চিত্র ১: সোমবার বেলা ১০টা। ভিআইপি রোড দিয়ে লেকটাউন থেকে উল্টোডাঙা আসার আগে উল্টোডাঙা সেতুর সামনে দাঁড়িয়ে গেল অটো। সামনে বসা এক যুবককে চালক রীতিমতো নির্দেশ দিলেন নেমে যান। ওই যুবক বললেন, এখনও তো উল্টোডাঙা আসেনি, এখনই নেমে যাব কেন? অটোওয়ালা নির্বিকার: দাদা আপনাকে ওঠার সময়েই বলেছিলাম, উল্টোডাঙা মোড় পর্যন্ত পাঁচ জন নিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না।
চিত্র ২: রবিবার রাত ৯টা। উল্টোডাঙা থেকে কৈখালি এসে এক যাত্রীর কাছে অটোচালক ভাড়া চাইলেন ৩০ টাকা। ওই যাত্রী জানালেন, কিছুক্ষণ আগেই তিনি কৈখালি থেকে উল্টোডাঙা গিয়েছেন ২৫ টাকায়। দু’ঘণ্টার মধ্যে পাঁচ টাকা বেড়ে গেল কী ভাবে? একই রুটে কী ভাবে দু’রকম ভাড়া হয়? অটোচালক কোনও যুক্তিই মানতে নারাজ। তাঁর দাবি, রাতে পাঁচ টাকা বেশি লাগবে। হাতাহাতি পর্যায়ে যাওয়ার আগে অন্য যাত্রীদের মধ্যস্থতায় বিষয়টি থামল।
লাগামছাড়া অটো-দৌরাত্ম্য রুখতে অভিযান শুরু করেছে কলকাতা পুলিশ। অটোকে শৃঙ্খলায় বাঁধতে বিশেষ কন্ট্রোল রুমও খুলেছে লালবাজার। কিন্তু এ সব কিছুই কলকাতার জন্য। কলকাতার সীমানা পেরোলেই ছবিটা সেই লাগামছাড়া দৌরাত্ম্যেরই। আর তা যে এতটুকু কমেনি, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে শনিবার লেক টাউনের ঘটনা। |
তারাতলা থেকে ঠাকুরপুকুর রুটের অটোর লাইন। —ফাইল চিত্র। |
পরিবহণ দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, কলকাতা ও শহরতলি এলাকার এই নিয়মের হেরফের বরাবরের ট্র্যাডিশন। আগে গড়িয়া থেকে গোলপার্ক রুটে যাদবপুর থানা অবধি ছিল পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ। তার পর থেকে কলকাতা পুলিশ। সেই সময়ে যাদবপুর থানা অবধি অটোয় যাত্রী নেওয়ার ব্যাপারে কোনও বিধিনিষেধ ছিল না। যাদবপুর থানার পর থেকে অবশ্য ওই অটোই চার জনের বেশি যাত্রী নিত না। গড়িয়া অবধি কলকাতা পুলিশ হয়ে যাওয়ার পরে একই নিয়ম হয়েছে বারুইপুর-গড়িয়া অটো-রুটে। গড়িয়া ব্রিজে ওঠার আগে অটোওয়ালা গাড়িতে চার জনের বেশি যাত্রী নেন না। ডান দিকে কোনও যাত্রীও নেন না। কিন্তু ও-পারে সে সব নিয়মের বালাই নেই। কোনও কোনও ক্ষেত্রে অটোতে সাত জন পর্যন্ত যাত্রী তোলা হচ্ছে। একই নিয়ম সত্যি উত্তর শহরতলির ক্ষেত্রেও। উত্তরে সিঁথি মোড় পেরোলেই অটোর ক্ষেত্রে নিয়মের কড়াকড়ি উধাও হয়ে যাচ্ছে।
শহরতলিতে বিধিনিষেধ মানা হচ্ছে না অটোর দূষণ নিয়েও। দূষণ কমাতে ২০০৯ সালে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে পেট্রোলচালিত অটোকে গ্যাসে বদলির প্রক্রিয়া শুরু হয়। কলকাতায় গ্যাস-অটোতে বদলির প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হলেও শহরতলিতে এখনও বহাল তবিয়তে পেট্রোল-চালিত অটো দূষণ ছড়িয়ে যাচ্ছে।
শহরতলির কেন এমন হাল?
পরিবহণ কর্তারা জানাচ্ছেন, কলকাতা পুলিশের এলাকায় অটো নিয়ে প্রশাসন যতটাই কড়া, শহরতলি এলাকায় ততটাই ঢিলেঢালা। এক পরিবহণ-কর্তার মতে, “কলকাতা এলাকায় সরকার নির্দেশিত ১২৫টি রুট আছে। সেখানে সর্বোচ্চ কত অটো চলতে পারে, সেই সংখ্যাও নির্দিষ্ট করা আছে। সেই নিয়মের বাইরে গিয়ে কোনও অটো চললে তাকে ধরা যায়। কিন্তু শহরতলির ক্ষেত্রে এমন সরকারি রুট নেই। আলিপুর এবং বারাসত পরিবহণ অফিস নির্দেশিত সাড়ে তিনশোরও উপর রুট আছে। কিন্তু কড়াকড়ি না থাকায় সে সব রুট এখন যথেচ্ছ আকার নিয়ে নিয়েছে।” পরিবহণ কর্তাদের দাবি, শহরতলিতে অটোরুটের এই যথেচ্ছ চেহারা হওয়ার পিছনে প্রধানত দায়ী অটো ইউনিয়নগুলিই। এমনকী, ইউনিয়নের ‘আশীর্বাদ’ থাকায় অনেক বেআইনি অটোও বহাল তবিয়তে চলছে শহরতলিতে। ওই পরিবহণ-কর্তা বলেন, “রাজ্যে পালাবদলের পরে অটো ইউনিয়নেও পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু ভোটব্যাঙ্ক বজায় রাখতে এখনকার শাসক দলের ইউনিয়নও সেই পুরনো নিয়মই বজায় রেখেছে। ফলে, পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন হয়নি।”
শহরতলির অটোর রুটও যে মাঝেমধ্যেই বদলে যায়, তার উদাহরণ রয়েছে প্রচুর। যেমন দিন কয়েক আগে উল্টোডাঙা থেকে কৈখালি রুটের অটো তেঘরিয়া পর্যন্ত যাচ্ছিল। তার কারণ হিসেবে অটোওয়ালারা জানান, বাগুইআটি থেকে এক এয়ারপোর্ট এক নম্বর রুটের অটোর সঙ্গে ঝামেলার জন্য তারা কৈখালি পর্যন্ত চালাচ্ছেন না। যাত্রীদের প্রশ্ন, অটোচালকদের নিজেদের মধ্যে ঝামেলার খেসারত কেন যাত্রীদের দিতে হচ্ছে?
তবে পরিবহণ দফতরের শীর্ষ কর্তারা জানাচ্ছেন, কলকাতার পরে এ বার শহরতলির অটোকেও শৃঙ্খলায় বাঁধতে সচেষ্ট হচ্ছে সরকার। দফতর সূত্রের খবর, শহরতলিতে এলাকাভিত্তিক অটো-রুট তৈরির ভাবনা রয়েছে সরকারের। দফতরের এক কর্তা বলেন, “দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তীতে সম্প্রতি অটোরুট নির্দিষ্ট করে তালিকা প্রস্তুত করে দেওয়া হয়েছে। সমস্ত অটোকে গ্যাসে বদল করে রুট-প্রতি অটোর সংখ্যাও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। শুরু হয়েছে নজরদারিও। এতে সাফল্য মিলেছে। এই মডেলেই কলকাতার শহরতলি এলাকাগুলিতে অটো-শৃঙ্খলা তৈরির ভাবনা রয়েছে রাজ্য পরিবহণ দফতরের।”
বিধাননগর কমিশনারেটের এডিসি সন্তোষ নিম্বলকর বলেন, “বিধাননগর কমিশনারেটের কন্ট্রোল রুমের নম্বর অটোর সামনে চালকের কেবিনে লিখে রাখতে বলা হয়েছে। কারও কোনও অভিযোগ থাকলে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে অভিযোগ জানাতে পারবেন। অথবা ফেসবুকের মাধ্যমেও অভিযোগ জানাতে পারেন। আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেব।” কিন্তু কোনও অটোর গায়েই অবশ্য বিধাননগর কমিশনারেটের কোনও নম্বর লেখা দেখা যায়নি।
কলকাতার মতো নজরদারি যে শহরতলির অটোয় নেই, তা ঠারেঠোরে মেনে নিচ্ছেন পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রও। তাঁর মতে, “কোথাও বেআইনি কোনও কিছুই বরদাস্ত করা হবে না। কলকাতায় অভিযান শুরু হয়েছে। খুব শীঘ্র শহরতলি এলাকাগুলিতেও অভিযান শুরু হবে। পুলিশকে ইতিমধ্যেই আমরা এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছি।” |