চলতি বছরের শেষ মাসটি বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রের নানা পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্য দিয়া অগ্রসর হইতেছে। ভারতের চার রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচনের ফলাফল আরও এক বার দেখাইয়া দিল, নানাবিধ ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও ভারতীয় গণতন্ত্র সচল এবং সজাগ রহিয়াছে, কারণ মানুষের পছন্দের অধিকার শিরোধার্য করাই যাহার মূল কথা। বিশ্বের আরও যে সকল দেশে এই মুহূর্তে গণতন্ত্রের সহিত স্বৈরতন্ত্র, ফৌজি অন্তর্ঘাত, সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের সংঘাত চলিতেছে, সেগুলির সহিত তুলনা করিলে ভারতীয় গণতন্ত্রের উৎকর্ষটি আরও মূর্ত হইয়া ওঠে। দূর হইতে দেখিলে, কেবল পর্বত নয়, অনেক কিছুর স্বরূপই স্পষ্ট হয়। এই জন্যই ভারতের অভিজ্ঞতাকে অন্যান্য দেশের দৃষ্টান্তের সহিত মিলাইয়া দেখা ভাল।
যেমন ইউক্রেন। সেই দেশের মানুষ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহিত নিবিড় সম্পর্ক চাহিলেও প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ রাশিয়ার প্রতি সাবেক আনুগত্যে অবিচল থাকিতে পুলিশ-মিলিটারি দিয়া গণবিক্ষোভ দমন করিতেছেন। রাজধানী কিয়েভ শহরে অন্তত পাঁচ লক্ষ ইউক্রেনীয় তুষারপাত ও প্রবল শৈত্য উপেক্ষা করিয়া তাঁহাদের দাবি জানাইতেছেন। প্রশাসন অনড়। সমবেত বিক্ষোভকারীরা লেনিনের মূর্তি উপড়াইয়া দিলেও রাশিয়ার প্রতি শাসকদের আনুগত্যে চিড় ধরিতেছে না। তাইল্যান্ডে আবার বিপরীত চিত্র। সে দেশে প্রধানমন্ত্রী ইঙ্গলাক শিনাবাত্রার নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারকে ইস্তফায় বাধ্য করিতে বিরোধী পক্ষের জনপ্রতিনিধিরা সংসদ হইতে পদত্যাগ করিয়া রাস্তার বিক্ষোভ আন্দোলনে অবতীর্ণ। প্রধানমন্ত্রী ইস্তফা দিতে সম্মত, গণভোট অনুষ্ঠান করিয়া বিক্ষোভকারীদের দাবির প্রতি সমর্থন যাচাই করিতেও। কিন্তু বিরোধী রাজনীতিকরা জানেন, ভোটে শিনাবাত্রার দলের জয় অবশ্যম্ভাবী, দেশের দরিদ্র সংখ্যাগরিষ্ঠরা তাঁহারই সমর্থক। তাই ভোটে যাওয়ার ঝুঁকি না লইয়া তাঁহারা একটি অন্তর্বর্তী অনির্বাচিত ‘জনপ্রিয় সরকার’ কায়েম করিতে উৎসুক। তাঁহাদের নেপথ্যে তাইল্যান্ডের সেনাবাহিনীর প্রচ্ছন্ন সমর্থনও থাকা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে গণদাবির অন্তরালেই গণতন্ত্রে অন্তর্ঘাতের অপপ্রয়াস লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশ আবার, দৃশ্যত, এই অন্তর্বর্তী তদারকি সরকারের দাবিতে দ্বিধাবিভক্ত। বিরোধীরা জামাতপন্থীদের সহায়তায় দেশকে ধারাবাহিক অচলাবস্থা ও হিংসার তাণ্ডবে নিমজ্জিত করিয়াছেন। সরকার পক্ষও পুলিশি দমন নীতির উপরেই ভরসা করিয়াছে। রাজপথে, গলিতে, মাঠে রক্ত ঝরিতেছে। রেলপথে নাশকতা চলিতেছে। বিক্ষোভের নামে বিশৃঙ্খলা ও হিংসার উসকানি অব্যাহত। জামাতপন্থী নেতাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকার দায়ে ফাঁসিতে ঝুলাইবার তৎপরতায় পরিস্থিতি আরও অগ্নিগর্ভ।
গণতন্ত্র এই সব দেশেই অস্তিত্বের সঙ্কটের সম্মুখীন। ইতিপূর্বে মিশরে আরব বসন্তের গণতান্ত্রিক পালাবদলের উলট্-পুরাণ প্রত্যক্ষ করা গিয়াছে। সেনানায়করা নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে বরখাস্ত ও বন্দি করিয়া ফৌজি স্বৈরাচার কায়েম করিতে পাশ্চাত্য-ঘেঁষা তথাকথিত গণতন্ত্রীদেরই সাহায্য লইয়াছেন। এই প্রেক্ষিতে ভারতীয় গণতন্ত্রের শক্তি ও সাধনার, ঐতিহ্য ও ভাবনার তাৎপর্য আরও প্রকট হইয়া ওঠে। নিশ্চয় এই গণতন্ত্রের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। অবকাশ আছে ইহাকে আরও উন্নত করার, ইহার ব্যাপ্তি ও গভীরতা আরও বৃদ্ধি করার। কিন্তু সমস্যা, ত্রুটি, সীমাবদ্ধতা লইয়া যেটুকু ইতিমধ্যে অর্জিত, তাহার মূল্য কম নয়। |