আধুনিক সমাজের আদিম অত্যাচারগুলো আদিবাসী সমাজের কিছু আদিমতার সঙ্গে মিলেমিশে
এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যা শুধু আদিবাসীদের পক্ষেই নয়, সকলের পক্ষেই দুঃস্বপ্নের।
মুন্নী হেমব্রম |
বীরভূমের সুবলপুর কলকাতা থেকে যত দূরে, দুমকা জেলায় আমার গ্রামটা থেকে কিন্তু তা ততটা দূর নয়। তবু কলকাতার লোকরা সুবলপুরের ঘটনাটা নিয়ে যতটা জেনেছেন, আমি তার চেয়ে অনেক কম জেনেছি। কেননা, আমাদের এখানে হিন্দি ভাষার সংবাদপত্রগুলোতে এ বিষয়ে খুব বেশি কিছু লেখা হয়নি। অবশ্য সেখানকার সাঁওতাল মেয়েটার উপর যে হাড়হিম করা অত্যাচার সংঘটিত হল, তার কথা এখানকার সাঁওতাল মেয়েরা জানতে পারত না, যেমন বোধ হয় জানতে পারেনি পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর-বাঁকুড়া কিংবা ওড়িশার ময়ূরভঞ্জের সাঁওতাল মেয়েরা এবং পুরুষরাও। কারণ নিরক্ষতার ইতিহাস-ভূগোল, সাঁওতাল সমাজে এখনও যার মাত্রা ভয়াবহ। সৌভাগ্যক্রমে কিছুটা লেখাপড়া করেছি, খানিকটা সেই সুবাদে নানান সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুযোগ হয়েছে, এবং সেই ক্রমে খবরাখবর পাওয়ার সুবিধা বেশ খানিকটা ভোগ করতে পারি। ঘটনাটা যতটুকু জানতে পেরেছি তাতে কিছু সাধারণ কথা বলা যায়, এবং সেটা বোধ হয় দরকারিও বটে। |
ঘটনাটা গণধর্ষণের, যদিও গণধর্ষণ ও ধর্ষণের পার্থক্যটা বোধগম্য নয়। এক বার ধর্ষিতা হওয়ার অভিজ্ঞতাই এক জনের জীবনে যে বিষ মাখানো তির গেঁথে দেয়, তার জ্বালা সারা জন্ম ধরে জ্বালাতে থাকে; গণধর্ষণে বড়জোর তার মাত্রা বাড়ে, কিন্তু জ্বালাটা তো জ্বালাই। ধর্ষণের অপরাধটা তাই নরহত্যার চেয়েও বড়। ধর্ষণের অভিজ্ঞতার তীব্র যন্ত্রণা, এ মেয়েটির ক্ষেত্রে অধিকতর তীব্র: যারা এ কাজটা করেছে, তারা এমনটা করতে পারে বলে সে দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি। কেননা, তারা তারই স্বজন। মেয়েটি নিহত বিশ্বাস নিয়ে বাঁচবে কী করে?
দিকু অর্থাৎ বাইরের মানুষরা আদিবাসী মেয়েদের উপর চিরকালই নিপীড়ন করে এসেছে; সে অভিজ্ঞতায় আদিবাসী মেয়েরা দিকুদের কাছ থেকে সুরক্ষিত থাকার চেষ্টা অন্তত করে, সাবধান থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু, সাঁওতাল সমাজে যেহেতু ধর্ষণ কল্পনাতীত একটা ব্যাপার, মেয়েটি এক বারও হয়তো ভাবেনি যে, অন্যের কোনও ক্ষতি না করে, তার একান্ত একটা ব্যক্তিগত ইচ্ছাপূরণ নিজের পছন্দের লোকের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার অপরাধে, তারই স্বজাতীয়রা, যাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক সামাজিক আত্মীয়তার, তারাই তার উপর শেয়াল-কুকুরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে।
কিন্তু, অন্তত সংবাদ বলছে যে, এমনটাই ঘটেছে, এবং এই বাস্তবতা বিষয়ে আমরা চোখ-কান বন্ধ রাখতে পারি না। আমার আরও আশঙ্কা, আজ যেটা বীরভূমে ঘটল, কাল সেটা ময়ূরভঞ্জ বা পাকুড়ে ঘটতে পারে, ঘটতে পারে মালদা বা কোকরাঝাড়ে। যে বিস্তীর্ণ প্রান্তে সাঁওতালদের বসবাস, তার যে কোনও জায়গাতেই এমনটা হতে পারে। কারণ, প্রাচীন যে সব মূল্যবোধ আমাদের সমাজে গড়ে উঠেছিল, নানান চাপ ও প্রভাবে সেগুলো বদলে যাচ্ছে, ভেঙে যাচ্ছে। সাঁওতালসহ অন্য আদিবাসীরা এক সময় যে সামাজিক স্বাতন্ত্র্য ভোগ করতে পারতেন, যার মধ্যে তাঁদের মূল্যবোধগুলো রক্ষিত হত, তেমন বিশুদ্ধতা রক্ষা করা আজকের দিনে সম্ভব নয়। ফলে ভিন্ন মতের প্রতি সম্মান, নারীপুরুষ সম্পর্ক বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান, ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক বিষয়ে পরিষ্কার বিধান, ইত্যাদি যে সব গুণাবলির জন্য আদিবাসী সমাজগুলোকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সুবিকশিত উদাহরণ মানা হত, সেইগুলো তাদের আদি রূপে আর ঠিকতে পারছে না। কেননা, সমাজব্যবস্থায় নানান অবশ্যম্ভাবী প্রভাব পড়ছে, মিশ্রণ ঘটছে, সন্দেহ নেই। এই সব প্রভাবের মধ্যে ভালর চেয়ে মন্দের ভাগ অনেক বেশি; কিন্তু তা বলে এগুলোকে আটকানোও তো যাবে না। অর্থনৈতিক চলাচলের ভেতর দিয়ে, দেশের রাজনীতির হাত ধরে আদিবাসী সমাজগুলোর ভেতরও বদল ঘটে যাচ্ছে। এর মধ্যে অবশ্যই অনেক বদল অন্যায় ভাবে ঘটানো জমি, জঙ্গল, প্রকৃতির উপর আদিবাসী অধিকারগুলোকে সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দিয়ে, তাঁদের ও দেশের অন্যান্যদের মতো হতে বলা হচ্ছে। কিন্তু তেমনটা হওয়ার কোনও সুযোগ তাঁদের সামনে নেই। বলা হচ্ছে, তোমরা কুসংস্কারমুক্ত হও, আধুনিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আওতায় এসো, কিন্তু সে সুযোগ তার সামনে নেই মজুরি করে কোনও ক্রমে অন্যান্যদের চেয়ে অনেক সংক্ষিপ্ত জীবন কাটানোই যেন তার ভবিতব্য। দিনে দিনে আদিবাসীদের অবস্থা খারাপ হচ্ছে; সামনে কোনও দিশা নেই, আশা নেই।
এই আশাহীনতা থেকে এক দিকে যেমন জন্ম নিচ্ছে ‘আধুনিক’ সমাজের অনুকরণ, এবং তার ফল হিসেবে ‘আধুনিক’ উপায়ে সেই অনুকরণ চরিতার্থ করার চেষ্টা, তেমনই আবার প্রকট হয়ে উঠছে আদিবাসী সমাজের ভিতরকার কিছু খারাপ পরম্পরা। আদিবাসী মূল্যবোধের সব কিছু তো ভাল নয়; যেমন মেয়েদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি আদিবাসী মেয়েরা যতই অন্যদের চেয়ে অধিক স্বাধীনতা ও সম্মানের অধিকারী হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত কিন্তু তারাও ‘জিনিস কানা কু দ্রব্য মাত্র’। আধুনিক সমাজের আদিম অত্যাচারগুলো আদিবাসী সমাজের কিছু আদিমতার সঙ্গে মিলেমিশে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যা শুধু আদিবাসীদের পক্ষেই নয়, সকলের পক্ষেই দুঃস্বপ্নের।
এ দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ নেই, তা বলব না। কিন্তু সে পথ কঠিন। আইন, আদালত, পুলিশ অভিজ্ঞতায় যা জেনেছি ক্ষমতাবানদের জন্য; দরিদ্র, অসহায়দের জন্য এদের ভূমিকা রক্ষকের চেয়ে বেশি ভক্ষকের। আর তারা যদি মেয়ে হয়, তা হলে তো কথাই নেই। এ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে সমাজকেই, এবং নানা স্তরে। প্রথমত মেয়েদের সংগঠিত হতে হবে, এবং তাদের হকগুলো সুরক্ষিত রাখার জন্য, আদায় করার জন্য পুরুষদের সঙ্গে তর্ক, আলোচনা, এমনকী কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজনে সংঘাতেও যেতে হবে। এবং পুরুষদেরও এটা বুঝতে হবে যে, মেয়েদের বাদ দিয়ে সমাজ টিকতে পারে না, যে আধুনিক সমাজ থেকে আদিবাসী পুরুষ মেয়েদের উপর ক্ষমতা জাহির করা অনুকরণ করছে, সেই পুরুষও যে আসলে সেই আধুনিক সমাজের এক জন দাস, এটা যদি সে উপলব্ধি না করে, তা হলে নারীদের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষও নির্বংশ হবে। মূল্যবোধের বিকৃতি তো বংশহীনতারই সমান। এক কথায়, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আদিবাসী মানুষেরও নতুন মূল্যবোধ গড়ে তুলতে হবে, যে বোধ তাকে তার সামগ্রিক কুশলতা বাড়ানোর লড়াইয়ে নারী-পুরুষ উভয়কে একত্রিত করে এগিয়ে নিয়ে যাবে। |