আর, আগামী কাল যখন ব্যাপক আদিবাসী অঞ্চলে কয়লা খাদান করার চেষ্টা হবে,
অবশিষ্ট জঙ্গল নিশ্চিহ্ন করে, গ্রামের পর গ্রাম গুঁড়িয়ে, মেয়েদের গণধর্ষণের জন্য উন্মুক্ত
করে দেওয়া হবে, উৎসাহী দেশি-বিদেশি মিডিয়াকুলকে তখন পাওয়া যাবে তো?
জয়া মিত্র |
বীরভূমের লাভপুরের কাছে ছোট আদিবাসী গ্রামে ঠিক কী যে ঘটেছে, সেটা এখনও সম্পূর্ণ পরিষ্কার নয়। হয়তো কোনও দিনই সম্পূর্ণ পরিষ্কার হবে না। কিন্তু ঘটনার যে বিবরণ প্রচারিত হচ্ছে তার সামনে সমস্ত ‘সভ্য’ সমাজের আত্মধিক্কারে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ানোর কথা। কিংবা আজকের এই ঘটনাসন্ধানী মিডিয়া-পায়ী সমাজ সেই সংবেদনশীলতা হারিয়ে ফেলেছে, শোকের সামনে বুম-ই প্রধান হয়ে উঠেছে, এবং টিভি ফ্লোরের চেয়ার। যত দিন ধরে আদিবাসী মানুষদের মনে তাঁদের সমাজের স্মৃতি আছে, সেখানে ধর্ষণের ইতিহাস নেই। যখন থেকে ‘দিকু’রা কাছাকাছি, তখন থেকেই আদিবাসী মেয়ের ধর্ষণ। কিন্তু তাদের নিজেদের সমাজে এই ঘটনা ঘটে না। আজ যদি এ-রকম ঘটে থাকে, তার দুটি কারণ স্পষ্ট। শহুরে জীবনের বহিরঙ্গ চমকানি ওই সমাজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং অবশ্যই আছে রাজনৈতিক দলাদলি সংগঠিত করার ইতিহাসও। |
মিডিয়ার সামনে। সুবলপুর, বীরভূম, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪। ছবি: এ পি। |
আদিবাসী সমাজ কোনও স্বর্গে বাস করে না। গত দু’তিন দশক ধরে রাজনৈতিক পার্টির ক্ষমতা বাড়ানোর নামে দূর পর্যন্ত গ্রামে অপরাধীদের ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে, তা কোনও গোপন বিষয় নয়। আদিবাসী গ্রাম সেই কালো গল্পের বাইরে এক পরম শুদ্ধ ‘আদিবাসী সরলতা’য় রয়ে যাবে, এমন কি হতে পারে? কয়েক বছর আগে রেশন ব্যবস্থা নিয়ে, একশো দিনের কাজ নিয়ে, অন্যের জমি ঠকিয়ে নেওয়া নিয়ে আন্দোলন চলা কালে আদিবাসী অঞ্চলগুলোয়, বিশেষ করে বীরভূমে তীব্র দুর্নীতি ও অনিয়মের কথা কি প্রকাশ্যে আসেনি? এমনকী সাঁওতাল সমাজের চিরকাল-মান্য ‘মাঝি-হাড়াম’ প্রথাকে কী ভাবে বিকৃত করে এক দল আদিবাসীকে শক্তিমান ও দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলে ‘দিকু’ সরকারি পার্টি কর্মীরা আদিবাসী গ্রামে নিজেদের ক্ষমতা কায়েম রেখেছিল, সে কথা যাঁরা জানার তাঁরা জানেন। যে জমির অধিকার মাঝি-হাড়াম পদটির সঙ্গে যুক্ত, আদিবাসী সমাজের সকল বিধি লঙ্ঘন করে দিকু পার্টি-ক্যাডাররা কয়েক জন লোভী বা ভিতু মাঝি-হাড়ামের ব্যক্তিগত নামে সেই জমির দলিল করিয়ে দিয়ে গ্রামের পর গ্রামে সমাজের অশেষ ক্ষতিসাধন করেননি? রাষ্ট্রের যে শহুরে সাংস্কৃতিক ব্যবস্থায় এক বিরাট সংখ্যক দেশবাসীকে ‘পিছিয়ে পড়া শ্রেণি’ বলে চিহ্নিত করা হয়, সেখানে আশ্চর্যের কী আছে যে, ‘পিছিয়ে পড়া’রা যথাসম্ভব দ্রুত ‘উন্নত’ ধরনধারণ আয়ত্ত করতে, অন্তত নকল করতে চেষ্টা করবে? সেই নকল করানোর প্রয়াসেরও কোনও ত্রুটি কোথাও দেখা যায় না। মুণ্ডা, হো কিংবা সাঁওতাল গ্রামে ফরসা হওয়ার ক্রিমের বিক্রি কম নয়। ঠিক যে রকম কম নয় ভিডিয়ো হল। প্লাস্টিক প্যাকেট, গা দেখানো পোশাক, গলায় চেন পরা মোটরবাইক হাঁকড়ানো যুবক, আর পিছনের সিটে আঁকড়ে বসা তরুণীও বিরল নয়।
লাভপুরের একটি মেয়ে মাত্র ধর্ষিত হয়নি, ধর্ষিত হয়েছে প্রাচীন আদিবাসী সমাজ। হ্যাঁ, এই সমাজে সমাজের বাইরের বিয়ের বিরোধিতা করা হয়। কোন সমাজে করা হয় না? কোটিপতির মেয়ে অন্য জাতের গরিব ছেলেকে বিয়ে করলে সেই ছেলেকে খুন করে ফেলে দেওয়া হয় না? সমাজ-নির্দিষ্ট বিধি-নিয়ম না মানলে অন্য সমাজের মতোই আদিবাসী সমাজও শাস্তি দেয়। জরিমানা দিতে হয়েছে, গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছে, শোনা যায় এক সময় পাথর ছুড়ে মারাও হয়েছে। এর কোনওটাই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু এই সমর্থন-অযোগ্য কাজ যখন ‘উন্নত’ সমাজে প্রতি দিন ঘটে? সে সব ক্ষেত্রে কি জাতীয়, এমনকী আন্তর্জাতিক মিডিয়া এ ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে?
আদিবাসী মানুষদের জীবন প্রতি দিন সেই জীবনযাপনের আশ্রয় চ্যুত হতে বাধ্য হয়েছে। অত্যন্ত কৃষিকুশল, কৃষিজ্ঞানসম্পন্ন যে হাজার হাজার মানুষ সমগ্র পূর্ব ভারতের কৃষিক্ষেত্র সামাল দিয়ে ফসল তুলতেন, সামান্য জীবনেও সংস্কৃতির চর্চা যাঁদের কাছে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মতোই সহজ ছিল, তাঁরা বাধ্য হয়েছেন ইটভাটার নরকে, স্পঞ্জ আয়রন বা অ্যালয় স্টিল কারখানায় চূড়ান্ত অমর্যাদায় অ-মানবিক অবস্থায় দিন কাটাতে, প্রোমোটার সাম্রাজ্যে, পাথর খাদানে, কয়লা খাদে, চুনভাটিতে দৈনন্দিন জীবন্মৃত থাকাকে মেনে নিতে। সেই জীবনে মেয়েদের নিত্য লাঞ্ছনার কথাও প্রকাশ্য সেই জীবনের প্রসাদে যৌন রোগে আক্রান্ত আদিবাসী গ্রামগুলোয়। এই অমর্যাদা কি ক্রমাগত ধর্ষণ নয়? আদিবাসী মানুষ বাঁচেন নিজেদের সমাজের মধ্যে। সেই সমাজ সুস্থিত থাকে তার প্রাকৃতিক পরিবেশের ঘনিষ্ঠ সামঞ্জস্যে। তাঁদের পালা-পুজো-পার্বণ, শোক-দুঃখ-আনন্দ, বিপদ-বিপর্যয়-সংকট সব কিছু এই ব্যক্তি সমাজ প্রকৃতির শৃঙ্খলায় বাঁধা। সেই পবিত্র বন, জলের উৎস, খাদ্য পানীয়ের সম্ভার নষ্ট হলে আদিবাসী সমাজ ঠিক ততখানিই বেআব্রু, অসহায় হয়ে পড়ে, যেমন এক জন ব্যক্তি অসহায় হন তাঁর জামাকাপড় কেড়ে নিলে। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর আমার দেশবাসী এক বিরাট জনসমাজের ওপর এই ধর্ষণ চলছে। বহু বার তাঁরা নিজেদের মতো করে বলবার চেষ্টা করেছেন। তখন কোথায় ছিল নাগরিক মনোযোগ? তখন কোনও প্রতিবাদ, কোনও ধিক্কার উথলে ওঠেনি। কারণ, তা হলে আত্মধ্বংসী, জনবিরোধী এই উন্নয়ন-পথকে প্রশ্ন করতে হত। একটি সমাজ-সংস্কৃতি চোখের সামনে লাঞ্ছিত, লঙ্ঘিত হতে থাকলে যদি অন্য দিকে তাকিয়ে থাকি, তা হলে তার একটি অংশকে নিয়ে হঠাৎ উচ্চণ্ড নাটকীয়তা তৈরির নৈতিক অধিকার থাকে কি?
তা ছাড়া, ওই প্রথম প্রশ্নটায় ফিরতেই হয়। কে নিশ্চিত জানে যে, এখানে কী ঘটেছে? আশপাশ থেকে শোনা যাচ্ছে সে দিন ওখানে অনেক দিকুর উপস্থিতির কথা। কেন উঠছে ‘সালিশি সভা’, ‘মোড়ল’-এর মতো রাজনৈতিক শব্দ? সাঁওতাল সমাজে কোনও মোড়ল নেই। থাকেন মাঝি হাড়াম। সালিশি সভা হয় না। ষোলো আনার বৈঠক হয়। যাঁদের সম্পর্কে লেখা হচ্ছে, তাঁদের সমাজ-সংস্কৃতি সম্পর্কে কিছু না জেনে কত দূর যাওয়া যায়, তার আরও উদাহরণ আসছে। মেল-এ স্বাক্ষর অভিযানে নেমে পড়েছেন কিছু ‘দুর্দশা’ সন্ধানকারী। এঁরা ‘খাপ পঞ্চায়েত’-এর কথাও তুলছেন এবং নতুন উপলক্ষ পাওয়ার উচ্ছ্বাসে বলে ফেলছেন, ‘আমরা দিল্লিতে এ রকম প্রোগ্রাম করেছি, এ বার পশ্চিমবাংলায় সুযোগ এসেছে। লেট আস নট মিস দ্য চান্স’। কে এঁদের অধিকার দিয়েছে আদিবাসীর প্রাচীন সর্বমান্য সামাজিক ব্যবস্থাকে ‘খাপ পঞ্চায়েত’ বলতে? আদিবাসী সমাজ কি এঁদের কাছে কোনও মিনতি জানিয়েছিলেন ‘উদ্ধার করা’র জন্য?
আর, আগামী কাল যখন ব্যাপক আদিবাসী অঞ্চলে কর্পোরেট কয়লা খাদান করার চেষ্টা হবে, অবশিষ্ট জঙ্গল নিশ্চিহ্ন করে, গ্রামের পর গ্রাম গুঁড়িয়ে, এলাকার আদিবাসী মেয়েদের গণধর্ষণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে, উৎসাহী দেশি-বিদেশি মিডিয়াকুলকে তখন পাওয়া যাবে তো? না কি আদিবাসীরা কত বর্বর, কত পিছিয়ে পড়া, সেই কথা আর এক বার মশলা-সহ পরিবেশন হয়ে যাওয়ার পরই, উৎসাহী নাগরিক মন আবার উদাসীন কোকিলের দিকে কান ফেরাবেন? |