এক সময়ে পরিবার থেকে হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া মানুষের খোঁজ মিলত গঙ্গাসাগর মেলায়। এ বার সন্ধান মিলল ব্রিগেডের সভায়।
১৯৯৪ সালে কংগ্রেসের ২১ জুলাইয়ের ব্রিগেড সমাবেশে যাবেন বলে তার আগের দিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে হারিয়ে যান পুরুলিয়ার পুঞ্চার বাসিন্দা বসন্তকুমার মাহাতো। ২০ বছর পরে এ বার তৃণমূলের ৩০ জানুয়ারির ব্রিগেড সমাবেশেই ফের পরিবারের সঙ্গে মিলন ঘটল তাঁর। বাড়ির স্মৃতি ভুলে এত বছর তাঁর কেটেছে নদিয়ার চাকদহে।
বাড়ির ছাড়ার সময় বসন্তবাবু ছিলেন যুব কংগ্রেসের পুঞ্চা ব্লক সভাপতি। সম্পন্ন কৃষিজীবী পরিবার। মা, স্ত্রী, দুই মেয়ে ও দুই ছেলে নিয়ে ভরা সংসার। ছোট ছেলের বয়স সবে তিন দিন। বড় মেয়ে বিষ্ণুপ্রিয়াকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাবেন বলে বেরিয়েছিলেন। সেখান থেকে ব্রিগেডের সভায় যাওয়ার কথা ছিল। তৃণমূলের পুরুলিয়া জেলা কার্যকরী সভাপতি সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বসন্ত সেদিন ব্রিগেডে গিয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকে এত বছর ওর আর কোনও খোঁজ মেলেনি।”
বসন্তবাবু নিজেও মনে করতে পারেন না, কী ভাবে তিনি বাড়ির কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন। কী ভাবে বিহারের গয়ায় গিয়ে পৌঁছন, তা-ও তাঁর মনে নেই। তবে সেখানেই তাঁর আলাপ হয় চাকদহের ইটাপুকুর এলাকায় বাসিন্দা রেলকর্মী প্রভাত রায়ের সঙ্গে। তবে তখন তিনি নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন মদন মাহাতো নামে। সেই নামেই এতদিন ইটাপুকুরের মানুষ তাঁকে চিনতেন। প্রভাতবাবু বলেন, “একদিন অফিসে হঠাৎ এসে হাজির হন তিনি। বাঙালি বলে আলাপ করেছিলাম। কথা বলে খুব ভাল লাগে। শিক্ষিত লোক। কিন্তু বাড়ির কথা ভুলে গিয়েছেন।” |
প্রভাতবাবু সেই অসহায় এবং প্রায় কপর্দকহীন যুবককে নিজের বাড়িও নিয়ে যান। বসন্তবাবু প্রভাতবাবুর ছেলেমেয়েদের পড়াতেন। ওই বাড়িতেই থাকতেন। আস্তে আস্তে পুরো পরিবারেরই আপনজন হয়ে যান তিনি। এলাকার মানুষও তাঁকে খুব পছন্দ করতেন।
কিন্তু নিজের পরিচয় মনে পড়েনি। প্রভাতবাবুর জামাই অধীর সর্দার বলেন, “পুরুলিয়ার কথা মাঝে মধ্যে বলতেন। কিন্তু অত বড় জেলার কোথায় তাঁর বাড়ি, তা জানাননি। তা ছাড়া, বাড়ির কথা তুলতেও চাইতেন না।”
প্রভাতবাবুর বাড়িতে থেকেই কয়েকজন ঠিকাদারের সুপারভাইজারের কাজ করতেন বসন্তবাবু। সেই ভাবেই তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়ে যায় রানাঘাটের বাসিন্দা পুরুলিয়ার কৃষি ও সেচ দফতরের ইঞ্জিনিয়ার পিনাকী ঘোষের সঙ্গে। সম্প্রতি পিনাকীবাবুর সঙ্গে গল্প করার সময়েই আচমকা তাঁর মনে পড়ে যায় পুঞ্চার কথা। পিনাকীবাবু বলেন, “তৃণমূল নেতা সুজয়বাবুর কথাও তিনি আমাকে বলেছিলেন। সুজয়বাবুর সঙ্গে আমারও আলাপ রয়েছে। তাঁকে সব কথা বলায় সুজয়বাবুই প্রথম ধরতে পারেন, মদনবাবু আসলে হারিয়ে যাওয়া বসন্তবাবুই।” সুজয়বাবুর কথায়, “পিনাকীবাবু যে বর্ণনা দিয়েছিলেন, তাতে আমি নিঃসন্দেহ হয়ে যাই, স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে বসন্তই এতদিন ধরে চাকদহে রয়েছে।”
এ বছর ২৪ জানুয়ারি সব কথা জানাজানি হওয়ার পরে বিষ্ণুপ্রিয়া ফোনে বাবার সঙ্গে কথা বলেন। তারপরে সিদ্ধান্ত হয়, তৃণমূলের ব্রিগেডের সভাতে যাবেন বসন্তবাবু। তৃণমূলের পুঞ্চা পঞ্চায়েত সমিতির সহসভাপতি কৃষ্ণপদ মাহাতোও সেখানে নিয়ে যান বিষ্ণুপ্রিয়াকে। বিষ্ণুপ্রিয়ার কথায়, “শহিদ মিনারের নীচে বাবার সঙ্গে দেখা হওয়ার পরে প্রথমে কেউ কাউকে চিনতে পারিনি।” সেই রাতেই পুঞ্চায় ফেরেন বসন্তবাবু। তাঁকে পেয়ে খুশির হাওয়া পরিবারের সকলের মধ্যে।
বসন্তবাবু বলেন, “বাড়ির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। পিনাকীবাবু পুরুলিয়ার কথা বলতে আমারও খাপছাড়া ভাবে কিছু কথা মনে পড়ে। এখনও সব কিছু মনে করতে পারছি না। বাড়ি ফিরতে পেরে ভাল লাগছে।” মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল বলেন, “সাধারণত এই লক্ষণগুলি ডিসোসিয়েটিভ রিঅ্যাকশন-এর মধ্যে পড়ে। এই জাতীয় মানসিকতাকে মনোবিজ্ঞান ফিউগ আখ্যা দেয়। ফিউগ প্রতিক্রিয়ায় স্মৃতিভ্রমের ধরন, হঠাৎ করে আত্মপরিচিতি ভুলে যাওয়া এবং নিজের বাসস্থান কিংবা পরিচিত সামাজিক গণ্ডি থেকে অন্য কোথাও চলে যাওয়া। হঠাৎ করে কিছু দেখে বা শুনে ফের নিজের আত্মপরিচিতি বা পরিচিত সমাজিক গণ্ডিতে ফিরে আসেন।” |