সালিশি সভা বসে পঞ্চায়েত সদস্যের সামনেই
সালিশি সভায় উপস্থিত ছিলেন, সালিশিপত্রে স্বাক্ষর করেন, তরুণীর প্রেমিকের জামিনদারও তিনিই।
এ সব কথা স্বীকারও করে নিচ্ছেন লাভপুরের চৌহাট্টা-মহোদরী ১ পঞ্চায়তের তৃণমূল সদস্য অজয় মণ্ডল। কিন্তু ওই সালিশি সভায় গণধর্ষণের নিদান দেওয়া হয়েছিল কি না, অথবা ওই তরুণীকে গণধর্ষণ করা হয়েছে কি না, সেটা তাঁর জানা নেই বলেই দাবি অজয়বাবুর।
বৃহস্পতিবার আদিবাসী সমাজের একটি প্রতিনিধি দল সুবলপুরে গিয়েছিল। গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে ওই দলের অন্যতম সদস্য ঘসিরাম হেমব্রম অভিযোগ করেছেন, “তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্য অজয় মণ্ডলই সালিশি সভায় জরিমানা দেওয়ার কথা তোলেন।” স্থানীয় বাসিন্দা অজিত সরেন, সুনীল হেমব্রমরা সংবাদমাধ্যমের কাছে দাবি করেন, “পঞ্চায়েত সদস্য অজয়বাবু নিজে জামিনদার হিসেবে জরিমানা দিয়ে যুবককে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। কিন্তু মেয়েটির ব্যাপারে মাথা ঘামাননি।”
কেন?
অজয়বাবুর ব্যাখ্যা, আদিবাসী সমাজের ভাবাবেগের কথা ভেবে তিনি উচ্চবাচ্য করেননি। বিষয়টা প্রশাসনকে জানাননি কেন? তাঁর জবাব, “উভয় পক্ষের সম্মতিতে মীমাংসা হয়ে যাওয়ায় প্রশাসনকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করিনি।”
তবে সালিশি সভায় অজয়বাবুর উপস্থিতি আইন ও বিচারব্যবস্থার সমান্তরালে চলা খাপ পঞ্চায়েতের মতো ব্যবস্থার পিছনে রাজনৈতিক প্রশ্রয়ের অভিযোগকে পুষ্ট করেছে। যদিও অজয়বাবুর দাবি, সভার কার্যকলাপ এবং জরিমানার ব্যাপারে তাঁর কোনও সক্রিয় ভূমিকা ছিল না। কিন্তু তরুণী ও তাঁর প্রেমিককে গাছে বেঁধে রাখা, সালিশি সভা বসানো, জরিমানা করা এবং তার পর গণধর্ষণের অভিযোগ সোমবার বিকেল থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত এতগুলি ঘটনা ঘটলেও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে শুরু করে প্রশাসন সকলে কেন নীরব ছিল, সেই প্রশ্ন উঠেছে।
বোলপুর আদালতের পথে গণধর্ষণে ধৃত ১৩ জন। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।
লাভপুরের তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলাম বলেন, “আমাদের দলের কোনও পঞ্চায়েত সদস্য ওই সালিশি সভায় হাজির ছিলেন কি না, জানা নেই। ঘটনাটা জানার পরেই আমরা পুলিশকে বলি অভিযুক্তদের গ্রেফতার করতে।” আর লাভপুরের বিডিও জীবনকৃষ্ণ বিশ্বাসের বক্তব্য, “আমরা খবরটা অনেক দেরিতে পেয়েছি। আদিবাসী সমাজের সঙ্গে জনসংযোগ বাড়ানো প্রয়োজন।”
এ দিন সুবলপুর গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অসুখ-বিসুখ, ‘ভূতে পাওয়া’ থেকে নারী-পুরুষ সম্পর্ক যে কোনও অজুহাতে সালিশি সভা বসিয়ে জরিমানা আদায় করার রেওয়াজ দীর্ঘদিন ধরেই চালু আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গ্রামের নেতা তথা মোড়লের নেতৃত্বে এলাকার বড় অংশের মানুষ জরিমানা দাবি করেন। তা দিতে না-পারলে কখনও ‘ডাইন’ বলে দেগে দেওয়া হয়, কখনও বয়কট করা হয় সামাজিক ভাবে। বৃহস্পতিবার এলাকাবাসীরই একাংশ অভিযোগ করেছেন, ভোটব্যাঙ্কের কথা মাথায় রেখে রাজনৈতিক নেতারা হয় দেখেও দেখেন না, অথবা সালিশিতে সক্রিয় ভাবে যোগ দেন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মোড়লের সঙ্গে শাসক দলের নেতাদের ঘনিষ্ঠতাও থাকে। মোড়লের প্রভাবের কথা মাথায় রেখে নেতারা তাঁকে চটাতে চান না। আবার মোড়লও নেতাদের সঙ্গে ওঠা-বসা করে সুযোগ-সুবিধা আদায় করেন। সুবলপুরে অভিযুক্ত মোড়ল বলাই মাড্ডির সঙ্গে তৃণমূল নেতাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল বলে অনেকের অভিযোগ।
মনিরুল অবশ্য দাবি করেছেন, “রাজনৈতিক ফায়দার জন্য সালিশি সভাকে প্রশ্রয় দেওয়ার প্রশ্নই নেই।” আর অভিযুক্ত মোড়লের সঙ্গে তৃণমূল নেতাদের ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য, “এখন তো সবাই তৃণমূল। তবে ওই মোড়লের সঙ্গে আমাদের দলের সম্পর্ক ছিল কি না, জানা নেই।”
আদিবাসী সমাজের একাংশও বলছেন, ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থেই সালিশি সভার মতো নানা কুপ্রথা জিইয়ে রাখা হয়েছে। লাভপুর আদিবাসী গাঁওতার সম্পাদক বুই মাড্ডি, ভারত জাকাত মাঝি মাড়োয়ার সদস্য রামচন্দ্র মাড্ডিদের কথায়, “আদিবাসী সমাজ থেকে সালিশি সভা-সহ বিভিন্ন কুসংস্কার দূর করতে বারবার সচেতনতা শিবির করছি। কিন্তু জনসমর্থন হারানোর ভয়ে রাজনৈতিক দলগুলির সমস্যা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকার প্রবণতা রোখা যায়নি।”
সালিশি সভা বসানোর রীতি যে কিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না, সে কথা স্বীকার করে নিয়েছেন বীরভূমের জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। এর আগে ভিন্ জাতের পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার দায়ে ২০১০ সালে রামপুরহাটের বটতলায় বছর সতেরোর কিশোরীকে বিবস্ত্র করে গ্রাম ঘোরানো হয়েছিল। দু’বছর পরে ২৩ জানুয়ারি সেখানেই শিবদাসপুরে চুল কেটে অর্ধনগ্ন করে ঘোরানো হয় এক তরুণীকে। অপরাধ, পালিয়ে গ্রামেরই এক যুবককে বিয়ে করা। দীঘলপাহাড়িতে ভিন্ জাতের যুবকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় ধরা পড়ায় গত বছর ১৪ মার্চ চুল কেটে বিবস্ত্র করা হয়েছিল দু’জনকেই।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.