চিজোবো ক্রিস্টোফার তাঁর তেত্রিশ বছর আগে করা গৌরবের স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছেন শুনে দিল্লি থেকে ফোনে জামশিদ নাসিরি বললেন, “প্রথম ম্যাচে নেমে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া কঠিন কাজ। তাও আবার বড় টিমের জার্সি পরে। তীব্র চাপের মধ্যে দু’গোল করা আরও কঠিন। যে করে তাকে তো কৃতিত্ব দিতেই হবে। আমিও সে দিন টেনশনহীন না থাকলে ওটা করতে পারতাম না। ক্রিস্টোফারও নিশ্চয়ই তাই ছিল। ওর জন্য শুভেচ্ছা রইল।”
ক্রিস্টোফার-ওডাফা যুগলবন্দিতে বাগানে অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার দিনে ময়দানে ফিরে এসেছে আরও এক ইরানি ফুটবলারের নাম—মজিদ বাসকার। উনিশশো আশিতে কলকাতা লিগে লাল-হলুদ জার্সি পরে প্রথম নেমেছিলেন জামশিদ। বাটার বিরুদ্ধে। জোড়া গোল করে জিতেয়েছিলেন তীব্র চাপে পড়ে যাওয়া প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইস্টবেঙ্গলকে। এবং সে বারও গোলের দুটো পাসই ছিল মজিদের। যেমন শুক্রবার হল যুবভারতীতে। ক্রিস্টোফারের দু’টো গোলের পাসই তো ওডাফার!
ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে এই মরসুমে যত বার নেমেছেন প্রতি বারই গোল পেয়েছেন ক্রিস্টোফার। নতুন আসা বিদেশির কপালগুণে করিম বেঞ্চারিফার ভাগ্য ফিরল, না আর্থিক দুরবস্থায় নুয়ে পড়া র্যান্টি মার্টিন্সের টিম ‘ভিটামিন এম’-এর অভাবে মোটিভেশন হারিয়ে আত্মসমর্পন করল, তা নিয়ে ম্যাচের পর তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে। তবে এটা ঘটনা, বেগুনি বিগ্রেডের বিরুদ্ধে এত বড় জয় এর আগে কখনও পায়নি সবুজ-মেরুন জার্সি। |
শাপমুক্তির দুই মুহূর্ত |
ইউনাইটেড ডিফেন্স তছনছ
করে ক্রিস্টোফারের প্রথম গোল। |
গোলকিপারকে পরাস্ত
করে ফের লক্ষ্যভেদ। |
|
দুঃসময়ের মধ্যে এই ফলে মোহন কোচের শ্লাঘা হওয়া স্বাভাবিক। সদস্য-সমর্থকদেরও। নিট ফল, পাঁচ দিন আগেই বাগান টিম বাস ঘিরে যাঁরা চটি-জুতো ছুড়েছিলেন, তাঁরাই দেখা গেল গ্যালারিতে জ্বালাচ্ছেন সবুজ মশাল। তুলছেন স্লোগান। বাড়ি ফেরার পথে মোহন-কোচ অভিমানী মুখ নিয়ে সেই টিম বাসেই উঠলেন। বলে গেলেন, “ক’দিন আগে এখানে কি হয়েছিল মনে আছে?”
আই লিগের লাস্ট বয় রাংদাজিদের বিরুদ্ধে বিশ্রী হারের পর কোন সোনার কাঠির ছোঁয়ায় এই পরিবর্তন মোহনবাগানে? চৌম্বকে তিনটি কারণ উঠে আসছে।
এক) ক্রিস্টোফারের মতো একজন গোল গেটারের টিমে অন্তর্ভুক্তি।
দুই) কোচের সঠিক স্ট্র্যাটেজি এবং পজিশন অনুযায়ী ফুটবলার নির্বাচন।
তিন) বাগান ফুটবলারদের মরিয়া মনোভাব। |
ক্রিস্টোফার বহু দিন খেলছেন ময়দানে। এখানকার পরিবেশ তাঁর নখদর্পনে। কলকাতা লিগে এ বার আশি শতাংশ গোল-সাফল্য। খেপ খেলে খেলে পুরো ম্যাচ ফিট। ছোট জায়গায় ভাল ড্রিবল করতে পারেন। তার উপর চোরা একটা গতি আছে। সবচেয়ে বড় কথা, ছোট মাঠে ছোট গোল-পোস্ট লক্ষ্য করে বহু গোল করার সুবাদে নিশানাটা ঠিক রাখতে পারেন। বল সবসময় মাটিতে বা সামান্য ওপরে রাখেন নিশ্চিত গোলের জন্য। অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া বাগানে ক্রিস্টোফারের সেই খেপ-টোটকাগুলো আশীর্বাদ হল। ওডাফা পুরোপুরি ফিট নন। মোহন অধিনায়ককে সামনে রেখে তাই ছটফটে ক্রিস্টোফারকে পিছন থেকে দোলালেন করিম। নিখুঁত প্লেসিংয়ে দুটো গোল। বিরতির আগেই ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারিতও হয়ে গেল। ইউনাইটেড কোচ ক্রিস্টোফারের পিছনে হাসানকে মার্কার করেও কিছু করতে পারলেন না।
ডাবল ডিফেন্সিভ স্ক্রিনের চাদর সরিয়ে করিম যে আক্রমণের ঝড় তুলতে চান সেটা বোঝা গিয়েছিল আগের দিনের অনুশীলনেই। কাতসুমিকে উইং থেকে মাঝে এনে তাঁর পজিশন ফিরিয়ে দিলেন করিম। মোহন-কোচ সবচেয়ে বড় ফাটকা অবশ্য খেললেন বর্ধমানের জো গ্রামের চাষির ছেলেকে উইং কাম সাপোর্টিং স্ট্রাইকার করে দিয়ে। প্রতিশ্রুতিমান রাম মালিক মনে করালেন মানস ভট্টাচার্যকে। যেমন তরতর করে উইং ধরে উঠে যেতে পারেন, তেমনই ইচ্ছাশক্তি ছেলেটির। কম উচ্চতা বাধা না হলে অনেকদূর যাবেন। নিজে তো গোল করলেনই, ওডাফাকে ‘জীবন’ দিলেন গোল করিয়ে। ভারতে আসার পর খেলোয়াড় জীবনে মরসুমের প্রথম পাঁচ ম্যাচে গোল করেননি, এ রকম ঘটনা কখনও ঘটেনি ওডাফার জীবনে। বলা যায়, বাগানের শাপমুক্তির দিনে ক্রিস্টোফার যদি ভগীরথ হন, তা হলে গঙ্গা অবশ্যই—রাম মালিক। |
গোলের পর কোচের আলিঙ্গনে আবেগে ভাসলেন ওডাফা। |
ইউনাইটেড খেলতেই পারেনি। ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে র্যান্টি-বেলোরা যা খেলেছিলেন তার ধরেকাছেও পৌঁছতে পারেননি। সাতোরির কোনও স্ট্র্যাটেজিই কাজ করেনি। কোচ নিজেও সম্ভবত র্যান্টি-এরিকদের মতো মোটিভেশন হারিয়ে ফেলেছিলেন। খেলা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই টিমে পরিবর্তন শুরু করলেন ডাচ কোচ। যা সচরাচর তিনি করেন না। ইউনাইটেড কিপার ঈশান দেবনাথ আবার ম্যাচের শেষ মিনিটে বড় চোট পেলেন। তার বাঁ পায়ের শিনবোন ভেঙেছে। ইনজুরি টাইমে দশ জনে খেললেন র্যান্টিরা। বাগানের মরসুমের সেরা ম্যাচ খেলার দিনে ইউনাইটেড স্ট্রাইকারদের তাই অসহায় দেখাল। পুরো ম্যাচে র্যান্টি মাত্র এক বার বাগান কিপার সন্দীপ নন্দীকে বিপদে ফেললেন। করিম বলছিলেন, “দশ-বারোটা গোলের সুযোগ পেয়েছিলাম আমরা। আই লিগের প্রথম পাঁচে থাকা একটা টিমের বিরুদ্ধে এ রকম জয় বড় ব্যাপার।”
করিম বুদ্ধিমান কোচ। উচ্ছ্বসিত হলেও আবেগে গা ভাসাননি চমকপ্রদ এবং অপ্রত্যাশিত জয়ের পর। তিনি জানেন কোচেদের জীবনটা এ রকমই। আজ রাজা, কাল ফকির। সে জন্যই তাঁকে বলতে শোনা গেল, “সব যদি ঠিকঠাক চলে তা হলে ফেড কাপ বা আইএফএ শিল্ড আমরা পেতেই পারি।” মোহন-কোচ বুঝে গিয়েছেন, ট্রফির খরা কাটানোর লক্ষ্যের তালিকায় আই লিগকে না রাখাই ভাল। তা সে যত বড় জয়ই আসুক। |
ম্যাচের সব ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।
|
মোহনবাগান: সন্দীপ, প্রীতম, কিংশুক, ইচে, শৌভিক, মণীশ, ডেনসন (সাবিথ), কাতসুমি, রাম (রাজীব), ওডাফা, ক্রিস্টোফার (আইবর)। |