কথা ছিল, রাস্তার পাশে মঞ্চ বেঁধে জলসা হবে। কথা ছিল, একখানা মাত্র মাইক বাজবে। কথা ছিল, রাত ১০টায় বন্ধ হবে সেই মাইক।
কিন্তু শেষমেশ দেখা গেল, রাস্তা জুড়ে বাঁধা হল মঞ্চ। যে জন্য দুপুর থেকে বাস-অটোর রুট ঘুরিয়ে দেওয়া হল। যে জন্য দিনভর ভোগান্তি হল বহু মানুষের। গাঁক গাঁক করে বিশাল বিশাল বক্স বাজানো হল। তুমুল আলো আর শব্দে রবিবার রাত প্রায় পৌনে ১১টা পর্যন্ত সরগরম থাকল শ্রীরামপুরের ব্যস্ততম রাস্তা এনএস অ্যাভেনিউ। পুলিশ-প্রশাসনের নাকের ডগায় এমন কাণ্ড-কারখানা ঘটলেও তাঁরা সবটাই কার্যত না দেখার ভান করছেন। শ্রীরামপুরের এসডিপিও রাজনারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের স্বীকারোক্তি, “অনুষ্ঠানে যা ভিড় হয়েছিল, ব্যবস্থা নিলে আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা হত।” কিন্তু রাস্তা পুরোপুরি আটকে মঞ্চ বাঁধার অনুমতি দেওয়া হল কেন? কেনই বা বেশি রাত পর্যন্ত মাইকের শব্দে ভুগতে হল স্থানীয় মানুষজনকে? কেনই বা একখানা মাত্র মাইকের অনুমতি নিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে বিশাল অনুষ্ঠানে অসংখ্য বক্স-মাইক বাজানো হল? নিরুত্তর পুলিশ-প্রশাসন কিংবা পুরসভার কর্তারা। এসডিপিও শুধু বলেন, “বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে।”
কিন্তু সেই তদন্তের গতিপ্রকৃতি নিয়ে বিন্দুমাত্র ভরসা নেই এলাকাবাসীর একাংশের। তাঁদের বক্তব্য, “প্রশাসনের মেরুদন্ড সোজা থাকলে রাস্তা আটকে এ ভাবে মঞ্চ বাঁধার অনুমতিই দেওয়া হত না।”
তা হলে অনুমতি মিলল কোন ম্যাজিকে?
শ্রীরামপুরের ৭ নম্বর ওয়ার্ড কমিটির উদ্যোগে ওই অনুষ্ঠানের মূল হোতা স্থানীয় তৃণমূল নেতা পাপ্পু সিংহ। তাঁর স্ত্রী প্রমিলা আবার কাউন্সিলর। কর্তা-গিন্নির দাপটেই অনুষ্ঠান হয়েছে নির্বিঘ্নে, জানাচ্ছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই। অন্য দিকে, জেলা যুব তৃণমূল সভাপতি দিলীপ যাদব বলেন, “শ্রীরামপুরের অনুষ্ঠানের ব্যাপারে খোঁজ নেব। দলের কেউ থাকলে কথা বলব। দলনেত্রীর কড়া নির্দেশ আছে, যে কোনও স্তরের কর্মী এবং নেতাকে নিয়ম মানতেই হবে। আমরা নেত্রীর সেই নির্দেশ যেন ভুলে না যাই।”
রাস্তার একাংশ আটকে জলসা বা পুজো এ রাজ্যে নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু ব্যস্ত রাস্তা প্রায় দিনভর পুরোপুরি আটকে অনুষ্ঠান করার নজির বিশেষ নেই। বিশেষ করে শ্রীরামপুরে ওই অনুষ্ঠান মঞ্চের খুব কাছেই যেখানে পুলিশ-প্রশাসনের একগুচ্ছ আধিকারিকের অফিস। তাঁদের ভূমিকা নিয়ে স্বভাবতই উঠছে প্রশ্ন। পাশাপাশি কোথাও আবার পুলিশের অতি সক্রিয়তাও চোখে পড়ার মতো।
সোমবার শ্রীরামপুরেরই বটতলায় ডিওয়াইএফের কর্মসূচি থেকে মাইক বাজেয়াপ্ত করেছে পুলিশ। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে শাসক দলের নেতাদের স্বজনপোষণ-সহ নানা অভিযোগে এ দিন সকালে বটতলায় পথ অবরোধ করে ডিওয়াইএফ। অভিযোগ, মিনিট কুড়ি পরেই মাইক তুলে নিয়ে যায় শ্রীরামপুর থানার পুলিশকর্মীরা।
ডিওয়াইএফের জেলা সম্পাদক তীর্থঙ্কর রায় বলেন, “তৃণমূল রাস্তা বন্ধ করে নাচগান করলে সেটা গণতন্ত্র। আর আমরা লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের প্রশ্ন নিয়ে আধ ঘণ্টার জন্য রাস্তায় নেমেছি বলে পুলিশ অতি তৎপর হয়ে মাইক দু’টো নিয়ে গেল।” মহকুমা পুলিশের এক কর্তার ব্যাখ্যা, “আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা হতে পারত বলেই মাইক বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
রবিবার শাসকদলের নেতা-নেত্রী এবং পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের একাংশের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানের জন্য এলাকার গোটা ৫০টি দোকানেও ঝাঁপ ফেলতে বাধ্য হন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু শ্রীরামপুর শহরে যে কোনও মাঠেই তো বিধিবদ্ধ অনুমতি নিয়ে অনুষ্ঠনটি হতে পারত। বিরোধীদের একাংশের ব্যাখ্যা, ক্ষমতা প্রদর্শনই ছিল এর আসল উদ্দেশ্য।
প্রশাসনের এক কর্তা জানাচ্ছেন, রবিবার বাস-অটো ধরতে নাকাল হতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। শ্রীরামপুর-বাগবাজার ৩ নম্বর রুটের এক বাসমালিক বলেন, “রবিবার সকাল থেকেই আমাদের স্টেশন-সংলগ্ন জায়গার পরিবর্তে কোর্টের সামনে থেকে বাস ছাড়তে হয়।” ৩ নম্বর বাস শ্রমিক কর্মচারী সংগঠনের সভাপতি তথা তৃণমূল নেতা অন্বয় চট্টোপাধ্যায়ও বলেন, “একটা অনুষ্ঠান চলায় কোর্টের সামনে থেকে বাস চালাতে হয়েছে।”
কী বলছেন পাপ্পু নিজে?
তাঁর অবশ্য যুক্তি, “বাস-অটোর রুটও ঘোরানো হয়নি। অনুষ্ঠানের জন্য কারও কোনও অসুবিধা হয়নি। দোকান বন্ধ ছিল না। ব্যবসায়ীরা পরিবার নিয়ে অনুষ্ঠান দেখেছেন। সবাই খুব উপভোগ করেছেন।” পুরসভার এক চেয়ারম্যান ইন কাউন্সিল আবার বলেন, “মানুষকে আনন্দ দিতেই অনুষ্ঠান। তবু যদি কারও অসুবিধা হয়ে থাকে, আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।”
কিন্তু যাঁদের কাছে ক্ষমা চাওয়া হল, তাঁরা আড়ালে যতই নিন্দে করুন না কেন, সামনে মুখ খুলছেন না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শহরবাসীর কথায়, “যেখানে পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারাই মুখে কুলুপ এঁটেছেন, আমাদের ঘাড়ে আর ক’টা মাথা!” |