|
|
|
|
আইনসভায় আলোচনাই হোক, বার্তা রাষ্ট্রপতির
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
সংসদীয় গণতন্ত্রের মর্যাদা কত মহিমাময়, বিধানসভার ৭৫ বছর পূর্তির সমাপ্তি অনুষ্ঠানে এসে ইতিহাসের দৃষ্টান্ত সহযোগে তারই ব্যাখ্যা দিলেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। প্রায় অভিভাবকের মতোই কৌশলে বার্তা দিলেন সরকার-বিরোধী, দু’পক্ষকেই।
রাষ্ট্রপতি ভবনের বাসিন্দা হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত প্রণববাবুর দীর্ঘ ইনিংস ছিল সংসদীয় রাজনীতিতেই। ব্রিটিশ আমলের ইতিহাস এবং নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে এনে শুক্রবার বিধানসভায় রাষ্ট্রপতি অত্যন্ত সহজ কথায় যা বলেছেন, তার মর্মার্থ: আলোচনার পথে সমাধানে পৌঁছনোই সংসদীয় গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। তার জন্য যত বেশি সম্ভব অধিবেশন বসা উচিত। বন্ধ হওয়া উচিত আইনসভার কাজে বাধা দেওয়ার প্রবণতা। রাষ্ট্রপতির যে বার্তার সঙ্গে সহমত বাম-অবাম, সব শিবিরের ব্যক্তিত্বেরাই। |
|
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ৭৫ বছর পূর্তি উৎসব
পালনের শেষ দিনে প্রণব ও মমতা। ছবি: সুমন বল্লভ। |
বিধানসভার বিশেষ অধিবেশনের শেষ লগ্নে বক্তৃতা দিতে এসে প্রণববাবু বলেন, “ছোটবেলাতেই শিখেছিলাম, সংসদীয় গণতন্ত্র তিনটে ‘ডি’র উপরে দাঁড়িয়ে। ডিবেট, ডিসেনশন এবং ডিসিশন। তর্ক-বিতর্কের পরেও সিদ্ধান্ত একটা নিতে হয়। আমরা পরে একটা চতুর্থ ‘ডি’ এনে ফেলেছি! ডিসরাপশন!” কেন আইনসভার কাজে বাধা দেওয়া উচিত নয়, তার সহজ-সরল ব্যাখ্যাও দেন রাষ্ট্রপতি। বলেন, “ভোট এমন একটা জিনিস, যেটা কেউ কাউকে দেয় না। লোকের কাছে চাইতে হয়! ভারতের রাষ্ট্রপতি থেকে একটা গ্রামসভার সদস্য, ভোট চেয়ে আবেদন করতে হয়। যাদের ভোট চেয়ে নির্বাচিত হয়ে এলাম, তাদের জন্য পরের ৫ বছরে দায়িত্বটা পালন করতে হয়।”
রাষ্ট্রপতির আক্ষেপ, সংসদ এবং বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভাতেও অধিবেশনের মেয়াদ দিন দিন কমে আসছে। তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রথম লোকসভার প্রথম বছরে দেশের বাজেট ছিল ২৯৫ কোটি টাকার। তখন তা নিয়ে আলোচনা চলত ৬ থেকে ৮ সপ্তাহ। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের পেশ করা শেষ বাজেট ছিল প্রায় ১৪ লক্ষ কোটি টাকার। রাষ্ট্রপতির প্রশ্ন, “অথচ এখন সংসদ ক’দিন চলে?” পশ্চিমবঙ্গেও ইদানীং বিধানসভার অধিবশনের দিন কমে যাচ্ছে বলে সরব বিরোধীরা। রাষ্ট্রপতির এ দিনের বক্তব্যে তারা উৎসাহিত। প্রণববাবু অবশ্য একই সঙ্গে উল্লেখ করেছেন, কিছু রাজ্য আছে, যেখানে পশ্চিমবঙ্গের চেয়েও কম দিন বিধানসভা বসে। আর হিমাচল প্রদেশ এক মাত্র রাজ্য, যেখানে বিধানসভার কাজে বাধা (ডিসরাপশন) পড়ে না।
বিধানসভার প্ল্যাটিনাম জয়ন্তীতে বলবেন বলে লিখিত বক্তৃতা তৈরি করে নিয়ে এসেছিলেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে মাতৃভাষায় বলে গিয়েছেন নিজের মতো। বিধানসভায় বিলি-হওয়া তাঁর লিখিত বক্তৃতায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে বিভিন্ন সরকারের আইনসভাকে এড়িয়ে চটজলদি অর্ডিন্যান্স তৈরি করে ফেলার প্রবণতা নিয়েও। দাগী জনপ্রতিনিধিদের বাঁচাতে অর্ডিন্যান্স তৈরি নিয়ে সাম্প্রতিকতম বিতর্কটি হয়েছিল কেন্দ্রেই। সেই অর্ডিন্যান্স রুখতে ভূমিকা ছিল রাষ্ট্রপতিরই। আবার রাজ্যেও সিঙ্গুরের জমি ফেরত বা শিক্ষা ক্ষেত্রে অর্ডিন্যান্স নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। রাষ্ট্রপতির বার্তা তাই কৌশলে সকলের জন্যই।
প্রণববাবুর পরামর্শের সঙ্গে সহমত হয়েই রাজ্যের পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, “বিধানসভায় ভাল বিতর্ক হওয়া চাই। তবে যখন বিল পাশ করানোর কর্মসূচি থাকে না, তখন কী ভাবে অধিবেশন ডাকা যায়, সেটা ভাবনাচিন্তা করা দরকার।” তৃণমূলেরই সাংসদ সৌগত রায়ের কথায়, “সংসদীয় রাজনীতির অভিজ্ঞতা থেকে প্রণববাবু যা বলেছেন, একদম ঠিক। তবে আগে স্থায়ী কমিটির ধারণা ছিল না। এখন নানা কমিটির মধ্যে সদস্যেরা নিয়মিতই বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। তবে সেটা উন্মুক্ত হয় না, রুদ্ধদ্বার আলোচনা হয়।”
লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ও প্রণববাবুর মতে সম্মতি জানিয়েই বলেছেন, “আইনসভা, লোকসভা যে ঠিকমতো চলছে না, সে কথা তো রাষ্ট্রপতিও আজ বললেন! জনসাধারণের জন্য নির্বাচিত হয়েও জনসাধারণের কাজ ঠিকমতো হচ্ছে না।” সোমনাথবাবু এ দিন বিধানসভায় উপস্থিত ছিলেন প্রণববাবুর বক্তৃতার সময়েও। প্রাক্তন স্পিকার জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতির কথাতেই তিনি ওই অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। সৌজন্যের আবহে লোকসভার সময়ের তিক্ততা পিছনে ফেলে এ দিন তাঁকে শাল দিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বর্ষীয়ান সোমনাথবাবুকে সভাকক্ষে ঢুকতে এবং বেরোতে দেখা গিয়েছে পার্থবাবুর হাত ধরেই। আর রাষ্ট্রপতিকে হেলিপ্যাড পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এসেছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী, যুব ও আবাসনমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস ও কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়।
রাষ্ট্রপতি বয়কট-বিতর্কে ঢোকেননি। তাঁর সামনেও মুখ্যমন্ত্রী উল্লেখ করতে ছাড়েননি, “স্বাধীনতার পর বিধানসভার ৬৫ বছরের মধ্যে আমরা সরকারে আছি মাত্র আড়াই বছর! তার আগে চালিয়েছে কংগ্রেস আর বামেরা। তবু তারা এই অনুষ্ঠানে নেই। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এ সব অনুষ্ঠানকে বিচার করা উচিত নয়।” বয়কট নিয়ে প্রশ্নের জবাবে সোমনাথবাবু অবশ্য বলেন, “নিশ্চয়ই তাঁরা বুঝেছেন। তাই করেছেন।”
প্রণববাবুর বাবা কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায় ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বিধায়ক। প্রণববাবু নিজে এ রাজ্যের বিধায়কদের সমর্থন নিয়ে রাজ্যসভায় গিয়েছেন বেশ কয়েক বার। আবার তাঁর ছেলে অভিজিৎ রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন এখানকার বিধায়ক হয়েই। বিধানসভার সঙ্গে তিন পুরুষের এই যোগাযোগ উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি তাঁর বক্তৃতা শেষ করে বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে মার্জনার সুরে “প্রতি দিন এখানকার সদস্যেরা যা করেন, আমিও আপনাকে সেই যন্ত্রণা দিলাম! বেশি বলে ফেললাম!” স্পিকার অবশ্য বলেছেন, তিনি আপ্লুত।
|
পুরনো খবর: ফাঁকা শাসক বেঞ্চ ঝিমিয়ে, তোপ বামকেই |
|
|
|
|
|