বিষ্ণুপ্রিয়ার ভিটেতে আজ উৎসবে মাতছে নবদ্বীপ
পাঁচশো বছরেরও আগের এক শ্রীপঞ্চমী তিথিতে নবদ্বীপে রাজপণ্ডিত সনাতন মিশ্রের গৃহে জন্ম হল এক অসামান্য সুন্দরী কন্যার। প্রতিমার মতো মুখশ্রী। সেই কন্যার নাম তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে রাখা হল বিষ্ণুপ্রিয়া। বিশ্বম্ভর মিশ্র বা নিমাই পণ্ডিতের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তাঁর। তিনি ছিলেন বিশ্বম্ভরের দ্বিতীয় স্ত্রী। চৈতন্যচরিতকারেরা জানিয়েছেন, সনাতন ধনী পণ্ডিত ছিলেন। তাঁকে রাজপণ্ডিত বলা হয়েছে। এই বিয়ে ঘটেছিল চৈতন্যের হিতৈষীদের বিশেষ আগ্রহে। অবশ্য ঘটকের মাধ্যমে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন শচীদেবী। বিয়ে হয়েছিল ধুমধাম করে এবং বরপক্ষের যাবতীয় ব্যয় বহন করেছিলেন বিশ্বম্ভরের পরমহিতৈষী বুদ্ধিমন্ত খান এবং মুকুন্দ সঞ্জয়। বিয়ের সময় আনুমানিক ১৫০৫ সাল। বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীর তখন বয়স আনুমানিক দশ বছর।
গৌর-বিষ্ণুপ্রিয়া মূর্তি। —নিজস্ব চিত্র।
এর বছর কয়েক পরে চব্বিশ বছরের নিমাই গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাস নিলেন। বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী তখন প্রায় পনেরো। স্বামী সন্ন্যাস নেওয়ার পর থেকে তিনি সেই যে নিজেকে চার দেওয়ালের অন্তরালে লুকিয়ে ফেলেছিলেন, আমৃত্যু বাইরে বের হননি। ইতিহাসও আশ্চর্য ভাবে নীরব থেকে গিয়েছে তাঁর সম্পর্কে। চৈতন্য জীবনীকারগণ সামান্য পংক্তির বেশি বরাদ্দ করেননি তাঁর জন্য। এমনকী জন্মভূমি নবদ্বীপও সে ভাবে স্মরণে রাখেনি বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীকে। অথচ জাহ্নবা বসুধা সহ নিত্যানন্দ বিগ্রহের পুজো দীর্ঘদিন ধরে হয়ে আসছে।
সব থেকে আশ্চর্যের বিষয়, নবদ্বীপের একেবারে পশ্চিমপ্রান্তে মালঞ্চ পাড়ায় বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর জন্মভিটেও তাঁরই মতো অনাদরে অবহেলায় উপেক্ষিত পড়ে আছে। পর্যটকেরা এসে খোঁজ করেন না। বেশি লোক এই শহরে মেলে না।
কিন্তু কেন এই নীরবতা?
এ বিষয়ে নবদ্বীপের প্রবীণ সংস্কৃতজ্ঞ শুভেন্দুকুমার সিদ্ধান্ত বলেন, “বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীর অন্তরাল সবটাই তাঁর স্বেচ্ছাকৃত। চৈতন্য জীবনীকারেরা তাঁর এই অন্তরালে থাকার বিষয়টিকে সম্মান দিয়ে, তাঁর কথা কোথাও সে ভাবে উল্লেখ করেননি।”
কথিত রয়েছে, চৈতন্যদেব সন্ন্যাস গ্রহণের পর বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীও প্রায় সন্ন্যাসীর মতোই কঠোর কৃচ্ছ্র সাধনের মধ্যে দিয়ে জীবনযাপন করতেন। রাত থাকতে গঙ্গার স্নান সেরে সারা দিন কৃষ্ণ নাম জপ করতেন। প্রতি বার জপের শেষে একটি করে চাল জমা করতেন পাত্রে। দিনান্তে ওই পাত্রে জড়ো হওয়া চাল দিয়ে একবার আহার করতেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চৈতন্য ঘনিষ্ঠ কেউ এলে পর্দার আড়াল থেকে তিনি কথা বলতেন। চৈতন্যদেবের বাড়ির খাস ভৃত্য ঈশান এবং শচীদেবী ছাড়া আমৃত্যু তিনি কারোর মুখ দর্শন করেননি।
মালঞ্চ পাড়ায় বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীর জন্মভিটেয় আটের দশকে গড়ে ওঠে বিষ্ণুপ্রিয়া সেবা সমিতি। স্থানীয় বাসিন্দা দীনবন্ধু কুন্ডু, হরিদাস সাহা, নিত্যানন্দ দেবনাথ প্রমুখের উদ্যোগে শুরু হয়েছিল বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীর ভিটে সংস্কারের কাজ। সেদিনের উদ্যোক্তাদের অন্যতম, বর্তমানে মন্দিরের সেবাইত বন্ধুস্মরণ দাস বলেন, “খুব অল্প কয়েকজনের চেষ্টায় একটু একটু করে গড়ে তোলা হচ্ছে বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীর জন্মভিটেকে ঘিরে একটা পরিমণ্ডল। মোট আঠেরো বিঘা জমি ছিল। এখন অবশিষ্ট আছে মাত্র ১৭ কাঠা। আমরা চাই নবদ্বীপে এখন যে দেশ-বিদেশের পর্যটকেরা আসছেন, তারা যেন বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীকে ভুলে না যান।”
নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব বলেন, “বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীর ওই পৈত্রিক ভদ্রাসন বহুকাল ভগ্নদশায় পড়েছিল। তারপর একটি ইটের বেদি আর টিনের ঘর তৈরি করে দেন কোনও ভক্ত।” মন্দিরের ফলক জানাচ্ছে ১৩৭৬ বঙ্গাব্দে কলকাতার বাসিন্দা কানাইলাল দত্ত এবং তাঁর স্ত্রী টুপুরানি দত্ত ওই বেদি আর ঘর তৈরি করে দিয়েছিলেন। এ বারই প্রথম বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীর জন্ম তিথি উদযাপন করার জন্য ৮ দিনের মেলার আয়োজন করা হয়েছে। পরিচালনায় বিষ্ণুপ্রিয়া উৎসব কমিটি। এ বিষয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া সেবা সমিতির সম্পাদক সুদেব দাস বলেন, “জন্মতিথিতে মহাপ্রভু মন্দিরের তরফ থেকে মহাপ্রভুর চরণ পাদুকা নিয়ে সংকীর্তন আসত। আমাদের পিতৃস্থানীয় কয়েক জন কাজটা শুরু করেন। আমরা সেই কাজটা আরও বড় আকারে করতে চাইছি। সেই উদ্দেশ্যেই এই গৌর-বিষ্ণুপ্রিয়া মিলন মেলার আয়োজন।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.