ভিন্ জাতের ছেলের সঙ্গে একত্রে ঘুরতে দেখা গিয়েছিল। দু’জনকে ধরে সারা রাত গাছে বেঁধে রাখার পর বসল সালিশি সভা। উপজাতীয় গ্রামপ্রধান মোটা টাকা জরিমানা হাঁকলেন। অনাদায়ে নিদান দিলেন, “টাকা না পেলে তোরা মেয়েটাকে নিয়ে মস্তি করে নে!”
কুড়ি বছরের মেয়েটিকে এর পর ১২ জন গ্রামবাসী মিলে রাতভর ধর্ষণ করেছে বলে অভিযোগ। মুখতারন মাইয়ের ঘটনার ভয়াবহ স্মৃতি উস্কে দিয়ে এ ভাবেই পাকিস্তানের মুজফ্ফরগড়ের সঙ্গে অনেকাংশে মিলে গিয়েছে বীরভূমের লাভপুর। ভিন্ সম্প্রদায়ের একটি মেয়ের সঙ্গে তাঁর ভাইয়ের ঘনিষ্ঠতার শাস্তি হিসেবে ২০০২ সালের জুন মাসে মুজফ্ফরগড়ে মাসতোই উপজাতির নিজস্ব গ্রামসভা মুখতারনের উপর গণধর্ষণের নির্দেশ দিয়েছিল। চার জন প্রধান অভিযুক্ত-সহ মোট ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন মুখতারন।
লাভপুরের নির্যাতিতা আপাতত সিউড়ি সদর হাসপাতালে ভর্তি। পুলিশ বুধবার রাতে ওই মোড়ল-সহ ১৩ জন গ্রামবাসীকে গ্রেফতার করেছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, সোমবার লাভপুর থানার রাজারামপুরে ভিন্ সম্প্রদায়ের এক যুবকের সঙ্গে বছর কুড়ির ওই তরুণীকে দেখা গিয়েছিল। সেই ‘অপরাধে’ তাঁদের দু’জনকেই প্রথমে সারা রাত গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়। পরের দিন, মঙ্গলবার তাঁদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয় পাশের গ্রাম, সুবলপুরের সালিশি সভায়। দু’জনকেই মোটা টাকার জরিমানা ধার্য করেন গ্রামের মোড়ল বলাই মাড্ডি। স্থানীয় পুলিশ সূত্রের খবর, তাঁদের ২৫ হাজার টাকা দিতে বলা হয়েছিল। টাকা দিতে না পারায় মোড়লের নির্দেশে গ্রামেরই ১২ জন মিলে তাঁকে রাতভর ধর্ষণ করে বলে বুধবার লাভপুর থানায় অভিযোগ করেছেন তরুণী। তাঁর সঙ্গী তরুণকে এলাকায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ দিন রাতেই মেয়েটিকে সিউড়ি সদর হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে পুলিশ।
বীরভূমের পুলিশ সুপার সি সুধাকর বলেন, “মোড়ল-সহ ধৃত ১৩ জনের বিরুদ্ধে গণধর্ষণের অভিযোগ দায়ের হয়েছে।” হাসপাতাল সুপার অসিত বিশ্বাস বলেন, “যুবতীর চিকিৎসা শুরু হয়েছে। চিকিৎসকেরা রিপোর্ট দেওয়ার পরেই তাঁর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানাতে পারব।” এ দিন রাতে হাসপাতালে মেয়েটির সঙ্গে ফোনে কথা বলেন রাজ্যের নারী ও শিশুকল্যাণ দফতরের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী শশী পাঁজা। নিজে চিকিৎসক হওয়ার সুবাদে তিনি মেয়েটির শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নেন। কী কী ঘটেছে, জেনে নেন। মন্ত্রী মেয়েটিকে বলেন, “তোমার কোনও ভয় নেই। সরকার তোমার পাশে আছে। ডাক্তারদের সব কথা জানাও।” পরে তিনি সাংবাদিকদের কিছুটা অসহায় সুরেই বলেন, “কী ভাবে যে মানুষকে সচেতন করা যাবে, ভেবে পাচ্ছি না। তবু আমরা চেষ্টা করে চলেছি। ও খুব সাহসী মেয়ে।” সিউড়ি জেলা হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, চিকিৎসকেরা ইতিমধ্যেই ওই তরুণীর শারীরিক নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছেন। পাঁচ জন চিকিৎসকের একটি দল মেয়েটিকে দেখছেন।
হাসপাতালে শুয়েই এ দিন তরুণী বলেন, “আমরা গরিব মানুষ, টাকা কোথায় পাব? সে কথা জানাতেই মোড়ল গ্রামের লোকদের বললেন, ‘জরিমানা দিতে না পারলে তোরা ওকে নিয়ে মস্তি কর’। ভাই-বাপ-দাদার বয়সী লোকগুলো সারা রাত আমার উপরে অত্যাচার করল।” অভিযুক্ত মোড়ল গ্রাম-সম্পর্কে তাঁর কাকা হন বলেও জানিয়েছেন তরুণী।
কিছু দিন ধরেই রাজ্যে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে আসছে। সামাজিক প্রতিবাদ আন্দোলনের জন্ম দিচ্ছে। গোটা দেশ জুড়েই ছবিটা একই। কিন্তু এ ভাবে সম্প্রদায়ের ‘সম্মান’ লঙ্ঘনের জন্য সালিশি সভা বসিয়ে গণধর্ষণের ছাড়পত্র দেওয়ার নিদর্শন এ রাজ্যে সচরাচর শোনা যায়নি। উত্তর-পশ্চিম ভারতের খাপ পঞ্চায়েত, ফুলন দেবীর সূত্রে কুখ্যাত বেহমাই গ্রামের গণধর্ষণের ঘটনা বা পাকিস্তানের মুখতারন মাইয়ের ঘটনার সঙ্গেই লাভপুরের তুলনা চলতে পারে বলে মনে করছেন সমাজবিদরা।
গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির সর্বভারতীয় সভানেত্রী মালিনী ভট্টাচার্য বলেন, “যদি সত্যিই এমন ঘটনা ঘটে থাকে, তবে তা পশ্চিমবঙ্গের জন্য অশনি সঙ্কেত। এখানে তো মনে হচ্ছে রীতিমতো সিদ্ধান্ত নিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে, যা আরও মারাত্মক।” যাতে মধ্যমগ্রামের মতো নির্যাতিতাকে ভীতি প্রদর্শনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে, তার জন্য মেয়েটির নিরাপত্তার দায়িত্ব প্রশাসনকে নিতে হবে বলে দাবি তুলেছেন তিনি। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় জানান, তিনি ইতিমধ্যেই জেলা পুলিশের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বিষয়টির সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, “ঘটনাটি অত্যন্ত নিন্দনীয় ও দুঃখজনক। অপরাধীদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের একাংশের অবশ্য দাবি, “ধর্ষণের অভিযোগ মিথ্যা হতে পারে। যেহেতু মেয়েটিকে জরিমানার টাকা দিতে চাপ দেওয়া হচ্ছিল, তাই মেয়েটি কারও পরামর্শে থানায় ধর্ষণের অভিযোগ করেছে।” এই দাবিকে অবশ্য আপাতত পুলিশ-প্রশাসন গুরুত্ব দিচ্ছে না। তা ছাড়া সালিশি সভা বসানো এবং জরিমানার বিষয়টি স্থানীয় কোনও সূত্রই অস্বীকার করেননি। তাঁরা প্রায় সকলেই স্বীকার করেছেন, সোমবার সন্ধ্যায় গ্রামের মধ্যে দু’জনকে গল্প করতে দেখে আদিবাসী সম্প্রদায়ের একাংশ তা মেনে নিতে পারেননি। মঙ্গলবারই দু’জনকে নিয়ে সালিশি সভা বসানো হয়।
বুধবার সন্ধ্যায় মায়ের সঙ্গে তরুণী লাভপুর থানায় এসে গণধর্ষণের লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে, অভিযোগ পাওয়ামাত্রই ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়। অভিযুক্তদের খোঁজে গিয়ে দু’টি গ্রামেই প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে পুলিশ। প্রথমে চার জনকে ধরা হয়। রাতের দিকে আরও সাত জন ধরা পড়ে। অভিযোগ জানাতে আসার সময়েই মেয়েটিকে যথেষ্ট অসুস্থ দেখাচ্ছিল। লিখিত অভিযোগ দায়ের হওয়ার পরে পুলিশ তাঁকে রাত ৯টা নাগাদ সিউড়ি সদর হাসপাতালে ভর্তি করায়। |