বোমা মারার হুমকি দেওয়ার পরেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘অনুব্রত ও কথা বলতে চায়নি’! স্বাভাবিক ভাবেই পুলিশও হাত গুটিয়ে বসে আছে।” |

বিচারের অপেক্ষায় নিহতের স্ত্রী সরস্বতী ঘোষ। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী। |
মঙ্গলবার জেলার বর্তমান পুলিশ সুপার সি সুধাকর দাবি করেছিলেন, তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। খোঁজ নিয়ে দেখবেন। নিহতের পুত্রবধূর অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে ঠিক কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সে প্রশ্নের জবাবে বুধবার অবশ্য তিনি বলেন, “ওই অভিযোগের প্রেক্ষিতে তৎকালীন পুলিশ সুপার একটি তদন্ত করিয়েছিলেন। তার রিপোর্টও জমা পড়েছিল।” জেলা পুলিশ সূত্রে কিন্তু জানা যাচ্ছে, ডিএসপি পদমর্যাদার এক অফিসার ওই তদন্ত করেছিলেন। তদন্ত-রিপোর্টে বলা হয়েছে, অনুব্রত-সহ ৪১ জন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে সাগরবাবুর খুনের ঘটনায় জড়িত থাকার প্রমাণ মেলেনি। তাই শিবানীদেবীর অভিযোগের ভিত্তিতে কোনও মামলাই শুরু করা হয়নি!
স্বাভাবিক ভাবেই আতঙ্ক বহাল কসবা এলাকায়। বিশেষ করে জেলা জুড়ে সদ্য সমাপ্ত পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলের বিপুল জয়ের পরে সেই আতঙ্ক আরও বেড়েছে বলেই জানাচ্ছেন এলাকার বাসিন্দাদের একাংশ। কসবা পঞ্চায়েতটি অবশ্য চালাচ্ছেন বিক্ষুব্ধ তৃণমূল কর্মীরাই (যাঁরা নির্দল হিসাবে লড়ে জিতেছেন)। সেখানে এখনও অনুব্রত-গোষ্ঠী দাঁত ফোটাতে পারেনি। ৫ নম্বর সংসদ থেকে নির্দল প্রার্থী হিসেবে জেতা শঙ্করী দাস এখন সেখানকার প্রধান। উপপ্রধান আবার তৃণমূলেরই দলীয় প্রতীকে জেতা অনুব্রত-বিরোধী গোষ্ঠীর পার্বতী বাগদি। এ দিন দুপুরে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প-সহ নানা বিষয়ে আলোচনার জন্য সিউড়িতে জেলা পরিষদের বৈঠকে গিয়েছিলেন শঙ্করীদেবী। ফোনে ধরা হলে বলেন, “জেতার পর প্রতিশ্রতি মতো উন্নয়নের কাজকর্ম শুরু করেছি। এখনও পর্যন্ত সেই কাজ করতে গিয়ে কোনও বাধা পাইনি। তবে কোথাও যেন একটা আতঙ্ক রয়েছে। তা ভেঙে বলতে চাই না!”
এলাকায় আতঙ্ক আছে। সঙ্গে আছে সাগর ঘোষ খুনের এত মাস পরেও অভিযুক্ত ৪১ জনের মধ্যে পুলিশ কাউকে না ধরায় চাপা ক্ষোভও। প্রকৃত দোষীদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত আতঙ্ক থেকে যে মুক্তি মিলবে না, তা আড়ালে স্বীকার করে নিচ্ছে সাগর ঘোষের পরিবার। প্রকাশ্যে অবশ্য মুখ খুলছেন না কেউ-ই। সাগরবাবুর পরিবারের সদস্যেরা তো বটেই, এমনকী ওই খুনের ঘটনার পরে কসবা অঞ্চলের যে বিক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যেই অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন বা নিহতের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরাও আজ মুখে কুলুপ এঁটেছেন। এক দিন যাঁরা কামদুনির মতো আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার শপথ নিয়েছিলেন, কী হল তাঁদের? নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেই তৃণমূল নেতাদেরই এক জন এ দিন বললেন, “অপরাধীরা প্রকাশ্যে ঘুরছে। পুলিশ তাদের ধরছে না। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, পঞ্চায়েত ভোটে অনুব্রত-গোষ্ঠীর বিপুল জয়ের পর থেকে কেউ আর বিদ্রোহী হওয়ার সাহস দেখাচ্ছেন না!”
যাঁর বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ সাগরবাবুর পরিবারের, সেই জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের বক্তব্য, “এ ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই। পুলিশ-প্রশাসন-বিচারব্যবস্থা তো রয়েইছে! কোনও মন্তব্য করব না।”
তবে, আজ বৃহস্পতিবার কলকাতা হাইকোর্টে নেপালবাবুদের মামলার ফের শুনানি আছে। এখন সে দিকেই তাকিয়ে আছে কসবা।
|
 |
• ২ জুলাই রামপুরহাটে পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে একটি কর্মিসভায় বিরোধীদের মনোনয়নপত্র দাখিলে বাধা দিতে অনুব্রত-র নির্দেশ।
• ১২ জুলাই অনুব্রত-র বিরুদ্ধে বীরভূমের জেলাশাসককে এফআইআর করার নির্দেশ নির্বাচন কমিশনের।
• ১৭ জুলাই ভোটপ্রচারে গিয়ে নির্দলদের উপরে চড়াও হওয়ার নির্দেশ। পুলিশ-প্রশাসনকেও বোমা মারার পরামর্শ অনুব্রত-র।
• ১৮ জুলাই নির্দল প্রার্থীদের বাড়িতে হামলা করার অভিযোগ। ডিএমের কাছে অনুব্রতর বক্তব্যের রেকর্ডিং চাইল নির্বাচন কমিশন। অনুব্রত বললেন, ‘স্লিপ অফ টাং’।
• ২১ জুলাই রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ কসবা পঞ্চায়তের নির্দল প্রার্থী হৃদয় ঘোষের বাবা সাগরচন্দ্র ঘোষ বাড়িতে গুলিবিদ্ধ।
• ২২ জুলাই ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে সাদা কাগজে সই করিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠল। ফের নির্দল প্রার্থীর বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনাকে কেন্দ্র করে কসবা পঞ্চায়েত এলাকায় উত্তেজনা।
• ২৩ জুলাই বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু সাগর ঘোষের। অনুব্রতর গতিবিধির উপরে নজরদারির নির্দেশ নির্বাচন কমিশনের।
• ২৪ জুলাই সাগর ঘোষ খুনের ঘটনায় পাড়ুই থানার পুলিশের বিরুদ্ধে এফআইআর না নেওয়ার অভিযোগ। ডাক যোগে বীরভূমের পুলিশ সুপারের কাছে অনুব্রত-সহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ।
• ২৫ জুলাই নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ পালনে গড়িমসি। উস্কানিমূলক মন্তব্যের মামলায় অনুব্রতর বিরুদ্ধে মামলা শুরু করতে ফের আর্জি জানাতে পুলিশকে নির্দেশ সিউড়ি আদালতের।
• ২৭ জুলাই ‘অনুব্রত ও কথা বলতে চায়নি’ বিধানসভায় দাবি মুখ্যমন্ত্রীর।
• ২৯ জুলাই কসবা পঞ্চায়েতের ১২টি আসনের মধ্যে অনুব্রত গোষ্ঠী ৬টি এবং বিক্ষুব্ধরা ৬টি আসন দখল করে।
• ১ অগস্ট সরেজমিন তদন্ত করে মানবাধিকার কমিশন।
• ৫ অগস্ট নানা মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ তুলে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হৃদয় ঘোষ-সহ জয়ী নির্দল প্রার্থী এবং বিক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতৃত্ব।
• ১৭ অগস্ট ভোটে কসবা পঞ্চায়েতের ফল ‘টাই’ হওয়ায় লটারির মাধ্যমে প্রধান নির্বাচিত হন নির্দল প্রার্থী শঙ্করী দাস।
• ১০ ডিসেম্বর সাগর ঘোষ খুনের সিআইডি তদন্ত চেয়ে কলকাতা হাইকোর্টে দায়ের হওয়া মামলায় পুলিশের ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ বিচারপতির। |
|