রেশন ডিলারেরা নিজেরা গুদাম থেকে গম নিলে আট কিলোমিটার পর্যন্ত লরি-পিছু ১৮০০ টাকা ভাড়া দিলেই চলে। অথচ সরকার নিজেরা সেই গম রেশনে পৌঁছে দিতে চাওয়ায় লরি-ভাড়া দাবি করা হচ্ছে ৬৫০০ টাকা! তিন গুণেরও বেশি। রহস্যটা কী? ষড়যন্ত্র দেখছেন খাদ্যমন্ত্রী। তিনি বলছেন সিন্ডিকেট-জুজুর কথা।
দীর্ঘদিনের রেওয়াজ মেনে শহর এলাকার রেশন ডিলারেরা নিজেরাই লরি ভাড়া করে এফসিআই গুদাম থেকে গম তোলেন। পরে খাদ্য দফতরে সেই নথি দাখিল করলে ভাড়া মিটিয়ে দেয় রাজ্য সরকার। কিন্তু এতে বরাদ্দ গমের বেশির ভাগটাই রেশন দোকানে না-পৌঁছে কালোবাজারে চলে যাচ্ছে বলে অভিযোগ। তাই সরকার প্রস্তাব দেয়, এ বার তারাই লরি ভাড়া করে গম পৌঁছে দেবে ডিলারদের ঘরে। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া শুরু করতে গিয়ে গোড়াতেই হোঁচট খেয়েছে খাদ্য দফতর।
রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, লরি ভাড়া নিতে চেয়ে খাদ্য দফতর পুজোর আগে দরপত্র ডেকেছিল। মূলত বজবজ, কাশীপুর ও ডানকুনির গুদাম থেকে গম তুলে কলকাতা ও হাওড়ার রেশন দোকানে সরবরাহ করা হয়। দরপত্রে সে-কথাও বলা হয়েছিল। কিন্তু এক মাস পরে দেখা যায়, মাত্র এক জনই দরপত্রে যোগ দিয়েছেন। যে-দর হাঁকা হয়েছে, তা বাস্তবসম্মত নয়। ফলে ফের দরপত্র ডাকে খাদ্য দফতর। কিন্তু এ বারেও সেই এক জনই দর নথিভুক্ত করায় আবার তা বাতিল হয়ে যায়।
সরকারি সূত্রের খবর, চলতি মাসে তৃতীয় বারের জন্য দরপত্র ডাকার প্রস্তুতি চালাচ্ছে খাদ্য দফতর। কিন্ত এ বারেও যদি সেই এক জনই দরপত্রে সাড়া দেন? এক খাদ্যকর্তা বলেন, “আমরা অর্থ দফতরের সঙ্গে কথা বলেছি। তৃতীয় বারে যদি একটাও দরপত্র না-আসে, আগের বারের একমাত্র দরদাতাকেই বরাত দেওয়া যেতে পারে।” তিনি জানান, বছরখানেক আগে পূর্ত দফতর যখন রাস্তা বা সেতু তৈরির জন্য বারবার দরপত্র ডেকেও কোনও ঠিকাদার পাচ্ছিল না, তখনই এই ধরনের বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল অর্থ দফতর।
কিন্তু কেন একটির বেশি দরপত্র আসছে না, সেই রহস্যের শিকড়ে পৌঁছতে চাইছে খাদ্য দফতর। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “এখন (ডিলাররাই যেখানে লরি ভাড়া করেন) ন্যূনতম আট কিলোমিটার পর্যন্ত লরি-পিছু ১৮০০ টাকা ভাড়া দেয় খাদ্য দফতর। ডিলার বা লরি-মালিক কেউ কোনও দিন এই নিয়ে আপত্তি করেননি। কিন্তু আমরা দু’বার নিজেদের দায়িত্বে গম পাঠানোর প্রস্তাব দিলাম। দু’বারই দরপত্রে আট কিলোমিটারের জন্য লরি-পিছু ৬৫০০ টাকা ভাড়া দাবি করা হল!”
সরকারি সূত্রের খবর, দরপত্র ডাকার আগে খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক একাধিক বার লরি-মালিকদের ডেকে বৈঠক করেছিলেন। দু’-একটি বৈঠকে ছিলেন পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রও। এক খাদ্যকর্তা বলেন, “বৈঠকে লরি-মালিকদের কয়েক জন ডিজেল ও গাড়ির যন্ত্রাংশের দাম বাড়ার প্রসঙ্গ তুললে সরকার প্রস্তাব দেয়, তাঁদের দাবি বিবেচনা করে ন্যূনতম লরি-ভাড়া ১৮০০ থেকে বাড়িয়ে ৪৫০০ টাকা করা হবে। কিন্তু লরি-মালিকদের একাংশ ওই প্রস্তাব মানেননি। ফলে দরপত্র ডাকার পথেই হাঁটে খাদ্য দফতর।”
দরপত্রের পথেও যে এ ভাবে হোঁচট খেতে হবে, ভাবতে পারেননি খাদ্যকর্তারা। এর মধ্যে চক্রান্ত দেখছেন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয়বাবু। তিনি বলেন, “কিছু লরি-মালিক ও ডিলারদের একাংশের যোগসাজশে এফসিআই গুদামগুলিতে সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। তারাই ষড়যন্ত্র করে দরপত্রে অন্যদের যোগ দিতে বাধা দিচ্ছে।” তাঁর প্রশ্ন, এখন তো ১৮০০ টাকাতেই পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। তা হলে লরি-মালিকেরা ৪৫০০ টাকায় রাজি হলেন না কেন? কেনই বা এক জনের বেশি দরপত্রে যোগ দিলেন না? সেই এক জনের দরপত্রেও এমন টাকা দাবি করা হল, যাতে সরকারই পিছিয়ে আসে!
লরি-মালিকেরা অবশ্য খাদ্যমন্ত্রীর অভিযোগ মানতে রাজি নন। তাঁদের সংগঠন ফেডারেশন অব ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্রাক অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতা সত্যজিৎ মজুমদার বলেন, “ডিজেল থেকে যন্ত্রপাতি সব কিছুরই দাম বেড়েছে। তাই খাদ্য দফতর যে-ভাড়া দিচ্ছে, তাতে আর লরি দেওয়া সম্ভব নয়।” তা হলে রেশন ডিলারেরা নিজেরা যখন লরি ভাড়া করছেন, ১৮০০ টাকাতেই তা পাওয়া যাচ্ছে কী ভাবে? সত্যজিৎবাবুর জবাব, “ওঁরা (রেশন দোকানিরা) বংশপরম্পরায় এই কাজ করছেন। সম্পর্কের খাতিরে কিছুটা ক্ষতি স্বীকার করা যেতেই পারে।” প্রায় একই সুরে রেশন ডিলার সংগঠনের নেতা বিশ্বম্ভর বসু বলেছেন, “বহু বছর ধরে আমরা লরি-মালিকদের সঙ্গে কাজ করছি। তাই ওঁরা কম ভাড়াতেই গাড়ি দেন। এর মধ্যে খাদ্যমন্ত্রী যদি চক্রান্তের গন্ধ পান, সেটা দুর্ভাগ্যজনক।”
এখন কলকাতা ও হাওড়ার রেশন দোকানগুলিতে মাসে প্রায় ১৬ হাজার মেট্রিক টন গম সরবরাহ করে খাদ্য দফতর। কিন্তু তার ৭০ শতাংশ খোলাবাজারে চলে যাচ্ছে বলে খাদ্যকর্তাদের একাংশের অভিযোগ। তাঁদের বক্তব্য, শহরাঞ্চলে আটা-চাক্কি লুপ্ত হতে বসেছে। রেশন থেকে গম তুলেও অনেক এলাকায় তা ভাঙানোর সুবিধা নেই। তা ছাড়া শহুরে মানুষের ঝোঁক এখন প্যাকেটবন্দি আটার দিকেই। খাদ্যমন্ত্রী বলছেন, গম পাচার রুখে খাদ্য দফতর যদি নিজেরাই রেশনে প্যাকেটবন্দি আটা বিক্রি করে, সুবিধা হবে দু’দিক থেকে। আমজনতা তুলনায় কম দামে প্যাকেটের আটা পাবেন, তেমনই লাভ সরকারেরও।
|