সৌজন্যের খাতিরেই বিধানসভার প্ল্যাটিনাম জয়ন্তীর সমাপ্তি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা উচিত ছিল বিরোধীদের, বললেন মুখ্যমন্ত্রী। বিরোধী দলনেতা বললেন, রাজনৈতিক সৌজন্যবোধের কথা ভেবেই তাঁরা বিধানসভায় যাননি।
অন্য বিরোধী দলের পরিষদীয় নেতা বললেন, বিধানসভায় একদা ভাঙচুর চালানো দলটির কাছ থেকে তাঁরা সৌজন্য শিখবেন না।
যদিও বয়কটের প্রস্তাবে সই করেও অধিবেশনে এসে পড়লেন এক বাম বিধায়ক। এবং গরহাজির বিরোধীদের আসনে বসে পড়লেন সরকারি দলের বেশ কিছু সদস্য!
সব মিলিয়ে বিধানসভার প্ল্যাটিনাম জয়ন্তীর সমাপ্তি অনুষ্ঠানের প্রথম দিনটি ঘটনাবহুল।
বুধবার সকাল থেকেই বিরোধীদের বিধানসভা বয়কটের সিদ্ধান্তকে আক্রমণ করে গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শেষ পর্যন্ত তিনি বলেছেন, “ঈশ্বর, আল্লা ওঁদের ক্ষমা করুন!” মুখ্যমন্ত্রীর যুক্তি, বিধানসভায় রোজকার যা রাজনৈতিক বিতর্ক-বিবাদ হয়, তার ঊর্ধ্বে উঠে এই ধরনের বিশেষ অনুষ্ঠানকে বিবেচনা করা উচিত। এই প্রসঙ্গে নিজের সাংসদ জীবন ও সংসদে তৃণমূলের ভূমিকার উদাহরণ টানেন তিনি। বলেন, “আমি ৭ বার সাংসদ ছিলাম। কখনও সংসদের যৌথ অধিবেশন বা বিশেষ অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকব, এ রকম মনে হয়নি! যখন আমার সুবিধে হবে, আসব। যখন মনে হবে না, আসব না! এটা সৌজন্য নয়!”
এই সৌজন্য-প্রসঙ্গই বুধবার দিনভর ঘুরেফিরে এসেছে কখনও মমতার গলায়, কখনও বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের গলায়, কখনও কংগ্রেসের পরিষদীয় দলনেতা মহম্মদ সোহরাবের গলায়।
মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় যেমন বলেছেন, “রাজনৈতিক বক্তব্য বিধানসভার বাইরে বলা যায়। বিধানসভার ভিতরটা মানুষের জন্য, মানুষের দ্বারা। সংসদীয় গণতন্ত্রে সৌজন্য, পরম্পরা বলে একটা ব্যাপার আছে।” পক্ষান্তরে সূর্যবাবু বলেছেন, “আমরা বিধানসভার ভিতরে দাঁড়িয়ে আমাদের কথা বলতে গেলে বিতর্ক বাধত, বিরোধিতা আসত। আমরা চাইনি, রাষ্ট্রপতি, লোকসভার স্পিকার এবং ভিন্ রাজ্যের অতিথিরা যে অনুষ্ঠানে আসছেন, সেখানে কোনও অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি তৈরি হোক। রাজনৈতিক সৌজন্যবোধ থেকেই এই সিদ্ধান্ত।” আর সোহরাবের চাঁছাছোলা কথা, “বিরোধী দলে থাকার সময়ে যাঁরা এই বিধানসভা ভবনে ভাঙচুর (৩০ নভেম্বর, ২০০৬) চালিয়েছেন, তাঁদের কাছে সংসদীয় শিষ্টাচার শেখার প্রয়োজন নেই!”
মুখ্যমন্ত্রীকে কংগ্রেসের আক্রমণের অবশ্য এখানেই শেষ নয়। এ দিন মমতা তাঁর বক্তৃতায় বলেন, “আমি অনেক আন্দোলন করেছি। বিধানসভায় দু’মিনিট প্ল্যাকার্ড দেখালাম আর বেরিয়ে গেলাম, এতে প্রচার হয়। এটা আন্দোলন নয়।” সেই বক্তব্যেরও তীব্র প্রতিক্রিয়া এসেছে কংগ্রেস শিবির থেকে। পরিষদীয় দলনেতা সোহরাব বলেছেন, “সংসদ চললে ওঁরা (তৃণমূল) তো নিয়মিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে, ওয়েলে নেমে বিক্ষোভ দেখান! ধর্নায় বসেন। বিরোধী থাকার সময় এই বিধানসভাতেও অজস্র বার তা-ই করেছেন!”
সরকারি মুখ্য সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “প্রাত্যহিক বিধানসভার সঙ্গে এই উৎসবকে একাকার করে দিয়ে তাঁরা (বিরোধীরা) গণতন্ত্রের এই পীঠস্থানকে অসম্মানিত করেছেন বলেই আমার মনে হয়।” তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু বিধানসভায় কংগ্রেসের নাম করে কোনও আলাদা আক্রমণে যাননি। তাঁর নিশানায় ছিলেন বামেরাই। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আমলে ১৯৭২ থেকে ’৭৭ পর্যন্ত পাঁচ বছর সিপিএমের বিধানসভা বয়কটের সিদ্ধান্তকে তীব্র কটাক্ষ করেন তিনি। অতীতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রফুল্ল ঘোষ, বিধানচন্দ্র রায়, অজয় মুখোপাধ্যায়, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, জ্যোতি বসু এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নাম উল্লেখ করেছেন তিনি। যদিও একমাত্র জীবিত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবুকেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। বিরোধী দলনেতাদের অনেকের নাম করলেও মমতা এ দিন ভূয়সী প্রশংসা করেছেন ‘মানুদা’রই (সিদ্ধার্থশঙ্কর)।
এ হেন পরিস্থিতিতে বিশেষ অধিবেশনের অতিথি, রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন চেষ্টা করেছেন যথাসম্ভব ভারসাম্য রক্ষার। এক দিকে যেমন বলেছেন, এমন অনুষ্ঠানে কেউ কেউ (বিরোধীরা) উপস্থিত থাকলেন না বলে তিনি দুঃখিত। তেমনই এ-ও বলেছেন, “অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা সংসদীয় গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান ধর্ম।” বিরোধীদের ব্যাখ্যা, রাজ্যপালের এই মন্তব্যের ইঙ্গিত সরকার পক্ষের দিকেই। লোকসভার স্পিকার মীরা কুমার আবার কোনও বিতর্কের মধ্যেই ঢোকেননি। ‘সংসদীয় গণতন্ত্রের সামনে চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক আলোচনার সূচনা করে তিনি বলেছেন, “জনপ্রতিনিধিদের কাছে মানুষের অনেক প্রত্যাশা। সংসদীয় ব্যবস্থায় একটা মিনিটও তাই নষ্ট করা উচিত নয়। সংসদের কাজে বাধাদানও কাঙ্ক্ষিত নয়।” বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “সংঘাত নয়, সহমতই গণতন্ত্রের মূল কথা হওয়া উচিত।”
স্পিকার বিমানবাবুর স্বাগত ভাষণ এবং মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতা দিয়ে বিশেষ অধিবেশনের আনুষ্ঠানিক সূচনার আগে এ দিন সকালে বাম পরিষদীয় দলের তরফে অনুপস্থিতির কারণ বিশদে ব্যাখ্যা করে স্পিকারকে চিঠি দিয়ে আসেন সূর্যবাবু। চিঠি পাঠান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় ও লোকসভার স্পিকারের কাছেও। তাঁদের লিখিত প্রতিবাদ যাতে বিধানসভার অতিথিদের কাছে বিলি করা হয়, সেই আর্জিও জানিয়ে আসেন বিমানবাবুর কাছে। বিরোধীদের অধিকার খর্ব করা, সারদা বা মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে মুলতবি প্রস্তাব গ্রহণ না করা, ‘জ্যোতি বসু নগরী’ সম্পর্কে সরকারের বিধানসভাকে বিভ্রান্ত করা সব অভিযোগই রয়েছে চিঠিতে। সূর্যবাবু বলেন, “স্বৈরতন্ত্র, একনায়কতন্ত্রের বিপদ দেখা যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের জন্য এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জায়গা রাখা হয়নি। তাই বেদনাহত চিত্তে বিধানসভা ছেড়ে যাচ্ছি!” কিন্তু প্ল্যাটিনাম জয়ন্তীর গৌরবময় মঞ্চ ব্যবহার করেই তো তাঁদের বক্তব্য পেশ করতে পারতেন? সূর্যবাবুর জবাব, “আমরা গরিমা চাই না! অধিকার চাই!”
কংগ্রেসও তাদের বয়কটের সিদ্ধান্তের কথা রাষ্ট্রপতি এবং লোকসভার স্পিকারকে জানিয়েছে। আর এমতাবস্থায় সরকার ও বিরোধী, দু’পক্ষেরই সমালোচনা করেছে বিজেপি। দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের মন্তব্য, “অনুষ্ঠানে বিরোধীদের অবশ্যই থাকা উচিত ছিল। কিন্তু প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ না জানানোটা কোন ভদ্রতা? তিনি ব্যর্থ মুখ্যমন্ত্রী হলেও জনগণের দ্বারা নির্বাচিত ছিলেন। তাঁকে আমন্ত্রণ না জানানোর অর্থ শিষ্টাচার ভঙ্গ!” |