দেওয়ালে গ্লো-সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে‘ইমার্জেন্সি বিভাগ ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে’। কিন্তু তৈরি হওয়ার পর গত চার বছর ধরে তালাবন্ধ বেলপাহাড়ি ব্লকের শিমুলপাল অঞ্চলের ওদলচুয়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জরুরি বিভাগ ও দশ শয্যা বিশিষ্ট অন্তর্বিভাগ ভবন।
গত সেপ্টেম্বরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শিলদায় প্রশাসনিক জনসভা করতে এসেছিলেন। ওই সময় এলাকাবাসীর তরফ থেকে মুখ্যমন্ত্রীকে লিখিত স্মারকলিপি দিয়ে অবিলম্বে ওদলচুয়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জরুরি বিভাগ ও শয্যা-সহ অর্ন্তবিভাগ ভবনটি চালু করার অনুরোধ জানানো হয়। বেলপাহাড়ি পঞ্চায়েত সমিতির স্থানীয় তৃণমূল সদস্য ইন্দিরা মুর্মুও স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির পরিস্থিতি নিয়ে লিখিত ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তারপরও বন্ধ ভবনটির তালা খোলেনি। দীর্ঘ দিন তালাবন্ধ থাকায় ও ব্যবহার না হওয়ায় নতুন ভবনটির দরজা-জানলায় উই ধরেছে। ভিতরে শয্যাগুলিও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ইন্দিরাদেবী বলেন, “স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পুরনো ভবনে কেবল আউটডোরটি রয়েছে। কাছে-পিঠে স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতাল নেই। জরুরি ও অন্তর্বিভাগটি চালু হলে এলাকার বহু মানুষ উপকৃত হতেন।” জরুরি বিভাগ চালু করা যাচ্ছে না কেন?
স্বাস্থ্য দফতরেরই একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, মাওবাদী প্রভাবিত ওই এলাকায় রাতে থাকতে চান না চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। অন্তর্বিভাগটি চালু না হওয়ার মূল কারণ এটিই। ঝাড়গ্রাম স্বাস্থ্য জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক (সিএমওএইচ) সুমিত গঙ্গোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, “মূলত নার্সের অভাবে শয্যা চালু করা যাচ্ছে না। শীঘ্রই অন্তর্বিভাগটি চালু করার চেষ্টা চলছে।” |
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, মাওবাদী প্রভাবিত এলাকায় উপযুক্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার লক্ষে ওদলচুয়ার স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতে ২৪ ঘণ্টার জন্য জরুরি বিভাগ ও দশ শয্যা-বিশিষ্ট অন্তর্বিভাগ চালু করার সিদ্ধান্তটি বামফ্রন্ট সরকারের আমলে নেওয়া হয়েছিল। ২০০৯ সালে নতুন ভবন তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু স্বাস্থ্য দফতরের তরফে বার বার আশ্বাস দেওয়া হলেও জরুরি বিভাগ ও অন্তর্বিভাগ চালু হয়নি। তৃণমূলের সরকার ক্ষমতায় আসার পর ওদলচুয়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতে শয্যা চালু হবে বলে আশা করা গিয়েছিল। খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির পরিকাঠামো উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন না-হওয়ায় ক্ষুব্ধ শিমুলপাল অঞ্চলের ৪৭টি গ্রামের শতাধিক আবালবৃদ্ধবনিতা দেড় বছর আগে (২০১২ সালের জুলাই) বেলপাহাড়ি ব্লক-অফিস প্রাঙ্গণে অনশন-অবস্থান করেছিলেন। পশ্চিম মেদিনীপুরের তৎকালীন মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক (সিএমওএইচ) সবিতেন্দ্রনাথ পাত্র ওদলচুয়ায় গিয়ে সরেজমিনে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার পর দ্রুত নতুন ভবনে জরুরি বিভাগ ও দশ শয্যা-সহ অন্তর্বিভাগ চালু করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। তারপরও পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন হয়নি।
এ দিকে, ঝাড়খণ্ড রাজ্য লাগোয়া শিমুলপাল অঞ্চলের ৪৭টি প্রত্যন্ত গ্রামের প্রায় পনেরো হাজার মানুষ ওদলচুয়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপর নির্ভরশীল। অন্তর্বিভাগ না-থাকায় এলাকাবাসীকে রীতিমতো সমস্যায় পড়তে হয়। ওদলচুয়ার বাসিন্দা হরিপদ কিস্কু, মঙ্গলি হাঁসদা, কটুচুয়া গ্রামের বৈদ্যনাথ হেমব্রম, পূর্ণাপানি গ্রামের দিনুবালা মাহাতোরা জানালেন, ওদলচুয়া থেকে ১২ কিমি দূরের বেলপাহাড়ি গ্রামীণ হাসপাতালে পৌঁছনোর আগেই অনেক ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যু ঘটে। ওদলচুয়া থেকে ৩৭ কিমি দূরে ‘নিকটবর্তী উচ্চতর হাসপাতাল’ রয়েছে বিনপুরে। বিনপুরের ওই হাসপাতালটিও গ্রামীণ হাসপাতাল। ওদলচুয়া থেকে ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতালের দূরত্ব ৫৫ কিমি। শিমুলপাল অঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রাম গুলি থেকে উচ্চতর স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতালগুলির দূরত্ব আরও বেশি।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ওদলচুয়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পুরনো ভবনে কেবলমাত্র বহির্বিভাগটি সপ্তাহে ছ’দিন সকাল দশটা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত খোলা থাকে। বেলপাহাড়ি থেকে দু’জন চিকিৎসকের আসার কথা। তবে পালা করে রোগী দেখতে আসেন এক জন। নার্স আছেন এক জন। তিনিও প্রতি দিন আসেন না। রয়েছেন দু’জন স্বাস্থ্যকর্মী, এক জন ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান। সকলেই বাইরে থাকে যাতায়াত করেন। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের লাগোয়া আবাসনে কেউই থাকেন না। স্থানীয়েরা জানালেন, আগে এক জন স্বাস্থ্যকর্মী কোয়ার্টারে থাকতেন। রাত-বিরেতে তিনিই ছিলেন এলাকাবাসীর বড় ভরসা। কিন্তু গত বছর ওই স্বাস্থ্যকর্মী অবসর নিয়ে চলে গিয়েছেন। নিয়ম মতো, সকাল দশটায় বহির্বিভাগ খোলার কথা। সাড়ে এগারোটায় গিয়ে দেখা গেল, দু’জন চিকিৎসকের কেউই এসে পৌঁছননি। কেবলমাত্র এক স্বাস্থ্যকর্মী সুখময় নায়েক আউটডোরে বসে আছেন। তিনি জানালেন, “কোনও কারণে হয়তো দেরি হচ্ছে। চিকিৎসক এসে পড়বেন।” স্থানীয়েরা জানালেন, এমনটাই হয়। মুখ্যমন্ত্রীর হাজার প্রতিশ্রুতির পরেও প্রত্যন্ত এই জঙ্গলমহলের স্বাস্থ্য পরিষেবা সেই তিমিরে। |