মোদীর সুশাসনকে হাতিয়ার করেই এগোতে চায় বিজেপি
চার রাজ্যের সেমিফাইনালে কংগ্রেসকে ধরাশায়ী করে এ বার আসল লড়াইয়ের জন্য তৈরি হচ্ছে বিজেপি। আর সেই যুদ্ধে সুশাসনকেই মূল স্লোগান হিসেবে তুলে ধরতে চায় তারা। কারণ, এ বারের ভোটে কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকারের নীতিপঙ্গুত্ব, দুর্নীতি, আর্থিক সঙ্কট এবং মূল্যবৃদ্ধি সামলাতে ব্যর্থতার বিরুদ্ধেই আম জনতা রায় দিয়েছে বলে মনে করছেন বিজেপি নেতৃত্ব।
নরেন্দ্র মোদীর প্রচারের কৌশল রচনার অন্যতম রূপকার রাজ্যসভায় বিজেপি দলনেতা অরুণ জেটলি বলছেন, “পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি যে অচল পয়সা, সেটা এ বারের নির্বাচনে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। আগামী লোকসভা ভোটে তাই আমাদের মূল কথাই হবে সুশাসন এবং উন্নয়ন। নরেন্দ্র মোদীর গুজরাত যার উজ্জ্বল উদাহরণ।” মোদী নিজেও বলছেন, “এখন আমার লক্ষ্য শুধু সুশাসন, সুশাসন এবং সুশাসন।” সঙ্ঘ নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনাতেও প্রচারের এই কৌশল ছাড়পত্র পেয়েছে বলে বিজেপি সূত্রের খবর। ভবিষ্যতে প্রয়োজনে শরিক সন্ধানের ক্ষেত্রেও এই নীতিই কাজে আসবে বলে তাঁদের আশা।
বিজেপি-র এই কৌশলে কংগ্রেসের দুশ্চিন্তা যে বাড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। মোদীকে যখন প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে তুলে ধরা হয়, তখন কংগ্রেস নেতারা ভেবেছিলেন, এ বার ভোটের তীব্র মেরুকরণ হবে। হিন্দুত্বকেই প্রচারের মূল বিষয় করবেন মোদী। এবং তাঁকে ঠেকাতে ধর্মনিরপেক্ষ সব শক্তি কংগ্রেসের পতাকার তলায় এক জোট হবে।
কিন্তু চার রাজ্যের ভোটপ্রচারে কট্টর হিন্দুত্ব সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছেন মোদী। কোথাও অযোধ্যা-রামমন্দিরের কথা বলেননি। মুসলমানের হাত থেকে টুপি পরতে চাননি বটে, কিন্তু হিন্দুয়ানিও দেখাননি। ফলে প্রচারের অভিমুখ সাম্প্রদায়িকতা বনাম ধর্মনিরপেক্ষতার দিকে নিয়ে যাওয়ার যে কৌশল কংগ্রেস গ্রহণ করেছিল, তা মাঠে মারা গিয়েছে। বিজেপি নেতারা বলছেন, কংগ্রেসের মেরুকরণের রাজনীতি জনতা প্রত্যাখ্যান করেছে। ভোট দিয়েছে দুর্বল সরকারের কুশাসনের বিরুদ্ধে।
কিন্তু কংগ্রেস-বিরোধী এই হাওয়া কি লোকসভা ভোট পর্যন্ত বইবে? অন্য রাজ্যেই বা তার প্রভাব কতটা?
হিন্দি বলয়ের যে চার রাজ্যে এ বার ভোট হয়েছে, তাতে লোকসভার মোট আসন ৭২। তার ৬৫টিই পেয়েছে বিজেপি। কিন্তু তার একমাত্র কারণ মোদী, এমনটা মানতে অনেকেই নারাজ। তাঁদের মতে, এই ভোট যতটা কংগ্রেস-বিরোধী, ততটা বিজেপি-পন্থী নয়। দিল্লির চাপিয়ে দেওয়া রাজনীতির কারণে স্থানীয় নেতার অভাব, গোষ্ঠী কোন্দল কংগ্রেসের এই দশা করেছে। কিন্তু যেখানে কংগ্রেস-বিজেপির বাইরে অন্য গ্রহণযোগ্য বিকল্প মানুষ পেয়েছে, যেমন দিল্লি, সেখানে তাদেরই ভোট দিয়েছে। এই সূত্র ধরে বিজেপির একাংশ মনে করছে, লোকসভা ভোটে হিন্দি বলয়ের অন্যত্র দলের যাত্রা মসৃণ না-ও হতে পারে।
মোদী-ঘনিষ্ঠরা অবশ্য এমন আশঙ্কার কথা মানতে নারাজ। অরুণ জেটলির দাবি, হিন্দি বলয়ের দুই রাজ্য উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারে বিজেপি একচেটিয়া ভাবে জিতবে। কিন্তু দলের সংশয়ী মহল এটাও মনে করাচ্ছেন যে, ২০০৩ সালের বিধানসভা ভোটে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়ে ৭৯ শতাংশ আসনে জেতার পরেও ২০০৪ সালে লোকসভায় হেরেছিল বিজেপি। তাঁরা এটাও মনে করাচ্ছেন যে, হিন্দি বলয়ের বাইরে অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু কেরল ও পশ্চিমবঙ্গ, যে চার রাজ্যের মোট আসনসংখ্যা ১৪৩, সেখানে বিজেপির আসন এখন মাত্র ১। এবং যা খুব বাড়ার সম্ভাবনা তেমন নেই।
লালকৃষ্ণ আডবাণী, সুষমা স্বরাজদের বক্তব্য, দলের আসন ২০০ না-ও ছাড়াতে পারে, এই আশঙ্কা মাথায় রেখেই মোদীর নাম ঘোষণা না-করার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন তাঁরা। কারণ, মোদীর নামে শরিক জোটানো কঠিন হবে।
মোদী-পন্থীরা যার পাল্টা বলছেন, নিজের আসনের জোর যত বেশি হবে, শরিক পাওয়া এবং তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার সম্ভাবনা তত বাড়বে। আর আসন বাড়ানোর জন্য মোদীর চেয়ে বড় বাজি কে-ই বা হতে পারেন! মোদীর সুশাসনের বার্তাই শরিক প্রাপ্তির পথ সুগম করবে বলে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের দাবি। মোদী নিজে বলছেন, “আমি শরিক বা আঞ্চলিক দলের বিরোধী নই। বরং কংগ্রেসই সহযোগী দলগুলি সম্পর্কে বরাবর উদ্ধত মনোভাব নিয়েছে। এনডিএ আমলে শরিকদের সঙ্গে সম্পর্ক ইউপিএ আমলের তুলনায় অনেক ভাল ছিল।” মোদীর মতে, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার জন্য কংগ্রেসের মধ্যে সামন্ততান্ত্রিক মনোভাব তৈরি হয়েছে। অন্য দিকে, বিজেপি আঞ্চলিক সত্তা বজায় রেখে ভারতের বহুত্ববাদে বিশ্বাসী। মোদীপন্থীদের আশা, বর্তমান আর্থিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মোদী যদি সুশাসনের স্লোগান দিয়ে আশার সঞ্চার করতে পারেন, তা হলে আঞ্চলিক দলগুলির মনও জয় করতে পারবেন। কারণ, সব আঞ্চলিক দলই চায়, কেন্দ্র তার প্রত্যাশা পূরণ করুক।
সঙ্ঘ পরিবারও বলছে, এখনই এনডিএ প্রসার নিয়ে ভাবার কোনও দরকার নেই। বরং বিজেপি নিজের জোরে কত বেশি আসন পেতে পারে, সেই চেষ্টা করাই ভাল। মোদীর নেতৃত্বেই বিহার, উত্তরপ্রদেশে বিজেপির পক্ষে ভাল ফল করা সম্ভব বলে তারা আশাবাদী। তাই মোদীকে ঘিরে বিজেপির অন্দরে অল্পবিস্তর বিক্ষোভ যা-ই থাক, প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থীর বদল যে হবে না, তা স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন সঙ্ঘ নেতারা। তবে একই সঙ্গে সঙ্ঘের বক্তব্য, কোনও সম্ভাব্য শরিককে আগ বাড়িয়ে রুষ্ট করেও লাভ নেই। বরং তাদের প্রতি ইতিবাচক বার্তা দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। সেই কারণেই সম্প্রতি মমতার সম্পর্কে ভাল কথা বলেছেন মোদী।
অন্য দিকে, বিজেপি নেতাদের একটা বড় অংশ মনে করছেন গুজরাতের শিল্পায়ন এবং উন্নয়নের কাহিনিকে সামনে এনে সুশাসনের স্লোগান তুললেও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন সফল করতে গেলে মোদীকে এ বার আরও বৃহৎ প্রেক্ষাপটে ভাবতে হবে। দেশের জন্য আলাদা করে নীতি নির্ধারণ করতে হবে। মোদী শিবিরও যে সেই পথেই ভাবছে তার ইঙ্গিত দিয়ে রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেন, “লোকসভা নির্বাচনের আগে এ বার মোদীর নেতৃত্বে আমরা আরও আগ্রাসী ভাবে প্রচার করব। দেশ চালনার নীতি কী হবে, সে দিকেই নজর দেব।”
নীতি নির্ধারণের সেই প্রক্রিয়াটা কী? মোদী শিবির সূত্রে বলা হচ্ছে, গোটা দেশের নিরিখে শিল্পনীতি, নিরাপত্তা সংক্রান্ত নীতি বা দারিদ্র দূরীকরণের কর্মসূচি কী হবে, তা নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছে। এমনিতেই এই সব কাজের জন্য মোদীর একটি নিজস্ব টিম রয়েছে। তার উপর বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারদর্শীদের সাহায্যও এ বার নেওয়া হবে। যেমন আর্থিক নীতি তৈরির ক্ষেত্রে অর্থনীতিবিদ বিবেক দেবরায়, নিরাপত্তা নীতি তৈরি করার জন্য প্রাক্তন গোয়েন্দা প্রধান অজিত ডোভালের সাহায্য নেওয়া হচ্ছে।
তবে বিধানসভা ভোটপর্বের পরে কিছু দিন বিশ্রাম নেবেন মোদী। এক টানা প্রচার চালানোর ফলে তাঁর গলা ভেঙেছে। তা ছাড়া, খুব বেশি প্রচারের আলোতে থাকাটা জনগণের মনে তাঁর সম্পর্কে এক ধরনের ক্লান্তিও এনে দিতে পারে বলে দলের একাংশের আশঙ্কা। আর লোকসভা ভোটের হাওয়া উঠতেও দেরি আছে। তাই মোদীকে প্রচারের অ্যাক্সিলারেটরে চাপ কমাতে বলা হয়েছে।
এই ফাঁকটা পূরণ করবেন আডবাণী, জেটলি, সুষমারা। সংসদের অধিবেশন শুরু হয়ে গিয়েছে। সেখানেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অক্ষমতা, দুর্নীতি, জিনিসপত্রের দাম বাড়া ইত্যাদি নিয়ে সরকারকে চেপে ধরবেন তাঁরা। বিজেপি নেতাদের মতে, চার রাজ্য হারার পরে দেশ শাসন করার নৈতিক জোরটাই হারিয়ে ফেলেছে কংগ্রেস। এই সময় সংসদে লাগাতার আক্রমণ করে তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে হবে। আর সেই ফাঁকে মোদীও খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে লোকসভা ভোটের ঠিক মুখে নতুন কলেবরে আত্মপ্রকাশ করবেন।

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.