ঔপনিবেশিক যুগে তাঁহারা ‘অপরাধপ্রবণ জাতি’ রূপে শনাক্ত হইয়াছিলেন। পুলিশ চাহিলেই যাহাকে খুশি গ্রেফতার করিতে পারিত। ফলে পুলিশ-প্রশাসনের লোক দেখিলেই তাঁহারা আত্মগোপন করিতেন। স্বাধীনতার পরেও সামাজিক অপমান অক্ষুণ্ণ ছিল, এখনও অনেকাংশে আছে। এমন যে শবর জনগোষ্ঠী, মেদিনীপুর-বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের সেই জনজাতির মধ্যে সরকারি উদ্যোগেই উন্নয়নের কর্মসূচি সাফল্য অর্জন করিয়াছে। অনাবাদী পতিত জমিতে আমবাগান করিয়া শবরদের নিয়মিত রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা তো হইয়াছে বটেই, এমনকী এই অভিনব কৃষিকাজে যুক্ত হইয়া তাঁহারা লাভের মুখও দেখিতেছেন। এই সাফল্যের জন্য বাঁকুড়ার জেলাশাসকের হাতে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক সম্প্রতি শংসাপত্রও তুলিয়া দিয়াছে। কেননা বছর পাঁচেক আগে এই জেলারই এক বিডিও-র আন্তরিক চেষ্টায় শবর জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই রূপান্তরের সূচনা হয়। কেন্দ্রীয় শংসাপত্র সেই প্রচেষ্টারই স্বীকৃতি।
কিন্তু এই সাফল্য কি শুধু সরকারি আধিকারিকদের? জনজাতির মানুষ নিজেরা প্রস্তুত না হইলে সরকারি আধিকারিকের শুভেচ্ছা ও আন্তরিকতা বিফলে যাইত। স্বাবলম্বন ও স্বাধিকারের বোধ না জাগিলে এই চমৎকার সফল হইত কেমন করিয়া? পাঁচ বছর আগে যেখানে পরীক্ষামূলক ভাবে মাত্র ১৮টি পতিত জমি আমবাগানে পরিণত করা হয়, এখন সেখানে অনুরূপ বাগানের সংখ্যা দেড় শতাধিক। ফলনের পরিমাণ ১৩২ মেট্রিক টন। ইহা কেবল সরকারি বদান্যতা ও নিষ্ঠার ফল হইতে পারে না। ইহার পিছনে শবরদের দীর্ঘ কালের আগ্রহ সক্রিয় থাকিয়াছে। বলা হয়, অনেক ক্ষেত্রেই জনজাতির মানুষ কৃষিকর্মে, বস্তুত নিয়মিত কোনও ধরনের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডে সহসা যুক্ত হইতে চাহেন না। সেই অনীহা, নিষ্ক্রিয়তা, আলস্য মোচনের যুক্তিতেই তাঁহাদের ‘মূল স্রোতে’ ফিরাইয়া আনার তত্ত্ব ফেরি করা হয়। তত্ত্বটি যে অসার, তাহাতে সংশয় নাই। মূল স্রোতে শামিল করার জন্য উপর হইতে কোনও কর্মসূচি চাপাইয়া দেওয়া নয়, প্রান্তজনের প্রয়োজন, অগ্রাধিকার, বাসনার সহিত সামঞ্জস্য রাখিয়া কর্মসূচি প্রণয়নের মধ্যেই রহিয়াছে অন্ত্যোদয়ের চাবিকাঠি।
যে আধিকারিক বাঁকুড়ার শবরপল্লিতে রূপান্তর আনিয়াছেন, তিনি নিজে শবরদের ভাষা, সংস্কৃতি, লোকাচারের সহিত সম্যক পরিচিত স্থানীয় মানুষ। ফলে তাঁহার পক্ষে এই জনগোষ্ঠীর চাহিদা, আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনকারী কর্মসূচি প্রণয়ন তুলনায় সহজ হইয়াছে। তিনি লক্ষ করিয়াছেন, অন্য সকল কৃষিজীবীর মতোই শবররাও যখন গাছকে নিজেদের সম্পত্তি গণ্য করিতেছেন, কেবল তখনই তাহার পরিচর্যা করিতেছেন। সরকারি বাগানে জলসিঞ্চন ও পরিচর্যা করিয়া সেগুলির বাড়বৃদ্ধিতে তাঁহাদের উৎসাহ নাই। এই রাজ্যে কৃষি-সমবায়ের আন্দোলনও একই কারণে সফল হয় নাই। কৃষকরা সর্বদাই ভয় পাইয়াছেন, সমবায় হইলে, সরকার বীজ-ফসল-বাজারের দায়িত্ব লইলে এক সময় হয়তো তাঁহাদের জমিও সরকারের হাতে চলিয়া যাইবে। শবররা যখন দেখিলেন, বাগানের জন্য তাঁহারা নিজেরা জমি পাইবেন, তখন দ্বিধা কাটিয়া যায়। ফলের বাগানকে তাঁহারা চোখের মণির মতো রক্ষা করিতে আগাইয়া আসেন। সাফল্য দেখিয়া সরকার এই পতিত জমিতে আঙুর এবং কমলালেবুর বাগান করিতেও যাবতীয় সহায়তা দিতে প্রস্তুত। রাজ্যের একটি জনগোষ্ঠীর উঠিয়া দাঁড়াইবার এই প্রয়াসে সরকারি সহায়তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। |