রাশিয়া জুড়ে তখন তুমুল অস্থিরতা। প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলত্সিন-এর সঙ্গে রুশ পার্লামেন্টের
রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে এল গণতান্ত্রিক রাশিয়ার নতুন
সংবিধান। আজ সেই প্রাপ্তির কুড়ি বছর পূর্ণ হল।
অসীম পাত্র। |
কুড়ি বছর আগে, ১৯৯৩ সালের ১২ ডিসেম্বর দিনটিতে রাশিয়ায় একটা বিপ্লব ঘটে গিয়েছিল। ক্রেমলিন ঘোষণা করেছিল ‘কনস্টিটিউশন অব দ্য রাশিয়ান ফেডারেশন’-এ জন্ম। কী ছিল সেই সংবিধানে? কী তার বিশেষত্ব? দুই দশক পূর্তির প্রাক্কালে এক বার মনে করে নেওয়া যাক।
চার বছর আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটেছে, গোটা রাশিয়া জুড়ে তখন তুমুল অস্থিরতা। প্রেসিডেন্ট পদে বরিস ইয়েলত্সিন আসীন। সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছে প্রেসিডেন্ট বনাম পার্লামেন্টের সংঘর্ষ, মাঝে মধ্যেই যা ভয়ানক রক্তক্ষয়ী আকার ধারণ করছে। মৃত্যু হয়েছে প্রায় দেড়শো জনের। এরই মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আনা সংবিধানের প্রথম খসড়ায় বোঝা গেল, প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বহু মাত্রায় খর্ব করতে চলেছে প্রস্তাবিত সংবিধান। প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে একটা বিকল্প খসড়া প্রস্তাবিত হল। কিন্তু সেটা গৃহীত হল না। সংকটের মুখে ‘কংগ্রেস অব পিপলস ডেপুটিজ’ এবং ‘সুপ্রিম কাউন্সিল’, দুই স্তরের প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান ভেঙে দিলেন প্রেসিডেন্ট ইয়েলত্সিন। অক্টোবরে আবার নতুন করে খসড়ার কাজ শুরু হল, বিভিন্ন পক্ষ তাতে অংশ নিল, এবং শেষ পর্যন্ত সর্বসম্মতিক্রমে একটা সংবিধান তৈরি করা গেল। সংবিধান বিষয়ে জনগণের মত কী, জানার লক্ষ্যে ১২ ডিসেম্বর ভোট নেওয়া হল। দেখা গেল সংবিধানের পক্ষে বিপুল সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে জনগণের রায়ে।
সুতরাং বেশি দেরি না করে ২৫ ডিসেম্বর ১৯৯৩ থেকেই প্রবর্তিত হল নতুন সংবিধান।
সোভিয়েতের ভাঙনের পর এই সংবিধানই সম্ভবত রাশিয়ার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। রাষ্ট্রের গড়ন কেমন হতে চলেছে, নাগরিক স্বাধীনতার ধরনটাই বা কেমন হবে, এই প্রথম স্পষ্ট করা হল। আইনের কাঠামো এর পর কী আকার নিতে চলেছে, তাও জানা গেল। প্রধান নীতিগুলি পরিষ্কার ভাষায় উচ্চারিত হল। |
এর পর থেকে ‘রাশিয়া’ বলতে বোঝাবে: আইনের শাসন, নাগরিক অধিকার ও বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা, গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রীয় রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের শাসন ও বিচার বিভাগের মধ্যে দূরত্ব রক্ষা, সাংবিধানিক নির্বাচনী প্রথা— অর্থাৎ সাংবিধানিক গণতন্ত্র বলতে যা যা বোঝা যায়। পূর্বসূরি সোভিয়েত ইউনিয়নের অভিজ্ঞতা থেকে অনেক দূরের পথ, সন্দেহ নেই।
রুশ ফেডারেশনের সামনে তখন দুটি লক্ষ্য। এক দিকে একটি কার্যকর বাজার অর্থনীতি তৈরি। অন্য দিকে একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক সমাজ তৈরি, যে সমাজের উপর ভর করে আন্তর্জাতিক বিশ্বে রাশিয়া নতুন করে পা রাখবে। ১৯৯৩ সালের সংবিধানটির উপর ভর করেই এই দুই লক্ষ্যের দিকে এগোতে শুরু করল নতুন রাশিয়া, যার এক পায়ের ভর নমনীয় ও সাংবিধানিক কাঠামোর উপর, আর এক পা রাখা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমতার উপর। সংবিধান অনুযায়ী তিনটি বিভাগে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বিন্যস্ত হল: আইনবিভাগ, শাসনবিভাগ ও বিচারবিভাগ। এদের মধ্যে ‘চেক ও ব্যালান্স’ পদ্ধতিতে পারস্পরিক নজরদারির কথাও ভাবা হল। আর সব কিছুর উপরে প্রেসিডেন্টের কাজ দাঁড়াল: বিভিন্ন বিভাগের বিভিন্ন লক্ষ্য ঠিক ভাবে মান্য হচ্ছে কি না, সে দিকে খেয়াল রাখা।
নতুন ব্যবস্থায় আইনকানুন ও বিচারব্যবস্থার কী রকম পরিবর্তন হল, সেটা একটু আলাদা করে দেখা দরকার। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, আদর্শভিত্তিক সব রকমের বহুত্ববাদের দিকে যাতে ক্রমশ এগোনো যায়, এবং সেগুলি রক্ষা করা যায়, সেটাই যাতে আইন এবং আইনের প্রয়োগের প্রধান লক্ষ্য হয়, সে দিকে নজর রেখেছিল এই সংবিধান। রাষ্ট্রের ক্ষমতা আসলে জনগণের ক্ষমতা: এই পুরনো নীতির দিকে আবার নতুন ভাবে যাত্রা। পাশাপাশি এও বলল সংবিধান যে, ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার কোনও চরম অধিকার নয়, তারও কিছু সীমা আছে। প্রধানত অন্য ব্যক্তির স্বাধীনতা লঙ্ঘন না করাই হল অধিকারের সীমা। এই জন্যই সংবিধানমতে অধিকারের সঙ্গে দায়িত্বের একটা মেলবন্ধন দরকার। এ ক্ষেত্রেও তা-ই হল। বলা হল, নতুন রাশিয়ায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যক্তি-অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করতে পারে বিশেষ কয়েকটি ক্ষেত্রে: নৈতিকতা, জনস্বাস্থ্য, অন্য ব্যক্তির স্বাধীনতা, জাতীয় প্রতিরক্ষা এবং অন্তর্দেশীয় নিরাপত্তা। ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর স্টেট দুমা অব রাশিয়ান ফেডারেশন-এর চেয়ারপার্সন সের্গেই নারিশকিন মন্তব্য করেন, ‘‘১৯৯৩ সালের সংবিধান না থাকলে রাশিয়ায় গণতন্ত্রের চিহ্নই থাকত না। কেননা, সোভিয়েত বা তৎপরবর্তী ঐতিহাসিক পরিবর্তন, কোনও কিছুর মধ্যেই কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বিভাজনের বিষয়টি ছিল না। অথচ এই বিভাজন না থাকলে গণতন্ত্র শুরু হতে পারে না। এখানেই এই সংবিধান-প্রণেতাদের গুরুত্ব।”
সম্প্রতি বহু রাজনীতিক কিংবা বিশেষজ্ঞ বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধনের কথা বলছেন। বেশ কিছু সংশোধন হয়েছেও বটে গত কয়েক বছরে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনটি হয় ২০০৮ সালে। স্টেট দুমা বা আইনসভার নিম্নকক্ষের মেয়াদ তাতে বাড়িয়ে চার থেকে ছয় বছর করা হয়েছিল, সঙ্গে তার প্রতিনিধির সংখ্যাও বেড়ে চার থেকে পাঁচ হয়েছিল, অর্থাৎ উচ্চকক্ষ ‘ফেডারেশন’-এর তুলনায় নিম্নকক্ষ ‘দুমা’র অবস্থান এবং নিয়ন্ত্রণের মাত্রা খানিকটা বেড়েছিল।
তবে সংবিধানে প্রেসিডেন্ট-এর ক্ষমতার যে ব্যাপকতা, সে বিষয়ে নানা সময়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। আইন-বিচার-শাসনের ত্রি-বিভাগীয় বিভাজনের উপরে রুশ প্রেসিডেন্ট-এর অবস্থান নিয়ে বার বার সংশোধনের দাবি উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে গণতন্ত্রের সীমা নিয়েও। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন প্রবল দৃঢ়তার সঙ্গে জানিয়েছেন যে, সংবিধানের কোনও মৌলিক নীতির ক্ষেত্রে কোনও ধরনের পরিবর্তনে তিনি একেবারেই রাজি নন। দুই দশকের শেষেও রুশ সংবিধান তাই অনেকখানি বিতর্কিত থেকে গেল। তবে স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিকতার যে স্বপ্ন সম্ভব করেছে এই কুড়ি বছর, তার জোরেই ভবিষ্যৎ রাশিয়ায় এই বিতর্ক আরও প্রসারিত হবে, এই আশা করাই যায়। |