আইন জারি হয়েছে। এ বার মেয়েদের ক্ষমতায়নের কাজে মন দেওয়া
চাই। লিখছেন ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত
ন্যান্সি জে পাওয়েল। |
গোটা দুনিয়া জুড়েই মেয়েরা হিংসার শিকার। কোনও দেশ বা অঞ্চল এই কলঙ্ক থেকে মুক্ত নয়। দুনিয়ার আনুমানিক তিন ভাগের এক ভাগ মেয়ে জীবনে যৌন নিপীড়ন বা অন্য ধরনের আক্রমণের শিকার হয়েছেন। শুধু এই পরিসংখ্যানটিই বলে দেয়, কেন আমাদের সকলকে একসঙ্গে এই সংকটের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। এ আমাদের যৌথ দায়।
২৫ নভেম্বর শুরু হয়েছিল মেয়েদের উপর হিংসার বিরুদ্ধে পক্ষকাল উদ্যাপনের বার্ষিক অনুষ্ঠান, আজ তার সমাপ্তি। কিন্তু এই পক্ষকাল আমাদের সেই সংগ্রামের প্রতি দায়বদ্ধতার উপরে জোর দেওয়ার সুযোগ দেয়, ঘরে হোক, বাইরে হোক, মেয়েদের উপর হিংসা কী ভাবে প্রতিরোধ করা যায়, তার জন্য সচেষ্ট হতে বলে। একটা দেশের অর্ধেক নাগরিক যদি একটা প্রান্তিক অবস্থায় নির্বাসিত হয়, তাদের ক্রমাগত অবিচার, লাঞ্ছনা এবং পক্ষপাতিত্বের শিকার হতে হয়, তা হলে সেই দেশের পক্ষে নিজের সম্ভাবনা চরিতার্থ করা অসম্ভব। এই কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিদেশ নীতিতে লিঙ্গসাম্য এবং মেয়েদের ক্ষমতায়নকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়।
মেয়েদের উপর হিংসার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে ঘরের ভিতরে, যার ফলে আক্রান্ত মেয়েরা সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়েন। যত মেয়ে খুন হয়, তার ৩৮ শতাংশ পারিবারিক হিংসার পরিণাম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পারিবারিক হিংসা দৈহিক আঘাত থেকে শুরু করে মানসিক অবসাদ— নানা ধরনের স্বাস্থ্য-সমস্যা সৃষ্টি করে। সমস্যাগুলির পারস্পরিক সম্পর্কও অনেক সময়েই রীতিমত প্রবল। যেমন, পারিবারিক হিংসা মেয়েদের যে মানসিক সংকটে ফেলে, অন্তঃসত্ত্বা মেয়েদের ক্ষেত্রে তার একটা বাড়তি প্রতিক্রিয়া থাকে— নবজাতকের ওজন কম থাকে, যা শিশুর স্বাস্থ্য এবং পুষ্টির পক্ষে ক্ষতিকর।
মেয়েদের উপর হিংসার ফলে মেয়েদের আয়, কর্মক্ষমতা এবং সাফল্যের সম্ভাবনা ব্যাহত হয়, বিচ্ছিন্নতা বাড়ে, কাজ করার সামর্থ্য বিপন্ন হয়, কাজে যোগ দেওয়ার সুযোগ কমে, নিজেদের ও শিশুদের দেখভাল করার সামর্থ্য কমে। তাই, মেয়েদের উপর হিংসা প্রতিরোধ করতে পারলে অর্থনীতির উপকার হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নারীর বিরুদ্ধে হিংসা সংক্রান্ত আইনের (১৯৯৪) বলে তদন্ত এবং শাস্তিদানের প্রক্রিয়া জোরদার হয়, এর ফলে আনুমানিক ১৬০০ কোটি ডলার বাঁচানো গেছে।
|
অনেক দেশেই মেয়েদের বিরুদ্ধে হিংসা প্রতিরোধের জন্য আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। সেই সব আইন বলবৎ করার জন্য বিভিন্ন দেশকে সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে তৎপর হতে হবে, যাতে প্রশাসনের দায়বদ্ধতা বাড়ে, অপরাধীরা শাস্তি পায়। দুনিয়া জুড়ে মেয়েদের উপর হিংসা প্রতিরোধ এবং প্রতিকারের জন্য ২০১২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক সামগ্রিক পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে। আমাদের সমবেত ভাবে কার্যকর প্রচার করতে হবে, যাঁরা সমাজের সর্বস্তরে কাজ করছেন তাঁদের সঙ্গে নীতিকারদের যোগাযোগ বাড়াতে হবে। একটা সামগ্রিক উদ্যোগ জরুরি। সেই উদ্যোগে পুরুষের ভূমিকা, ছেলেদের ভূমিকা, সমাজনেতাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। যে গভীর লিঙ্গবৈষম্যের মানসিকতা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে মেয়েদের উপর হিংসার জন্য দায়ী, তাকে সমাজের মন থেকে নির্মূল করাই আমাদের কর্তব্য।
সুস্থির গণতান্ত্রিক সমাজ, স্বচ্ছ এবং দায়বদ্ধ প্রশাসন, বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা, বাজার অর্থনীতির সমৃদ্ধি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের প্রসার— মেয়েদের ক্ষমতায়ন এই সব কিছুর পক্ষেই জরুরি। মেয়েরা সুস্থ, নিরাপদ জীবন যাপন করতে পারলে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান এবং ক্ষমতায়নে সমান সুযোগ পেলে পরিবার, সমাজ এবং জাতির সমৃদ্ধি আনতে পারে। মার্কিন বিদেশ সচিব জন কেরি বলেছেন, “দুনিয়া জুড়ে সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা এবং শান্তির প্রসার ঘটানোর লক্ষ্য পূরণে মেয়েদের উন্নতিতে বিনিয়োগ করা আমাদের একটা বড় কাজ।... তাঁরাই হয়ে উঠবেন ক্ষমতাঋদ্ধ জননী, নেত্রী এবং নতুন পথের দিশারি।” |