খয়রাতি তত্ত্বও খারিজ, বক্তার আসনেও ভগবতী
কাকতালীয় নাকি প্রতীকী!
গত চার বছর ধরে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক ‘দিল্লি ইকনমিক কনক্লেভ’-এর আয়োজন করে আসছে। ২০১০ সালের প্রথম সম্মেলনে প্রধান বক্তা ছিলেন অমর্ত্য সেন। সনিয়া গাঁধীর খাদ্য সুরক্ষা নীতির লড়াকু সমর্থক। আর এ বার ইউপিএ জমানার শেষ সম্মেলনে যে আমন্ত্রিত অর্থনীতিবিদকে নিয়ে প্রবল আগ্রহ তৈরি হয়েছে, তাঁর নাম জগদীশ ভগবতী। যিনি খাদ্য সুরক্ষা আইনের মতো সস্তায় পাইয়ে দেওয়া রাজনীতির প্রবল সমালোচক। মোদীর মতো শিল্পায়ন ও আর্থিক বৃদ্ধির মাধ্যমে উন্নয়নে বিশ্বাসী। পরশু থেকে শুরু হবে কনক্লেভ, যার প্রধান বিষয়, আগামী পাঁচ বছরের আর্থিক কর্মসূচি। সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম।
রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ় ও দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস যে ভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে, তাতে সনিয়া গাঁধীর সস্তায় পাইয়ে দেওয়ার অর্থনীতি দিয়ে মানুষের মন জয় করা যাচ্ছে কি না, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। এই ফল অমর্ত্য সেনের তত্ত্ব খারিজ করে ভগবতীর অর্থনৈতিক মডেলের প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই। দৈনিক ১০০ টাকা রোজগার, এক টাকা-দু’টাকায় চাল-গম, নিখরচায় পড়াশোনা, ওষুধের ব্যবস্থা করে দিয়ে সনিয়া গাঁধী গরিব মানুষের উপকারের রাস্তা বেছে নিয়েছিলেন। এই চারটি রাজ্যের মধ্যে রাজস্থান ছিল সনিয়ার অন্যতম পরীক্ষাগার। অরুণা রায়, নিখিল দে-র মতো রাজস্থানে কর্মরত সামাজিক কর্মীদের তিনি তাঁর জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদ-এ জায়গা দিয়েছিলেন। রাজস্থানই একমাত্র রাজ্য, যেখানে বিনামূল্যে ওষুধ বিলির প্রকল্প নিয়েছিল কংগ্রেস সরকার। তা সত্ত্বেও মরু-রাজ্যে কংগ্রেসের বিপর্যয়েই প্রমাণ, মানুষের মন মজেছে নরেন্দ্র মোদীর আর্থিক বৃদ্ধি ও শিল্পায়নের মডেলেই। যা থেকে আসবে চাকরি, রোজগার, নিজের চাল-গম ট্যাঁকের জোরে কেনার ক্ষমতা। ভোটের বাক্সে কংগ্রেসকে খারিজ করে মানুষ বার্তা দিয়েছেন, সনিয়া গাঁধীর উন্নয়ন-প্রকল্পের জন্য কোটি কোটি টাকার ভর্তুকির ঠেলায় চড়া মূল্যবৃদ্ধির বোঝা তাঁরা বইতে নারাজ।
সস্তায় চাল-গম বিলি নাকি চাল-গম কেনার জন্য রোজগারের বন্দোবস্ত করে দেওয়া, কোনটা লক্ষ্য হওয়া উচিত সরকারের রাজনীতির এই বিতর্কটা অর্থনীতির গণ্ডিতেও ঢুকে পড়েছিল। নোবেল-জয়ী অমর্ত্য সেনের সঙ্গে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক জগদীশ ভগবতীর যুক্তির লড়াইয়ের মূল বিষয়ই ছিল এটা। অমর্ত্য বলছিলেন, আরও বেশি সংখ্যক গরিব মানুষকে অর্থনীতির মূলস্রোতে নিয়ে এসো। তাদের ব্যয় ক্ষমতা বাড়ুক। তা থেকেই আর্থিক বৃদ্ধি আসবে। যার জন্য তিনি খাদ্য সুরক্ষা আইনকে সমর্থন করেছিলেন। অমর্ত্যের এই যুক্তি উড়িয়ে দিয়ে ভগবতী খাদ্য সুরক্ষা আইনের কড়া সমালোচনা করেছিলেন। ভগবতীর যুক্তি ছিল, আগে শিল্পায়ন, সংস্কারের মাধ্যমে আর্থিক বৃদ্ধি বাড়ানো হোক। তার পর সেই সুবিধা সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা হোক। এই পথে হাঁটার জন্য তিনি মুক্ত কণ্ঠে মোদীর প্রশংসা করতেও পিছপা হননি।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, ভগবতীর জন্য লাল কাপের্র্ট বিছিয়ে কি নীতি বদল করতে চাইছে কংগ্রেস? লোকসভা নির্বাচনের পাঁচ মাস আগে কি সেই রাস্তা বদল সম্ভব? কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশের যুক্তি, “এখন নীতি বদল সম্ভব নয়। তার প্রয়োজনও নেই। কারণ এটা সকলের জন্য উন্নয়নের নীতির ব্যর্থতা নয়। তার রূপায়ণের ব্যর্থতা।” তাঁকে সমর্থন করছেন জেএনইউ-এর অধ্যাপিকা জয়তী ঘোষ। তাঁর যুক্তি, “মানুষ মোটেই সামাজিক সুরক্ষার প্রকল্পকে খারিজ করেনি। সমস্যাটা রূপায়ণের ক্ষেত্রে। ছত্তীসগঢ়-মধ্যপ্রদেশে তো বিজেপির রাজ্য সরকার সস্তায় খাবারের বন্দোবস্ত করেই সাফল্য পেয়েছে। রমন সিংহ এ বিষয়ে পথিকৃতের ভূমিকা নিয়েছেন।” তা হলে রাজস্থানে বিনামূল্যে ওষুধ বিলিয়েও ফল মিলল না কেন? জয়তীর ব্যাখ্যা, “রাজস্থান সরকার দক্ষ ভাবে প্রশাসন চালাতে পারেনি। তাই নীতি রূপায়ণে ব্যর্থ। সেটা নীতির ব্যর্থতা বলে আমি মানতে রাজি নই।”
২০০৩ সালে সিমলায় কংগ্রেসের চিন্তন শিবিরেই সামাজিক সুরক্ষায় অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল। এনডিএ জমানার শেষে বিজেপি আর্থিক বৃদ্ধির হারকে সামনে রেখে ‘ভারত উদয়’-এর জয়ঢাক বাজিয়েছিল। কিন্তু অভিযোগ উঠেছিল, প্রদীপের নিচে কৃষক আত্মহত্যা, গরিবের দুর্দশার মতো অন্ধকার রয়েই গিয়েছে। ইউপিএ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তাই এ বিষয়ে সনিয়া গাঁধীর নেতৃত্বে জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদ (এনএসি) কাজ শুরু করে। একশো দিনের কাজ, শিক্ষার অধিকার, অরণ্য অধিকার আইনের মতো সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প নেন সনিয়া। ২০০৪ সালে তারই সুফল কুড়িয়েছিল কংগ্রেস। সেই সাফল্যে উদ্দীপ্ত হয়েই দ্বিতীয় জমানায় খাদ্য সুরক্ষা আইন কার্যকর করতে নেমেছিলেন সনিয়া। সেমিফাইনাল বলছে, সেই দাওয়াই আর কাজ করছে না। সুরজিৎ ভাল্লার মতো অর্থনীতিবিদ বলছেন, “সস্তায় পাইয়ে দেওয়ার অর্থনীতি খারিজ করেছেন মানুষ। এর মধ্যে কোনও অস্পষ্টতা নেই।”
অর্থনীতিবিদদের মতে, গরিবদের সস্তায় পাইয়ে দেওয়ার প্রকল্প চালাতে গিয়ে ইউপিএ সরকার পরিকাঠামো বা স্থায়ী সম্পদ তৈরি করতে পারেনি। এমনিতেই যখন আর্থিক মন্দা চলছে, সরকারের আয়ের থেকে ব্যয় বেশি হচ্ছে, বাড়ছে ঘাটতি, সেই সময় আরও বেশি ভর্তুকি দিতে গিয়ে চড়া হারের মূল্যবৃদ্ধিকেই ডেকে আনা হচ্ছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর থাকার সময় ডি সুব্বারাও এই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর যুক্তি ছিল, একশো দিনের কাজ, খাদ্য সুরক্ষা আইনের ধাক্কায় জিনিসপত্রের দাম লাগামছাড়া হবে। একশো দিনের কাজের ফলে গরিব মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে যাবে। অন্য দিকে খাদ্য সুরক্ষা আইন কার্যকর হলে বাজারে খাদ্যশস্যের জোগানে টান পড়তে পারে। ভর্তুকির ধাক্কায় বাড়তে পারে রাজকোষ ঘাটতি। এই তিনটির একটিই ফল মূল্যবৃদ্ধি। উল্টো দিকে একশো দিনের কাজের মতো প্রকল্পের ক্ষেত্রে অভিযোগ, শুধু মাটি কাটা হয়েছে। কোনও পরিকাঠামো বা স্থায়ী সম্পদ তৈরি হয়নি।
সনিয়ার সঙ্গে যাঁরা অতীতে জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদে কাজ করেছেন, তাঁরাও পুরোপুরি ইউপিএ-র পাশে দাঁড়াচ্ছেন না। এনএসি-র প্রাক্তনী, পরিবেশ-বিজ্ঞানী মাধব গ্যাডগিলের যুক্তি, “এমন নয় যে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে আমজনতার কোনও উপকার হয়নি। কিন্তু অনেক রাজ্যে প্রকল্পগুলির রূপায়ণ অন্তর্ঘাতের শিকার হয়েছে।” তাঁর মতে, অরণ্যের অধিকার আইন আরও ভাল করে কার্যকর হলে মধ্য ভারতে সুফল মিলত। তা হয়নি। তবে খাদ্য সুরক্ষাকে সামাজিক সুরক্ষার আইনি স্বীকৃতি বলে মানতে রাজি নন মাধবও। তাঁর মতে, “এটা আসলে উপহার বিলি করা ছাড়া কিছুই নয়।”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.