|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
কংগ্রেসের হার, বিজেপি-র জিত নয় |
রাজস্থানে কংগ্রেসের হার, ছত্তীসগঢ়ে রমন সিংহের অনুজ্জ্বল জয়— সব মিলিয়ে কি গরিব
মানুষের উন্নয়ন আর রাজনৈতিক অস্ত্র থাকছে না? সুশাসন আর দুর্নীতিহীনতাই মূল প্রশ্ন?
অমিতাভ গুপ্ত |
দিল্লিতে যে দিন বিধানসভা নির্বাচন ছিল, সে দিন সকাল থেকেই ফেসবুকের দেওয়ালে একের পর এক বার্তা ভেসে উঠছিল— আমার দিল্লিবাসী বন্ধুদের স্টেটাস আপডেট। এবং, একেবারে কোনও ব্যতিক্রম ছাড়া, প্রত্যেকেই জানিয়েছিল যে এ বার আম আদমি পার্টির (আপ) ঝাড়ুতে বোতাম টিপেছে সে। কিন্তু সেই বন্ধুরা দূরস্থান, খোদ অরবিন্দ কেজরিওয়ালও সম্ভবত বিধানসভা ভোটের ফলাফল আঁচ করতে পারেননি। এমনকী গত কয়েক বছরে নির্বাচনের মরসুমে টেলিভিশনের পর্দায় যাঁর উপস্থিতি বাঁধা ছিল, আম আদমি পার্টির সেই সেফোলজিস্ট নেতা যোগেন্দ্র যাদবও খুব জোর ১৭টা আসন পাওয়ার কথা বলে উঠতে পেরেছিলেন। তা-ও, সেটা ছিল উদ্দাম আশাবাদ। ঝাড়ুর এই ঝড় সব প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে গিয়েছে।
ভোটগণনার আগের দিন পর্যন্ত যে দলটিতে ‘রাজনৈতিক দল’ হিসেবে স্বীকার করতেই নারাজ ছিলেন কংগ্রেস এবং বিজেপি-র শীর্ষনেতারা, সেই দলের এমন চমকপ্রদ ফল অনেক রাজনৈতিক সমীকরণই সম্পূর্ণ ঘেঁটে দিয়েছে। কাজেই, দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে আপ-এর এই সাফল্যের গল্পটিকে ভেঙে দেখতেই হবে। অণ্ণা হজারের আন্দোলন থেকে, তাঁর অমতেই, রাজনৈতিক দল তৈরি করেছিলেন আইআইটি-র প্রাক্তনী অরবিন্দ কেজরিওয়াল, এবং আরও কয়েক জন। কিন্তু, অণ্ণার আন্দোলনের সুর থেকে বিচ্যুত হননি তাঁরা। আপ একটা গোটা নির্বাচন লড়ে ফেলল একটিমাত্র প্রতিশ্রুতির ওপর ভর করে— দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন। দলের ওয়েবসাইটে সব প্রার্থীর নাম-ধাম-জীবিকা এবং পুলিশ রেকর্ড তুলে দিয়েছিলেন তাঁরা। প্রত্যাশিত ভাবেই, কোনও প্রার্থীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনও অভিযোগ ছিল না। দিল্লি নির্বাচনে অন্য যে প্রশ্নগুলো গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তার অনেকগুলিকে এই দুর্নীতিবিরোধী জেহাদের সঙ্গেই বেঁধে নিয়েছিলেন কেজরিওয়াল। যেমন, তাঁর দাবি ছিল, বিদ্যুৎ বণ্টনের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই তিনি মাসুল কমিয়ে অর্ধেক করে দেবেন। সেটা আদৌ সম্ভব কি না, তা ভিন্ন প্রশ্ন— কিন্তু সমস্ত রাজনৈতিক ডিমকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদের ঝুড়িতে ঢুকিয়ে ফেলার নীতিটি নিঃসন্দেহে অভিনব।
সেই নীতি যে ফলপ্রসূ হয়েছে, ভোটের ফলাফলই বলছে। আম আদমি পার্টির ২৮টি আসনের চোখধাঁধানো ফলাফলের নীচে আর একটি তথ্য লুকিয়ে রয়েছে— এই আসনের সবক’টি কিন্তু পর্যুদস্ত কংগ্রেসের ঝুলি থেকে আসেনি। |
|
বিজয়ী। ফল ঘোষণার পর অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ছবি: রয়টার্স। |
বস্তুত, আপ-এর জেতা আসনগুলোর প্রায় অর্ধেক গত দফায় বিজেপি-র ছিল। বিজেপি-র বেশ কিছু ভোট আপ-এর দিকে এসেছে নিশ্চিত ভাবেই। নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর কেজরিওয়াল জানিয়েছেন, তাঁরা কংগ্রেস এবং বিজেপি, উভয় পক্ষের সঙ্গেই সমদূরত্ব বজায় রাখবেন। কিন্তু লক্ষণীয়, যেখানে তাঁদের রাজনীতির সব তিরের অভিমুখ ছিল কংগ্রেসের ‘অ্যাকিলিস হিল’ দুর্নীতির দিকে, সেখানে বিজেপি এবং তার প্রধান সেনাপতি নরেন্দ্র মোদীর প্রকট সাম্প্রদায়িক চরিত্র নিয়ে নির্বাচনের আগে রা কাড়েনি আপ। অণ্ণা হজারের আন্দোলনের পিছনে বিজেপি-র নাতিপ্রচ্ছন্ন সমর্থনের কথাও নিশ্চয়ই জনমানস থেকে সম্পূর্ণ মুছে যায়নি। কাজেই, দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল আপ-এর বিজেপি বিষয়ে অস্বচ্ছ অবস্থানের ভূমিকা কতটা ছিল, সে বিষয়ে জল্পনার অবকাশ অবশ্যই থাকছে।
কিন্তু কোনও রকম অনুমানের দ্বারস্থ না হয়েই বলে ফেলা যায়, আপ-এর আপাত রাজনীতিহীনতা তাদের সহায়ক হয়েছে। তার একটা কারণ হল, এই রাজনীতিহীনতা তাদের কংগ্রেস এবং বিজেপি-র থেকে আলাদা করেছে। নির্বাচনের প্রার্থী-তালিকায় অন্তত এমন এক জন মানুষ রয়েছেন যিনি পেশায় রাজনীতির ঘোলাজলের সওদাগর নন, এটাই অনেক ভোটারকে মনস্থির করতে সাহায্য করেছে। অনেকে এটা ভেবেও আশ্বস্ত হয়েছেন যে তাঁদের নিত্যদিন যে সমস্যাগুলোয় ভুগতে হয়, আপ অন্তত আর পাঁচ রকম বুলির চক্করে পড়ে সেগুলোর কথা ভুলে যাবে না। তবে, আপাত অরাজনৈতিক ভাবমূর্তির সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, ভোটারদের সিংহভাগই এখন মনেপ্রাণে অরাজনৈতিক। কংগ্রেস-বিজেপি-বামপন্থীদের সনাতন রাজনৈতিক ছকে তাঁদের আগ্রহ নেই। তাঁরা নিজেদের চাকরির উন্নতি, জীবনযাত্রার মান নিয়ে ভাবিত। এবং, সেই কারণেই তাঁরা অর্থনীতির পুনরুত্থান দেখতে চান। যেহেতু সাধারণ ধারণাই হল দুর্নীতির চাপে অর্থনীতি বেকায়দায় পড়েছে, তাই তাঁরা দুর্নীতিহীন প্রশাসন চান। ঠিক এই জনগোষ্ঠীকেই ধরতে চাইছেন নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর সাইবার বাহিনী। অরবিন্দ কেজরিওয়াল তাঁর ‘অরাজনৈতিক’ দল নিয়ে এই শ্রেণির মনের দরজাটি খুলে ফেলেছেন।
এই প্রসঙ্গে আরও একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। বছর কয়েক আগে আর একটি রাজ্যে দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকা দলের বিরুদ্ধে পথে নেমেছিলেন বিশিষ্ট নাগরিকরা— দিল্লিতে আপ-এর পক্ষেও যেমন নেমেছেন। সেই রাজ্যের শহরাঞ্চলে বিপুল প্রভাব পড়েছিল এই বিশিষ্টদের রাজনৈতিক অবস্থানের— ৩৪ বছরের পুরনো ‘লাল কেল্লা’ ধসে পড়েছিল। দিল্লিতে শীলা দীক্ষিতের কংগ্রেসের ভূলুণ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পতনের যতটা মিল, নাগরিক সমাজের সক্রিয়তার ক্ষেত্রেও দিল্লি আর কলকাতার মিল ততখানিই। ফারাক, কলকাতার বিশিষ্ট জনেরা ঢুকে পড়েছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের অভ্যন্তরে, আর দিল্লিতে তাঁরাই তৈরি করে নিয়েছেন একটি নতুন দল। শহরাঞ্চলে ভবিষ্যতে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে অবাক হওয়ার কারণ থাকবে না। |
লোকসভার হিসেব |
দিল্লির নির্বাচনে আম আদমি পার্টির জয়ধ্বজা ওড়া সেই দলের পক্ষে, সেই রাজ্যের পক্ষে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, কিন্তু জাতীয় রাজনীতি আপাতত একটি প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজছে— ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের জন্য দিল্লিসহ পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনের ফলাফলের তাৎপর্য কী? কংগ্রেসের পক্ষে বার্তাটি মর্মান্তিক— নির্বাচনে জেতা অনেক পরের কথা, আপাতত জামানত বাঁচানোর দিকে মন দেওয়া ভাল। রাজস্থানে অশোক গহলৌত-এর পরাজয় চিন্তার কারণ হওয়াই স্বাভাবিক। ইউপিএ সরকারের সাড়ে নয় বছরের রাজত্বের পক্ষে যদি জোর গলায় বলার মতো একটিও কথা থাকে, তা হল— এই সরকার দেশের কল্যাণ অর্থনীতিকে সত্যিই জনমুখী করে তুলেছে। কাজের অধিকার থেকে শিক্ষার, খাদ্যের অধিকার, সবই এই সরকারের আমলে হয়েছে। অশোক গহলৌত এই ধারার বিশ্বস্ত সাধক ছিলেন। বস্তুত, তিনি আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে নিখরচায় ওষুধ ইত্যাদির ব্যবস্থাও করেছিলেন। কিন্তু বসুন্ধরা রাজের হাতে তাঁর ভরাডুবি থেকে স্পষ্ট, এতেও ভোটের চিঁড়ে ভেজার নয়। অবশ্য, এই প্রসঙ্গে ছত্তীসগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহের কথাও আসবে। তাঁর দরিদ্র এবং বিমারু গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত রাজ্যে তিনি কার্যত গণবণ্টন ব্যবস্থার বিপ্লব করেছেন গত পাঁচ বছরে। বস্তুত, তাঁর এই সাফল্য তাঁকে বিজেপি-র অভ্যন্তরে নরেন্দ্র মোদীর প্রতিস্পর্ধীও করে তুলেছিল। রমন সিংহ জিতেছেন বটে, কিন্তু গত বারের চেয়ে ফল ভাল হয়নি মোটেও। তবে কি গরিব মানুষের জন্য উন্নয়ন (অথবা, তাদের পাইয়ে দেওয়া) নির্বাচনে জেতার গ্যারান্টি দিতে ব্যর্থ— এই প্রশ্নটা তুলে দিল রাজস্থান-ছত্তীসগঢ়ের নির্বাচনী ফলাফল।
প্রশ্ন উঠবে আরও এক জনকে নিয়ে— তাঁর নাম নরেন্দ্র মোদী। দিল্লি বাদে তিনটি প্রধান রাজ্যেই বিজেপি-র প্রশ্নাতীত জয়ও যে কথাটি ঢেকে দিতে পারছে না, তা হল— এই চারটি রাজ্যেই চিরাচরিত লড়াই কংগ্রেস আর বিজেপি-র মধ্যে। ইউপিএ সরকারের ব্যর্থতা, এবং ব্যর্থতা বিষয়ে মানুষের ধারণাই সেখানে বিজেপি-র পালে হাওয়া টেনেছে। কিন্তু এই ভোট যে আসলে বিজেপি-র পক্ষে নয়, কংগ্রেসের বিপক্ষে, সেটা দেখিয়ে দিয়েছে দিল্লি। একমাত্র দিল্লিতেই একটি গ্রহণযোগ্য তৃতীয় বিকল্প ছিল এই দফায়। মানুষের রায় কী হয়েছে, সে বিষয়ে সংশয়ের কোনও অবকাশই নেই। দিল্লির অশোক রোড এবং নাগপুরের মঙ্গলওয়ারি, দু’জায়গাতেই নিঃসন্দেহে হিসেব চলছে অন্য রাজ্য নিয়ে, যার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লড়াই দ্বিমুখী নয়। বেশ কিছু রাজ্যে বিজেপি-র কার্যত অস্তিত্বই নেই। যেখানে আছে, সেখানেও আঞ্চলিক দলগুলির শক্তি উপেক্ষা করার নয়। দিল্লির মতো রাজ্যে, নরেন্দ্র মোদী তাঁর পূর্ণ শক্তিতে নির্বাচনী প্রচারে নামার পরেও, যদি বিজেপি সরকার গড়ার মতো অবস্থায় না যেতে পারে, তবে ‘মোদী ম্যাজিক’ কোথায়? কী ভাবে জেতাবেন তিনি? বিজেপি নেতৃত্ব বিলক্ষণ জানে, এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য হাতে আর তেমন সময় নেই। মোদী যে বিজেপি-র সব সমস্যার সমাধান নন, তা স্পষ্ট।
যেমন স্পষ্ট, আপ-এর এই ম্যাজিক সম্ভব হয়েছে রাজ্যটির নাম দিল্লি বলেই। এখানের ভোটারদের সিংহভাগ বহিরাগত, এবং প্রায় পূর্বাশ্রম-পরিচয়রহিত। দিল্লির নির্বাচনে জাতের প্রশ্ন ওঠেনি তেমন ভাবে। বড় জোর পূর্ব উত্তর প্রদেশ আর বিহারের পূর্বাঞ্চলী বাসিন্দাদের কথা মাথায় রেখে প্রার্থী বাছতে হয়েছে। কিন্তু লোকসভা নির্বাচন অন্য খেলা। বিহারের গ্রামে অথবা কর্নাটকের আধা মফস্সলে আরও অনেক প্রশ্ন কাজ করবে। আত্মপরিচয়ের রাজনীতি থাকবে, ধর্মীয় রাজনীতি থাকবে, বিধানসভা-পঞ্চায়েতের নির্বাচনের জের থাকবে। আপ, বা অন্য কোনও দলের পক্ষেই এই সমীকরণগুলো অবজ্ঞা করে শুধু দুর্নীতির প্রশ্ন তুলে সেই নির্বাচন পার হওয়া সম্ভব হবে না। অর্থাৎ, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, দিল্লির বিধানসভা নির্বাচন ব্যতিক্রমীই। শুধু একটি ক্ষেত্রে নয়। দিল্লির মতোই, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনও কংগ্রেস আর বিজেপি-র দ্বিমুখী ডুয়েল হবে না। নরেন্দ্র মোদী না রাহুল গাঁধী, লোকসভা নির্বাচন শুধু এই প্রশ্নের ফয়সলা করার জন্যই অনুষ্ঠিত হবে না। বরং, অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠবে তৃতীয় শক্তিগুলি— বিভিন্ন আঞ্চলিক দল। কংগ্রেস-বিরোধী হাওয়া নিঃসন্দেহে বইছে, কিন্তু সেটা শুধু বিজেপি-র পালেই লাগবে না। বরং, নরেন্দ্র মোদীর হাত ধরে ফের উগ্র হিন্দুত্ববাদের জমানায় ফেরত গিয়ে বিজেপি সুবিধা করে দিল এই আঞ্চলিক দলগুলিকে— দুর্নীতিগ্রস্ত কংগ্রেস এবং সাম্প্রদায়িক বিজেপি-র বাইরে গ্রহণযোগ্য বিকল্প হয়ে ওঠার সুযোগ তাদের সামনে। |
|
|
|
|
|