‘কন্যা’ সন্তান জন্ম হওয়ায় মা ফেলে রেখে চলে যায়। সেই শিশুকন্যাকে বুকে তুলে নিলেন যিনি, তিনিও এক জন মা।
ওই শিশুকন্যার নাম ‘আরাধ্যা’। সমাজকল্যাণ দফতরের ‘আনন্দ আশ্রমে’ এক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে সোমবার দুপুরে প্রায় চার মাস বয়সের ‘আরাধ্যা’কে দত্তক নিলেন বহরমপুরের বানজেটিয়ার নেতাজি পল্লির বাসিন্দা অমিতকুমার বিশ্বাস ও গীতা বিশ্বাস। সন্তান পেয়ে খুশিতে উদ্বেল হয়ে ওঠে ওই দম্পতি। খুশি তাঁদের পড়শিরাও। কিন্তু ওই আনন্দের সঙ্গে মিশে আছে বেদনাও। ২০০৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর কলকাতায় বেড়াতে গিয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় তাঁদের ১১ বছরের সন্তান অরিত্র বিশ্বাস।
অমিতবাবুর কথায়, “তরতাজা ছেলেটা মারা যাওয়ার পরেই স্ত্রী মানসিক ভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সন্তানের জন্য চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সম্ভব হয়নি। চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির সিডবলিউসি-র দ্বারস্থ হই। ওই কমিটির সদস্যরা মালদহে ‘স্পেশালাইজড অ্যাডপশন এজেন্সি’ বা সংক্ষেপে সা-এর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। এর পরেই সেখানে নাম নথিভুক্ত করি।” |
চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি সূত্রে জানা গিয়েছে, চার মাস আগে কান্দি মহকুমা হাসপাতালের গেটের বাইরে একটি ঝোপের মধ্যে ওই কন্যা সন্তানটিকে পড়ে থাকতে দেখেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁদের কাছ থেকে খবর পেয়ে মুর্শিদাবাদ চাইল্ড লাইনের সদস্যরা প্রায় মুমূর্ষু ওই সদ্যোজাতকে উদ্ধার করেন। পরে কান্দি মহকুমা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রেখে সুস্থ করা হয়। এর পরে মুর্শিদাবাদ চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি দত্তক কেন্দ্র মালদহের সা-কে তুলে দেয়। এত দিন সেখানে রেখেই তাকে মানুষ করা হচ্ছিল। মুর্শিদাবাদ জেলা চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির চেয়ারপার্সন সিরাজুল ইসলাম বলেন, “সন্তানের জন্য ওই মহিলা মানসিক ও শারীরিক ভাবে ভীষণ ভাবে ভেঙে পড়েন। তাঁর অবস্থা দেখে সা-কে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ওই দম্পত্তিকে সন্তান দত্তক দেওয়ার জন্য আমাদের পক্ষ থেকেও অনুরোধ করা হয়েছিল। তাঁরা আমাদের অনুরোধ রেখেছেন।”
এ দিন অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন উদ্যানপালন দফতরের মন্ত্রী সুব্রত সাহা ও পুরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তৃণমূলের প্রদীপ নন্দী।
গীতাদেবীর কথায়, “ছেলেকে যেমন ছোট থেকে মানুষ করেছিলাম, মেয়েকেও ঠিক তেমন করেই মানুষ করব। ছোট্ট তুলতুলে মেয়েটি এখন আমার নিজের সন্তান। মনের মতো করে গড়ে তুলবো তাকে। কোনও খামতির জায়গা রাখব না।” বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পরেই কৌটোর দুধ গুলে নিজে হাতে খাওয়ানো থেকে কোলে শুইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা পর্যন্ত ঘরের বাইরের চৌকাঠ মাড়াননি তিনি। মেয়ে পেয়ে কেমন লাগছে? জানতে চাওয়া হলে গীতাদেবীর জবাব, “কোনও মমতাময়ী মায়ের পক্ষে নিজের সন্তানকে ফেলে রেখে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে চার বছর পরে আমার শূন্য কোল পূরণ হল। আমি খুব খুশি হয়েছি।”
পড়শিরাও আনন্দিত। শীতের পোশাকে ঢাকা ফুটফুটে ছোট্ট মেয়েটিকে দেখতে বাড়িতে সকলেই ভিড় করেন। গ্রিল কারখানার মালিক অমিতবাবু বলেন, “পরিবারের লোকজনও খুশি। দত্তক নেওয়ার আগে সকলের মতামত নিয়েছিলাম। কিন্তু কেউ সন্তান দত্তক নেওয়ার বিরোধিতা করেনি। পরিবারে একটা অপূর্ণতা ছিল। এতদিন পর আরাধ্যাকে পেয়ে তা পূরণ হল।” |