|
|
|
|
ভয়ের আবহে দিন কাটছে সুবলপুরের
শমিকা মাইতি • লাভপুর |
ভয় পাচ্ছে সকলে। বেচাল হলে শাস্তির নমুনা দেখে ভয়। বেঁফাস কথা বলে বিপদে পড়ার ভয়।
অভিযোগকারীর পরিবারের লোকেদের বাড়িতে ফেরার ভয়। অভিযুক্তদের পরিণামের আশঙ্কায় পরিজনদের ভয়।
বীরভূমের লাভপুর ব্লকের চৌহাট্টা-মহেদরী ১ নম্বর পঞ্চায়েতের সুবলপুর গ্রামের লোকজনের চোখেমুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ।
যে আদিবাসী তরুণী গণধর্ষণের অভিযোগ করেছিলেন, তাঁর বাড়ির দিকে এগোতেই সন্ত্রস্ত হয়ে সরে গেলেন গ্রামের লোকেরা। বাড়ি ফাঁকাই। তালা-বন্ধ ঘরের ভিতর থেকে ভেসে আসছে ছাগলের ডাক। পড়শিদের কথা অনুযায়ী, ওই সংসারে তিন বোন, তিন ভাই আর মা। বাবা মারা গিয়েছেন আগেই।
বছর ছ’য়েক আগে ওই তরুণী এক যুবকের সঙ্গে চলে যান। বিয়ে হয়েছিল কিনা জানা নেই গ্রামবাসীর। তাঁকে নিয়ে কানাঘুষো। কেউ বলেন, তিনি দিল্লিতে পরিচারিকার কাজ করতেন ওই তরুণী। কারও সন্দেহ, কাজটা অন্য কিছু। মাস আটেক আগে তরুণী হঠাৎই ফিরে আসেন গ্রামে। রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ নেন। সম্পর্কটা গড়ে ওঠে ভিনসম্প্রদায়ের রাজমিস্ত্রির সঙ্গে। |
|
লাভপুর গণধর্ষণ-কাণ্ডে গ্রামের এই তালগাছেই তরুণী ও
তাঁর সঙ্গীকে বেঁধে রাখা হয় বলে অভিযোগ। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি। |
এই সম্পর্ক নিয়ে দিন কয়েক আগে পাড়ার ছেলেরা সাবধান করে দিয়েছিল একবার। তরুণী না কি সে আপত্তিতে গা করেননি। তরুণীর পরিবারও তাকে নিরস্ত করতে খুব বেশি উদ্যোগ দেখায়নি। সোমবার তাঁদের একসঙ্গে দেখতে পেয়ে ধরে ফেলে গাছে বাঁধা, সালিশি, জরিমানা এবং শেষ অবধি নির্যাতন করেছেন গ্রামের লোকেরা, এমনই অভিযোগ করেছেন বছর কুড়ির তরুণী।
আদিবাসী পাড়ার প্রতিটা বাড়িই প্রায় খেতমজুর, দিনমজুর। নিজেদের জমি নেই। অধিকাংশই হতদরিদ্র। মোড়ল বলাই মাড্ডিও মুনিষ খাটেন। বাড়ি বাড়ি ছাগল, মুর্গি। বিদ্যুৎ আছে, যদিও সুবলপুর গ্রামে টিভি নেই কোনও বাড়িতে। লেখাপড়া একেবারেই সামান্য, অধিকাংশই স্কুলছুট। গ্রামের অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীও অষ্টম শ্রেণি অবধি পড়েছেন। মনি মাড্ডি বলেন, “আমরা জানতাম সব মিটে গিয়েছে। পর দিন বুধবার পুলিশ গ্রামে ঢুকে ধরপাকড় শুরু করলে, আমরা হচকচিয়ে যাই।”
গণধর্ষণ যদি না-ই ঘটে থাকে, তা হলে ভয় কিসের? মুখ শুকিয়ে যায় আশপাশে জড়ো হওয়া বধূদের। শ্যামলা, শীর্ণকায়া এক বধূ মাথা নিচু করে বলেন, “ভয় তো সব সময় করে। বাইরের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে ভয় লাগে। বাড়িতে পুরুষ মানুষ না থাকলেই ভয়।”
ভয়ে আছেন অভিযোগকারিণীর বাড়ির লোকেরাও। সালিশি সভার ধার্য টাকা এখনও দেননি তাঁরা। আদিবাসী সম্প্রদায়ের নিয়ম অনুযায়ী পাড়ায় ঢোকা বারণ। তার উপরে থানায় গিয়ে অভিযোগ করেছেন নিজেদেরই লোকেদের বিরুদ্ধে। মোড়লদের কথায়, “বদনাম করেছে আদিবাসী সম্প্রদায়ের।”
ভয়ে আছেন অভিযুক্তদের বাড়ির লোকেরাও। বুধবার রাতে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গিয়েছে ১৩ জনকে। কেউ প্রৌঢ় কেউ যুবক। এমনকী, দু’তিন জন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীও রয়েছে ধৃত ১৩ জনের মধ্যে। বারো জন আদিবাসী পাড়ার হলেও একজন রয়েছেন পাশের গ্রাম রাজারামপুরের। মণ্ডল পাড়ার দেবরাজ মণ্ডল নামে ওই যুবক তৃণমূলের কর্মী। ঘুগনি বিক্রি করতেন গ্রামে। তার মা শ্যামলী মন্ডলের অভিযোগ “সত্যিই যদি গণধর্ষণ হত তা হলে ওই মেয়ে পর দিন দাদার সাইকেলে চেপে অভিযোগ জানাতে যাওয়ার মতো অবস্থায় থাকত না।” |
|
সিউড়িতে আদিবাসীদের প্রতিবাদী মিছিলের আগে ছবিটি তুলেছেন তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়। |
আদিবাসী পাড়ায় জরিমানা দিয়ে ছাড়া পাওয়ার পরেও ভয়ে রয়েছেন তরুণীর সেই পুরুষসঙ্গীর পরিবারও। চৌহাট্টা গাজিপাড়া গ্রামে নিজের বাড়িতে ফেরেননি ওই যুবক। আর স্বামীর চিন্তায় এক চিলতে ঘরের উঠোনে শয্যা নিয়েছেন রুগ্ন স্ত্রী। তিনি বলেন, “মেয়ের গয়না বিক্রি করে টাকা দিলাম পার্টির লোকদের। ও ছাড়াও পেয়েছে শুনেছি। তবে এ মুখো হয়নি।”
ভয় পেয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও। তাই এ দিন হাজার চেষ্টা করেও পঞ্চায়েত সদস্য অজয় মণ্ডলের সঙ্গে যোগাযোগ করা গেল না। বাড়িতে নেই তিনি। যোগাযোগ করা যায়নি তৃণমূলের পঞ্চায়েত প্রধান শেখ ফিরোজের সঙ্গেও।
ভয় ছড়িয়েছে আশপাশের এলাকাতেও। সুবলপুর গ্রাম থেকে প্রায় ৪ কিমি দূরে পিচ রাস্তার মুখে বাসের অপেক্ষায় ছিলেন স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মী স্মৃতি দাস। তিনি বলেন, “এত কাছে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল ভাবতেই ভয় লাগছে। চারপাশটা যেন কেমন বিষিয়ে গিয়েছে।” |
|
|
|
|
|