বিরোধীরা বয়কট করেছে আগেই। বিধানসভার প্ল্যাটিনাম জয়ন্তীর (৭৫ বছর পূর্তি) সমাপ্তি অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিন নিষ্প্রভ হয়ে গেল শাসক শিবিরও। নিতান্তই অল্পসংখ্যক কিছু তৃণমূল বিধায়কের উপস্থিতিতে আলোচনাসভা চলল বিধানসভায়। যা নিয়ে কটাক্ষ করতে ছাড়ল না বামেরা!
বয়কট করার পরেও বামেরা অবশ্য উপস্থিত ছিল বৃহস্পতিবারের বিধানসভায়। কারণ, ‘সংসদীয় গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক আলোচনায় অনুপস্থিত বামেদেরই টানা নিশানা করে গিয়েছেন তৃণমূলের বক্তারা। পারস্পরিক চাপানউতোরের আবহেই রাজ্যের আইন প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য আবার মুখ্যমন্ত্রীর সুরেই বলেছেন, বিচার বিভাগ ও মানবাধিকার কমিশনের ‘সক্রিয়তা’ সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে অনেক সময় সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আলোচনার আসরের উদ্বোধনী বক্তৃতা বুধবার বিকালেই সেরে গিয়েছিলেন লোকসভার স্পিকার মীরা কুমার। তারই সূত্র ধরে এ দিন সকালে আলোচনা শুরু হওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন সব মিলিয়ে জনাপঞ্চাশেক বিধায়ক। মাঝে আরও কেউ কেউ এসেছিলেন। বিকালে চন্দ্রিমাদেবীর ভাষণ দিয়ে যখন এ দিনের কাজ শেষ হচ্ছে, সেই সময় উপস্থিত ৪৮ জন বিধায়ক! বিরোধী আসনে শাসক দলের বিধায়কেরা বুধবার বসে পড়ায় যে বিতর্ক বেধেছিল, তার পরে এ দিন আর সেই পথে কেউ হাঁটেননি। তবে সংসদীয় গণতন্ত্র নিয়ে মোট ২১ জন বক্তা যে যার মতো যখন বক্তৃতা করছেন, ট্রেজারি বেঞ্চে মাঝেমধ্যেই চোখ বুজে আসতে দেখা গিয়েছে মন্ত্রী-সহ কিছু বিধায়কের! নজরে পড়লেই পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় চেষ্টা চালিয়েছেন অবসন্ন বিধায়কদের মনোনিবেশ ফেরানোর! |
ঘুমের দেশে: বিধানসভার প্ল্যাটিনাম জয়ন্তীর সমাপ্তি অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিনে (উপরে বাঁ দিক থেকে)
কৃষ্ণেন্দু চৌধুরী, ফিরোজা বিবি, বেচারাম মান্না, অরুণাভ সেন, (নীচে বাঁ দিক থেকে) জটু লাহিড়ী,
গুলশন মল্লিক, সুজিত বসু এবং উজ্জ্বল বিশ্বাস। বৃহস্পতিবার সুমন বল্লভের তোলা ছবি। |
সমাপ্তি অনুষ্ঠানের উদ্বোধনের দিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধীদের নিশানা করেছিলেন। সংসদে তাঁর নিয়মিত হাজিরার কথা বলেছিলেন। তৃণমূলের বিধায়কেরা দূর-দূরান্ত থেকে বিধানসভায় হাজির হন, বলেছিলেন সেই কথাও। তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বিধানসভার এ দিনের ছবি বিরোধীদের হাতেই অস্ত্র তুলে দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী নিজেও এ দিন আর বিধানসভায় আসেননি। আলিমুদ্দিনে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র তাই কটাক্ষ করেছেন, “আমার কাছে খবর, আজ মুখ্যমন্ত্রী অনুষ্ঠান বয়কট করেছেন! উনি ও-মুখো হননি। ৭৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে শাসক দলের ৭৫ জনও উপস্থিত ছিলেন না! গণতন্ত্রের পীঠস্থানের উপরে ওঁদের কি আস্থা, তা তো বোঝাই যায়!”
তৃণমূলের পরিষদীয় সূত্রে অবশ্য বলা হচ্ছে, আজ, শুক্রবার ‘সংহতি দিবস’ পালনের জন্য দূরবর্তী জেলাগুলির বিধায়কদের নিজেদের এলাকায় থাকতে বলা হয়েছে। উত্তরবঙ্গের বিধায়কেরা ইতিমধ্যেই এলাকায় ফেরার ট্রেন ধরেছেন। ফিরতে শুরু করেছেন আর কিছু দূরের এলাকার বিধায়কেরাও। তারই প্রতিফলন বিধানসভায় পড়েছে। একে বিরোধীশূন্য সভা, তার উপরে এই রকম সিদ্ধান্ত নিয়ে আজ রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সামনে বিধানসভায় অস্বস্তিতে পড়তে হয় কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে শাসক শিবিরের একাংশে।
মুখ্যমন্ত্রীর পথ ধরেই পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থবাবু এ দিন বলেছেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনশনের কথা এই বিধানসভায় বলতে পারিনি। জমিহারাদের কান্নার কথা বলতে দেওয়া হয়নি। নেতাইয়ের গণহত্যা নিয়ে বলার সুযোগ পাইনি। কিন্তু স্পিকারের আমন্ত্রণে কোনও অনুষ্ঠানে যাইনি, এমন হয়নি!” সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে বলতে গিয়েই সরকারি মুখ্য সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, “স্বৈরতন্ত্র, একদলীয় শাসন থাকলে মানুষের কণ্ঠরোধ করার ফলে তারা বেশি দিন স্থায়ী হয় না।” আবার বিরোধী শিবিরের একমাত্র প্রতিনিধি এসইউসি-র তরুণ নস্কর তাত্ত্বিক বক্তৃতার ফাঁকেই মন্তব্য করেন, “আন্দোলন করে যে দল ক্ষমতায় আসে, তারাই আন্দোলনের টুঁটি টিপে ধরার চেষ্টা করে! ১৯৭৭-এর পরে দেখেছি, এখনও দেখছি!”
বিধানসভার আলোচনা যখন একতরফা ভাবে তৃণমূলের পক্ষেই হয়েছে, বাইরে থেকে আবার আক্রমণের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছে বামেরাও। মমতার বুধবারের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে এ দিন আলিমুদ্দিনে সূর্যবাবু বলেছেন, “আমাদের অনুপস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রী খুব ভয় পেয়ে গিয়েছেন! যে কারণে উনি ঈশ্বর-আল্লার দ্বারস্থ হয়েছেন! সরকারের এই ভূমিকাকে মশা মারতে কামান দাগা হিসাবেই দেখছি!”
বিরোধী দলনেতার আরও মন্তব্য, “উনি গত কাল কিছু জ্ঞান, শিক্ষা, অশিক্ষা, কুশিক্ষা দিয়েছেন। সংসদীয় গণতন্ত্র কী ভাবে চালাতে হয়, তা আমরা জানি। ওঁর কাছ থেকে শিখব না!” সিঙ্গুর আন্দোলনের সময়কার ঘটনা উল্লেখ করে সূর্যবাবু বলেন, “যিনি সংবিধানের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বিধানসভা ভাঙচুর করিয়েছিলেন এবং লোকসভায় স্পিকারের দিকে কাগজ ছুড়েছিলেন, তিনি এখন জ্ঞান দিচ্ছেন!” মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, বিধানসভা রাজনীতির জায়গা নয়। সূর্যবাবুর প্রতিক্রিয়া, “এটাই সব থেকে বড় প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি। এখন তো দেখছি, আমাদের সরকার অরাজনৈতিক! এক কথায় বলা যায়, নিকৃষ্টতম!” |