রীতি ভেঙেই শাস্তির মুখে জয়রামন
বান্নের ১৩ তলায় সে দিন হালকা মেজাজেই ছিলেন রাজ্যের প্রশাসনিক কর্তারা। আর পাঁচটা শনিবারের মতো, কিছুটা ছুটির মেজাজে। বিকেলের দিকে এক কর্তার মোবাইলে ভেসে ওঠা একটা এসএমএস আচমকাই পাল্টে দিল পরিবেশটা। শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনারের পাঠানো ওই বার্তা জানাচ্ছে: গোদালা কিরণকুমারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাঁকে আদালতে হাজির করানো হচ্ছে।
বিস্ফোরক সেই এসএমএস দেখে নিজের ঊর্ধ্বতন কর্তাকে জানাতে তিলমাত্র দেরি করেননি ওই আমলা। এবং সে কথা শুনে ওই কর্তার প্রথম প্রতিক্রিয়া, “ওঁর (গোদালা) জন্য এটাই ঠিক। কিন্তু মালদহের জেলাশাসককে গ্রেফতার করা হল, অথচ আমরা কিছু জানলাম না! এটা হতে পারে না। এটা মানা যায় না।”
সে দিনই কে জয়রামনকে কম্পালসারি ওয়েটিংয়ে পাঠিয়ে দেয় সরকার। একই সঙ্গে পরের দিনই গোদালাকে ফের আদালতে হাজির করার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। রবিবার জামিন পেয়ে যান তিনি। এর পরেই সরব হয় বিরোধীরা। তাদের অভিযোগ, শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এসজেডিএ) দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। জবাবে সরকার বলছে, আইন আইনেরই পথে চলবে। কিন্তু জয়রামন যা করেছেন, তা প্রশাসনিক রীতি বহির্ভূত। তাই তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে আইন কী বলছে?

প্রশাসনিক কর্তারা জানাচ্ছেন, আইএএস-আইপিএসদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু, তাঁদের জেরা বা গ্রেফতার করা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সুনির্দিষ্ট রায় আছে। রয়েছে কেন্দ্রীয় কর্মিবর্গ মন্ত্রকের পৃথক নির্দেশিকাও। কোনও আইএএস-আইপিএসের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে সেই নির্দেশিকা মেনেই তদন্ত শুরু করার নিয়ম।

কী সেই নির্দেশিকা?

তার মোদ্দা কথা হল, ১৬ বছর বা তার বেশি দিন কর্মরত নীতি-নির্ধারক অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে আর পাঁচটা ক্ষেত্রের মতো তদন্ত করা যাবে না। তখন তদন্ত শুরুর আগে ওই অফিসারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের (কন্ট্রোলিং অফিসার) অনুমতি নেওয়া আবশ্যিক। যে হেতু একমাত্র ওই কন্ট্রোলিং অফিসারই এই অনুমতি দিতে পারবেন, সে হেতু একে ‘সিঙ্গল ডাইরেক্টিভ’ বলা হয়, জানাচ্ছেন এক প্রশাসনিক কর্তা। কিন্তু মহকুমাশাসক বা জেলাশাসকের মতো জুনিয়র অফিসারদের এই রক্ষাকবচ নেই।

তা হলে কিরণকুমারকে গ্রেফতার করে জয়রামন ভুল করলেন কোথায়?

এখানেই উঠছে প্রশাসনিক রীতির প্রশ্ন। নবান্নের কর্তারা বলছেন, আইনি বিধিনিষেধ নেই বলে কোনও মন্ত্রীর বিরুদ্ধে শিবপুর থানায় অভিযোগ দায়ের হলেই কি হাওড়া পুলিশ তাঁকে ধরার জন্য নবান্ন ঘেরাও করবে! এক কর্তার কথায়, “আইন থাকলেও প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে সব সময় তা সম্ভব নয়। শালীনতা, শিষ্টাচার বলেও একটা জিনিস আছে।”
ওই কর্তার মতে, প্রশাসন যাতে কোনও অবস্থাতেই পুলিশ বা সেনার মতো সশস্ত্র বাহিনীর হাতে চলে না যায়, সে জন্য গণতন্ত্রের স্বার্থেই সুচিন্তিত ভাবে আমলাদের প্রশাসনের মাথায় বসানো হয়েছে। রাজ্যে প্রশাসনের মাথা মুখ্যসচিব। রাজ্য পুলিশের ডিজিকে তাঁর পরামর্শ মেনে চলতে হয়। জেলার পুলিশ সুপারকে কাজ করতে হয় জেলাশাসকের পরামর্শে। ঠিক যেমন তিন সেনাবাহিনীর প্রধানকে মেনে চলতে হয় প্রতিরক্ষাসচিবের কথা।
নবান্নের কর্তাদের বক্তব্য, কোনও প্রশাসনিক কর্তার বিরুদ্ধে যদি খুন বা ধর্ষণের মতো অভিযোগ ওঠে, তা হলে তাঁকে সরকারের অনুমতি ছাড়াই গ্রেফতার করা যেতে পারে। কারণ, সে ক্ষেত্রে তাঁকে তৎক্ষণাৎ গ্রেফতার করাটা প্রয়োজন। বস্তুত এর আগে হলদিয়ায় এক আমলার বিরুদ্ধে স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারার অভিযোগ ওঠায় তাঁকে তৎক্ষণাৎ গ্রেফতার করা হয়েছিল। কিন্তু গোদালার বিরুদ্ধে তেমন অভিযোগ নেই।
এক কর্তার কথায়, “মূলত আর্থিক অপরাধের সঙ্গে গোদালার নাম জড়িয়েছে। পুলিশের পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘হোয়াইট কলার ক্রাইম’। খুন-ডাকাতিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দ্রুত গ্রেফতার করা জরুরি হলেও এ ক্ষেত্রে সাধারণ ভাবে সেটা দরকার হয় না। কারণ আর্থিক অপরাধের তদন্ত মূলত নথিনির্ভর।” তা ছাড়া, গোদালা তদন্তে সহযোগিতাও করছেন। যত বার ডেকে পাঠানো হয়েছে, তিনি এসেছেন। তা হলে তাঁকে আচমকা গ্রেফতার করে প্রশাসনের অন্দরে বিশৃঙ্খলা তৈরির যৌক্তিকতা কোথায়, প্রশ্ন নবান্নের কর্তাদের। গোদালার গ্রেফতারের দিন সাংবাদিক সম্মেলনেও মুখ্যসচিব এই প্রশ্নটাই তুলেছিলেন।
আর্থিক অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতার না-করলেই যে তদন্তে সুবিধা হয়, সে কথা জানাচ্ছেন দীর্ঘ দিন সিবিআইয়ে কাজ করা এক পুলিশকর্তাও। তিনি বলেন, “সে ক্ষেত্রে বিভিন্ন নথি পরীক্ষার সময় প্রয়োজনমতো তাঁকে ডেকে পাঠানো যায়। জেল হেফাজতে থাকলে সেই সুযোগ পাওয়া সময়সাপেক্ষ।”
নবান্নের একটি সূত্র বলছে, গোদালার বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ ছিল, সে সম্পর্কে প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহল ওয়াকিবহাল। এমনকী, তদন্তের ধাপে ধাপে কী কী তথ্যপ্রমাণ মিলছে, তা-ও জানত রাজ্য প্রশাসন। সেই কারণেই তদন্ত চলার সময়ে তাঁকে কখনওই আড়াল করার চেষ্টা হয়নি। শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনারকে দ্রুত তদন্ত শেষ করে চার্জশিট দিতে বলা হয়েছিল। অর্থাৎ, সরকারও চেয়েছিল তাড়াতাড়ি তদন্ত শেষ হোক। কিন্তু ওই নির্দেশ উপেক্ষা করে কিরণকুমারকে গ্রেফতার করাটা কার্যত ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার সামিল বলেই মনে করছেন প্রশাসনিক কর্তাদের একাংশ। আর সেই কারণেই কম্পালসারি ওয়েটিংয়ের শাস্তির মুখে জয়রামন।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.