মনে ভারী দুখ। কেউ নাকি ভালবাসে না। তাই টাওয়ারে উঠলেন রামনাথ।
১৮০ ফুট উঁচু বিদ্যুতের টাওয়ারের একেবারে উপরের দিকে গ্যাঁট হয়ে বসে তিনি। তাঁকে নামানোর চেষ্টায় টাওয়ারের নীচে জড়ো হওয়া পুলিশ-প্রশাসনের তাবড় কর্তাদের রক্তচাপ বেড়ে চলেছে। সকলে হাতজোড় করে বাবা-বাছা করলেও নামার লক্ষণ নেই। অত উঁচুতে বসেই লুকোচুরি খেলে নাকাল করে দিলেন বিপর্যয় মোকাবিলা দলের সদস্যদের।
শনিবার দুপুরে পুরুলিয়ার সাঁওতালডিহি থানার পাবড়া গ্রামের ওই টাওয়ারকে ঘিরে যে নাটকের সূত্রপাত, তার যবনিকাপাত হল গভীর রাতে। তার মাঝে মহকুমাশাসকের হস্তক্ষেপে বন্ধ করতে হয়েছে টাওয়ারের বিদ্যুৎ সংযোগ। বিস্তর অনুরোধের পরে রাত দেড়টা নাগাদ টাওয়ারের উপর থেকে নেমেই ছুট লাগালেন পাবড়া গ্রামের বাসিন্দা রামনাথ রজক। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল পুলিশ-প্রশাসন। ততক্ষণে কেটে গিয়েছে পাক্কা সাড়ে দশ ঘণ্টা!
রবিবার বিকেল ৩টে নাগাদ ফোনটা পেয়েই চমকে উঠেছিলেন সাঁওতালডিহি থানার ডিউটি অফিসার শম্ভুনাথ সাহা। ফোনের ও-পারের ব্যক্তি তখন বলছেন, “পাবড়া গ্রাম থেকে বলছি। আমার খুব দুঃখ। কেউ ভালবাসে না। আমি বাঁচতে চাই না। তাই বিদ্যুতের টাওয়ারে উঠছি!”
দেরি না করে পাবড়ায় পৌঁছয় টহলদারি ভ্যান। পুলিশকর্মীরা দেখেন, বিদ্যুতের টাওয়ারের উপরে সত্যিই চড়ে বসেছেন এক জন। নীচে পড়ে মোবাইল ফোন। খবর পেয়েই ছুটলেন ওসি ত্রিগুণা রায়। ধমকে নেমে আসতে বলায় কাজ হল না দেখে অনুরোধ। চিঁড়ে ভেজেনি তাতেও। এ বার ঘটনাস্থলে এলেন বিপর্যয় মোকাবিলা দলের জনা পনেরো সদস্য। সময় বয়ে যাচ্ছে। রামনাথের দুঃখ ঘুচছে না। |
বিপদ বুঝে চলে আসেন রঘুনাথপুরের মহকুমাশাসক সুরেন্দ্রকুমার মিনা, এসডিপিও কুন্তল বন্দ্যোপাধ্যায়, পাড়া থানার ওসি নীলরতন ঘোষ এবং পাড়ার বিডিও সমীরণ বারিক। চলে এসেছে দমকল। আনা হয়েছে জোরালো সার্চলাইট, হ্যান্ডমাইক, অ্যাম্বুলেন্স।
উৎসাহী জনতার ভিড় বেড়েই চলেছে। “ওই ওই, ওই তো!”মাঝেমধ্যেই শোনা যাচ্ছে ভিড় থেকে। সবার চোখ উপরে। এক পুলিশকর্তা বিরক্ত হয়ে বললেন, “আদিখ্যেতা দেখ, যেন সূর্যগ্রহণ দেখছে!” মূল সমস্যা ছিল, পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশন ইন্ডিয়া লিমিটেডের (পিডিসিআইএল) ওই ৪০০ কেভি বিদ্যুতের টাওয়ারের বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ না করলে কী ভাবে ঝুঁকি নিয়ে উপরে উঠবেন বিপর্যয় মোকাবিলা দলের সদস্যেরা? আসরে নামলেন মহকুমাশাসক। পিডিসিএলের স্থানীয় কোনও অফিস নেই। তার উপর ওই টাওয়ারগুলি দিয়ে বিদ্যুৎ যাচ্ছে ঝাড়খণ্ডে। শেষে পটনা ও কলকাতায় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটির অফিসে যোগাযোগ করে যখন বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করা হল, তখন রাত আটটা ছাড়িয়েছে।
এর পরে টাওয়ারে চড়ল বিপর্যয় মোকাবিলা দল। দলের এক সদস্যের কথায়, “লোকটা যেন লুকোচুরি খেলছিল আমাদের সঙ্গে। প্রায় ১০০ ফুট উঁচুতে ওঠার পরেই দেখি, ও টাওয়ারের অন্য দিকে চলে গেল। আমরা সেদিকে গেলে আবার ফিরে আসছে আগের জায়গায়।” বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টার পরে রণেভঙ্গ দিল বিপর্যয় মোকাবিলা দল।
হ্যান্ডমাইক নিয়ে রামনাথকে নীচে নামতে ফের কাতর অনুনয় শুরু করলেন কর্তারা। কোনও লাভ হয়নি। শীতের রাতে ঠান্ডায় জমে হাত ফসকে নীচে পড়ার আশঙ্কাকে উড়িয়ে তখনও টাওয়ারের উপরেই বসে বছর আটত্রিশের ওই যুবক। এ দিকে দীর্ঘক্ষণ আন্তঃরাজ্য বিদ্যুৎ পরিবহণ লাইন বন্ধ রাখাও সম্ভব নয়। শেষ পর্যন্ত রাত ১২টা নাগাদ রামনাথ জানালেন, তিনি নীচে নামবেন। কিন্তু, সবাইকে সরে যেতে হবে। দাবি মানা ছাড়া উপায়ও ছিল না। রাত দেড়টায় নীচে নেমেই দে ছুট রামনাথের।
সোমবার সকালে অবশ্য পাবড়া গ্রামের বাড়ি থেকে রামনাথকে সাঁওতালডিহি থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। এসডিপিও বলেন, “পাঁচ বছর আগে নিজের বউকে কুপিয়ে খুন করার অভিযোগে মামলা চলছে রামনাথের বিরুদ্ধে। এখন জামিনে মুক্ত। মাঝে মধ্যেই মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। রবিবার টাওয়ারে ওঠার পিছনে সেটাই কারণ বলে মনে হচ্ছে।” আর থানায় বসে রামনাথের খেদ, “কিছুই ভাল লাগে না। কেউ আমাকে ভালবাসে না। কেউ দেখেও না।” “ওই দুঃখের চোটে শীতের রাতে খোলা মাঠের মধ্যে আমাদের রীতিমতো ঘাম ঝরিয়ে দিয়েছে।”—মন্তব্য এসডিপিও’র। |