|
|
|
|
সত্য হলে শাস্তি চান আদিবাসী প্রতিনিধিরা
অরুণ মুখোপাধ্যায় • সিউড়ি
অর্ঘ্য ঘোষ • লাভপুর |
লাভপুরের গ্রামে আদিবাসী তরুণীর গণধর্ষণের অভিযোগে আলোড়ন উঠেছে রাজ্যের সাঁওতালি সমাজে। সালিশি সভা বসিয়ে মাঝি হড়ম ওই তরুণীকে গণধর্ষণের নির্দেশ দিয়েছেন, নিজেও ধর্ষণ করেছেন এই নালিশে রীতিমতো বিস্মিত ‘ডিসম মাঝি’ নিত্যানন্দ হেমব্রম। সাঁওতাল সমাজের সর্বোচ্চ এই নেতা বৃহস্পতিবার বলেন, “এটা স্বপ্নেও ভাবা যায় না। আমাদের সমাজ এ ধরনের জিনিস কখনওই অনুমোদন করে না।” এমন ঘটে থাকলে দোষীদের কঠোর শাস্তি দাবির পাশাপাশি, ঠিক কী ঘটেছিল তা জানার জন্য এ দিন সুবলপুরে প্রতিনিধিদল পাঠান তিনি।
ওই দলের সদস্যরা এ দিন জানান, সালিশি এবং জরিমানার কথা স্বীকার করলেও, গণধর্ষণের কথা তাঁদের কাছে অস্বীকার করেছেন গ্রামবাসী। তবে পুরো বিষয়টি বুঝতে তাঁরা এখনও কথা চালিয়ে যাচ্ছেন। কাল মেয়েটির দাদাদের সঙ্গে কথা বলা হবে। ওই দলের অন্যতম সদস্য ওপেল মাড্ডি বলেন, রবিবার সুবলপুরে সভা হবে। আশেপাশের ২০-২৫টি গ্রামের মাঝি হড়মরা আসবেন। “আমাদের দাবি করব, যদি কেউ সত্যিই মেয়েটির সম্মানহানি করে থাকে, তাঁদের শাস্তি হোক। না হলে সংবাদমাধ্যমের কাছে আবেদন করব, সত্য প্রচার করুন। এই কদর্য খবর আদিবাসী সমাজকে কলঙ্কিত করেছে।”
প্রতিনিধিদলকে গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন, বছর কুড়ির ওই তরুণী বিধবা মায়ের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে থাকেন। দাদারা অন্য গ্রামে থাকেন। ওই অবিবাহিত তরুণীর সঙ্গে বেশ কয়েক বছর ধরেই ভিন সম্প্রদায়ের একটি বিবাহিত যুবকের সম্পর্ক রয়েছে। বছর চারেক তাঁরা দিল্লিতে ছিলেন। কিছু দিন আগে ফিরে আসার পরেও তাঁদের সম্পর্ক ছিল।
গ্রামবাসীর একাংশের দাবি, সোমবার রাতে তরুণীর মা তাঁর ছেলের বাড়িতে গিয়েছিলেন। ওই দিন দু’জনকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখা যায়। তারপরেই দু’জনকে নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের মোড়ল বলাই মাড্ডির বাড়িতে। সেখানে সারারাত একটি তালগাছে দু’জনকে বেঁধে রাখা হয়। মঙ্গলবার সকালে গ্রামে বসে সালিশি সভা। নিত্যানন্দবাবুর কথায়, “গ্রামের লোকেরা ওই তরুণী এবং তাঁর পুরুষসঙ্গীর সম্পর্ক নিয়ে আপত্তি করেন। মেয়েটিকে সতর্ক করা হয়, গ্রাম ছেড়ে চলে যাও, নইলে একা থাকো।” কিন্তু সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি এবং আদিবাসী সমাজের প্রতিনিধি কারও কাছেই গ্রামবাসীরা গণধর্ষণের কথা স্বীকার করেননি। সালিশি সভা ও জরিমানার কথা মেনেছেন, কিন্তু গণধর্ষণের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
বৃহস্পতিবার এই প্রতিবেদকদের কাছেও গ্রামবাসীরা গণধর্ষণের কথা অস্বীকার করেন। মোড়ল বলাই মাড্ডির বাড়ির রান্নাঘরে তাঁকে ধর্ষণ করা হয়েছিল বলে অভিযোগ করেছেন ওই তরুণী। বলাইয়ের বাড়ির খুব কাছেই থাকেন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী মণি মাড্ডি। তিনি বলেন, “সোমবার সারারাত গণ্ডগোল হল। মঙ্গলবার সভা ডেকে জরিমানার টাকা-পয়সা ঠিক হল। মেয়েটির উপর অত্যাচারের ঘটনা ঘটল কখন, আমরা তো কিছু বুঝতেই পারলাম না।” বলাই মাড্ডির মা পাকু মাড্ডি দাবি করেন, “ওই যুবক এবং তরুণী কারও নিষেধ কানে তো তোলেইনি, উল্টে খুনের হুমকি দিয়েছিল। এতেই ক্ষিপ্ত গ্রামবাসীরা তাদের বেঁধে রাখে। সালিশি সভা বসিয়ে জরিমানাও করা হয়, এ কথাও সত্য। কিন্তু গণধর্ষণের অভিযোগ ভিত্তিহীন।”
নির্যাতিতা তরুণীর বয়ান যদিও সম্পূর্ণ ভিন্ন। মেয়েটির অভিযোগ: তাঁর সঙ্গে বিয়ের কথা বলতে সোমবার ছেলেটি তাঁদের বাড়িতে এসেছিল। তখন অনেকে বাড়ি ঘিরে ফেলে। অন্য জাতে বিয়ের কথা জেনে বিচারসভা বসিয়ে জরিমানা করে, সারা রাত বেঁধে রাখে। মেয়েটির দাবি, টাকা দিতে পারব না জেনে মোড়ল বলে, ওকে নিয়ে ফুর্তি করে। তার পর মোড়ল-সহ ১৩ জন তাঁকে ধর্ষণ করে। সুবলপুরের লাগোয়া লাটুরবোনা গ্রামে থাকেন তরুণীর ভাই। তিনি বলেন, “গণ্ডগোলের খবর পেয়ে আমরা গিয়ে দেখি দিদি এবং যুবকটিকে একটি তালগাছে বেঁধে রাখা হয়েছে। প্রথমে আমাদের ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।” তখন কাকুতিমিনতি করে তিন হাজার টাকায় রফা করে তিনি নিজের বাড়ি ফিরে যান। সোমবার টাকা দেওয়ার কথা ছিল। “পরে দিদির মুখে শুনলাম, সারা রাত ধরে দফায় দফায় তাঁর উপর অত্যাচার করা হয়েছে।”
এ দিন গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলার পরে আদিবাসী দলের সদস্য ওপেল মাড্ডি কিন্তু সন্দেহ করছেন, “কে ওই তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগ করতে মদত দিয়েছিল, জানি না। এর সঙ্গে রাজনীতির যোগ থাকতে পারে।” রাজনৈতিক মদতের কথা অবশ্য মানতে রাজি নন প্রাক্তন জেলা সভাধিপতি মনসা হাঁসদা। ‘পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী অধিকার মঞ্চ’ থেকেও এ দিন প্রতিনিধি দল পাঠানো হয়েছিল সুবলপুরে। মনসাবাবু ওই মঞ্চের সদস্য। তিনি বলেন, “এ বিষয়ে সকলের রায় নেওয়া হয়নি। মোড়ল এবং আর ১০-১২ জন এর মধ্যে ছিল।”
গণধর্ষণ হয়েছিল কি না, জানতে পুলিশ-প্রশাসন এখন মেডিক্যাল রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছে। এ দিন সিউড়ি হাসপাতালের সুপার-সহ চার চিকিৎসকের একটি দল মেয়েটিকে পরীক্ষা করেন। সুপার অসিত বিশ্বাস বৃহস্পতিবার সকালে বলেন, “পুলিশ যা যা জানতে চেয়েছে, তা সবই রিপোর্টের আকারে বন্ধ খামে বুধবার রাতেই পাঠানো হয়েছে।”
হাসপাতালের একটি সূত্রের দাবি, ওই তরুণীর মুখে, পেটে এবং শরীরের নানা জায়গায় ইতস্তত আঁচড়ের চিহ্ন রয়েছে। গণধর্ষণ হয়ে থাকলে সাধারণত যত মারাত্মক ক্ষত হয়ে থাকে, তরুণীর আঘাত তত গুরুতর নয় বলেই চিকিৎসকদের একাংশের দাবি। তাঁদের বক্তব্য, গোপনাঙ্গে রক্ত বা অন্যান্য দেহরসের কোনও স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সূত্রের খবর, তরুণী ওই চিকিৎসকদের কাছে দাবি করেছেন, অত্যাচারের পরে ধর্ষণের চিহ্ন লোপ করার চেষ্টা হয়েছে। তবে ডাক্তারদের আর একটি অংশের মত, আপাত ভাবে কিছু শারীরিক চিহ্ন দেখেই ধর্ষণের সত্য-মিথ্যা বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছনো চলে না। এ বিষয়ে বিশদ তদন্ত প্রয়োজন। |
|
|
|
|
|