আদিবাসী ছেলেমেয়েরা যে ভাবে একটা স্বীকৃত সামাজিক মূল্যবোধের শরিক হত, সেটা বিলীয়মান।
শিক্ষাহীন, মূল্যবোধহীন এক অক্ষমতা নিয়ে জীবিকার সন্ধানে নেমে তারা এক নৈতিক ডামাডোলের মধ্যে পড়ে।
বড় বাস্কে |
২০১০ সালে মল্লারপুর এলাকায় বছর কুড়ির একটি সাঁওতাল মহিলাকে নগ্ন করে জনসমক্ষে হাঁটতে বাধ্য করেছিলেন সেই গ্রামেরই কিছু স্বঘোষিত মাতব্বর। এক জন সাঁওতাল হিসেবে সে ঘটনার লজ্জা ও গ্লানি অনেকের মতো আমার মন থেকেও এখনও মুছে যায়নি। সুবলপুর গ্রামের ঘটনা সেই ক্ষতে যেন নুনের ছিটে দিল। ‘শাস্তি’ হিসেবে গণধর্ষণের অভিযোগের সত্যাসত্য বিচার চলতে থাকবে। কিন্তু এতে যদি এক কণাও বাস্তব থাকে, তবে এটি এক ভয়ংকর সূচনার ইঙ্গিত। অমানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় নিয়ে সাঁওতাল সমাজের মধ্যে গভীর ভাবে চিন্তন করার সময় তো এসেইছে, অন্যদেরও এটা নিয়ে ভাবতে হবে। |
প্রশ্ন জাগে, তা হলে কি শত শত বছর ধরে চলে আসা আমাদের সমাজ পরিচালন ব্যবস্থার মূল স্তম্ভ ‘মাঁঝি পারগানা’ ব্যবস্থা, যা সাধারণত গ্রামের পাঁচ জনকে নিয়ে পরিচালিত হয়, তা কি আধুনিক সমাজে প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে? এ বিষয়ে এখানে পরিষ্কার করা ভাল যে, ‘খাপ পঞ্চায়েত’ বা যাকে ‘সালিশি সভা’ যাকে বলা হচ্ছে, তার সঙ্গে সাঁওতালদের চিরাচরিত গ্রাম্য আলোচনা সভা বা ‘কুলহি দুড়ুপ’-এর আসমান-জমিন ফারাক। মাঁঝি পারগানা ব্যবস্থায় আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় গ্রামের প্রধানের উপস্থিতিতে। শুধু আদিবাসী সম্প্রদায়ের সদস্যরাই উপস্থিত থাকেন। পারস্পরিক গ্রাম্য সভার কোনও সমস্যা ভোটাভুটি দিয়ে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার নিরিখে সমাধান করা হয় না, হয় সভায় উপস্থিত সকল সদস্যের ঐকমত্যের ভিত্তিতে। ফলে, স্বভাবতই আদিবাসী সমাজের সভায় আলোচনা দীর্ঘায়িত হয়, যা প্রয়োজনে দু’তিন দিন, এমনকী কয়েক সপ্তাহ চলতে পারে। সমাধানটাও এক জন দোষী, অন্য জন দোষী নয় এই রকম কোনও সিদ্ধান্তের রূপ নেয় না। বরং সমস্যা তৈরির জন্য দু’পক্ষই দোষী, এটা মনে নিয়ে কে কম দোষী, কে বেশি, সেটা সাব্যস্ত করে ইতি টানা হয়, সেই অনুযায়ী শাস্তিবিধান হয়। কোনও এক পক্ষ যদি সভার সিদ্ধান্তে সহমত পোষণ না করেন, তা হলে অন্যান্য গ্রামের প্রধান ও লোকেদের নিয়ে তিনি আবার আলোচনার দাবি করতে পারেন। তার পরেও যদি তিনি সকলের সিদ্ধান্ত মানতে অস্বীকার করেন, তবে প্রচলিত শাস্তি হিসেবে ‘বিটলাহা’ (একঘরে) করার প্রচলন আছে, গ্রামের লোকেরা তাঁর সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এই সকল সিদ্ধান্ত গ্রামের প্রধানরা কখনও একা নেন না, উপস্থিত সকল সদস্য যেটাতে সহমত হন, তিনি তাকেই মান্যতা দেন।
সুবলপুর গ্রামের ‘সালিশি সভা’ কিন্তু কয়েক ঘণ্টায় সমাপ্ত হয়েছিল। সে আলোচনায় ২৫ হাজার টাকা জরিমানার দাবি উঠেছে, তা না দিতে পারার অপরাধে মহিলার উপর যৌন অত্যাচারের আদেশ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। এ নিয়ে সুবলপুর গ্রামের কিছু বাসিন্দাকে প্রশ্ন করলে তাঁরা বললেন, গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য যাঁরা সভায় উপস্থিত ছিলেন ও নাম স্বাক্ষর করেছেন, তাঁরা তো ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ। তাঁরা এ রকম আদেশ কী ভাবে মেনে নিলেন! তাঁদের বক্তব্য, বিতর্কিত সালিশি সভা সাঁওতালদের নিয়মে হয়নি, তাকে আমাদের আসল গ্রাম সভা বা ‘কুলহি দুড়ুপ’ বলা যায় না।
বর্তমানে অনেক গ্রামেই কিছু স্বার্থান্বেষী মুরুব্বিরা অশিক্ষা ও কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে ডাইনি সন্দেহে কোনও পরিবারকে গ্রাম থেকে বিতাড়িত করা, মহিলাদের পিটিয়ে মারা এবং স্বামী-স্ত্রী বিবাদে মহিলার অধিকারকে লঘু করে দেখার মতো জঘন্য ঘটনায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িয়ে পড়েছেন। যখনই এ রকম কোনও ঘটনা খবরে আসে, তখনই অনেকে সঙ্গে সঙ্গে আদিবাসীদের চিরাচরিত জীবনযাত্রা বা সমাজব্যবস্থাকেই দায়ী করেন। কিন্তু সমস্যাগুলিকে এত সরলীকরণ করলে গোড়ায় গলদ ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই সমস্যাগুলির সঙ্গে সম্প্রদায়ের ভেতর ও বাইরের আর্থিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নানা কারণ জড়িয়ে আছে।
লক্ষণীয়, আদিবাসী সমাজের যারা এই রকম অসামাজিক ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কাজে লিপ্ত হচ্ছে, তাদের বেশির ভাগের বয়স কুড়ি-পঁচিশের মধ্যে। এই সমাজের ছেলেমেয়েদের সামনে আধুনিক শিক্ষার সুযোগ এতটাই সীমিত যে, খুব কম অংশই লেখাপড়া শেষ করতে পারে। আবার, পুরনো দিনে যে-ভাবে শৈশব থেকে পারিবারিক ও সামাজিক ভাবে তারা প্রশিক্ষিত হত, নিজেদের একটা স্বীকৃত সামাজিক মূল্যবোধের শরিক করে নিত, সেটাও ক্রমবিলীয়মান। সেই ছেলেমেয়েরা শিক্ষাহীন, মূল্যবোধহীন এক অক্ষমতা নিয়ে জীবিকার সন্ধানে খাদানে, ইটভাটায়, ভিন জেলায় খাটতে যায় কিংবা শহরে জোগাড়ের কাজ বা বাবুদের ঘরে রান্না করার মতো কাজে নামে, নতুন এক জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে, যার জন্য তারা তৈরি থাকে না। কম খেটে সহজ পথে বেশি টাকা রোজগার করে অনুকরণপ্রসূত ফুর্তির নেশায় মজে যায়। এই রকম বিচারসভাকে তারা বিনা রোজগারের টাকায় মৌজ-মস্তি করার সুযোগ হিসেবেই দেখে। গ্রামের বয়স্ক, অভিজ্ঞ ও মুরুব্বিগণ যেন নব প্রজন্মের সংস্কৃতির কাছে বড় অসহায়। নতুন আর পুরনোর মাঝে যে শিক্ষা, সেটা আমরা দিতে পারিনি।
আদিবাসী সমাজে বহিরাগতদের অত্যধিক অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপও অনেক সমস্যার কারণ। সাঁওতালদের সবচেয়ে কাছের ও আবেগের সম্পদ হচ্ছে তাদের মেয়েরা, তাদের পরিবার, তাদের জমিজিরেত। আদিবাসীদের সরলতা ও দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে যেমন বেনামে জমিজায়গা কেড়ে নেওয়ার খেলা চলে, তেমনই খেতখামারে, হাটেবাজারে আদিবাসী মহিলাদের সহজলভ্য পণ্য হিসেবেই মনে করেন এক শ্রেণির মানুষ। তথাকথিত শিক্ষিত সমাজেও এর ব্যতিক্রম নেই। শহরের বিভিন্ন হোটেলে, রিসর্টে, রাজপথে এমনকী ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানেও অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য আদিবাসী মহিলাদের ভাড়া করে আনা হয় নাচগান করানোর জন্য। গানে, গল্পে, কবিতায়, সিনেমার পর্দায় অনেকের কাছে আদিবাসীরা রোম্যান্টিক অনুপ্রেরণা। এর পেছনে অনেক যুক্তি থাকতে পারে। কিন্তু শেষ বিচারে মনে হয় এটা অন্যায়।
সুবলপুরের ঘটনা আমাদের কয়েকটা প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। আদিবাসী সমাজের প্রতি বহিরাগতের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপের ফলেই কি তাদের মধ্যে এই উগ্র চেতনার জন্ম দিচ্ছে? কেন তারা মূল স্রোতের মানুষদের সন্দেহের চোখে দেখে? কেনই বা তারা প্রশাসনকে ভয় পায়? |