জয়নগরের মোয়া এ বার বিদেশে রফতানি করতে চাইছে রাজ্য সরকার। বৃহস্পতিবার বিধানসভায় প্রশ্নোত্তর পর্বে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ মন্ত্রী সুব্রত সাহা এ কথা জানান। ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ প্যাকেজিং’(আইআইপি) এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সরকারের কথাবার্তা প্রায় শেষপর্যায়ে পৌঁছেছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহায্যে মোয়া সংরক্ষণ করে এবং আইআইপি-র সাহায্যে প্যাকেট-বন্দি করে ভিন্ দেশে পাঠানো যেতে পারে।
খবর শুনে খুশি দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর কিংবা বহড়ুর মোয়া ব্যবসায়ীরা। দেশ জোড়া খ্যাতির মুকুট বহু আগেই উঠেছে তাদের মাথায়। এ বার বিদেশের মাটিতেও সেই নাম-ডাক ছড়াবে শুনে কার না ভাল লাগে। কিন্তু ভাল লাগলেই তো হল না। বিদেশে পাঠাতে হলে মোয়ার মান বজায় রাখাও তো জরুরি। আর সমস্যা সেখানেই। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভাল নলেন গুড়ই পাওয়া মুশকিল ইদানীং। ভাল মোয়াটা হবে কোত্থেকে?
জয়নগরকে কেন্দ্র করে আশপাশের এলাকায় খেজুর গাছের সুসংহত চাষেরই কোনও ব্যবস্থা নেই। বনে-বাদাড়ে অযত্নে-অবহেলায় গজিয়ে ওঠা খেজুর গাছের রসই ভরসা। তার উপর গাছের সংখ্যাও কমছে দিন দিন। কোথাও গাছ কেটে জনবসতি হচ্ছে। কোথাও ভেড়ি, ইটভাটার দাপটে খেজুর গাছের ত্রাহি মধুসূদন দশা। বসিরহাট মহকুমার নাম-ডাক ছিল নলেন গুড় তৈরিতে। কিন্তু সেখানেও গাছের সংখ্যা কমছে। ভেজাল মেশানো হচ্ছে গুড় তৈরিতে। স্বাদ-গন্ধের দফারফা। |
বছরের কয়েকটা মাত্র মাস রস আসে গাছে। গাছ কাটা, রস নামানো, সেই রস জাল দেওয়া দীর্ঘ প্রক্রিয়ার প্রত্যেকটিতে দক্ষ হাতের ছোঁয়া দরকার। না হলে গন্ধে-স্বাদে মানোত্তীর্ণ হয় না সেই গুড়। কিন্তু ‘শিউলি’ বা ‘গাছি’র (খেজুর গাছ কাটেন যাঁরা) সংখ্যা কমছে দিন দিন। অন্য পেশা বেছে নিচ্ছে পরবর্তী প্রজন্ম। গুড় তৈরির কাজে যুক্ত পাকা হাতের সংখ্যাও কমছে। দক্ষতা যে এই পেশায় কতটা জরুরি, সে কথা বহু দিন আগে ‘রস’ গল্পে বলে গিয়েছিলেন নরেন্দ্রনাথ মিত্র। সুন্দরী নতুন বৌ ঘরে আনবে বলে মাজু খাতুনকে তালাক দিয়েছিল গল্পের নায়ক মোতালেফ মিঞা। সে পেশায় শিউলি। তার আনা রস জাল দিয়ে মাজু গুড় তৈরি করত। সে গুড়ের গন্ধে-স্বাদে মেতে উঠত গোটা তল্লাট। কিন্তু নতুন বৌয়ের হাতে তেমন জাদু কোথায়? গুড়ের কদর কমতে শুরু করে মোতালেফের। যার পরিণতিতে পুরনো বৌয়ের কাছেই ফিরতে হয় তাকে।
জয়নগরের মোয়াকে আন্তর্জাতিক বাজারে জায়গা করে নিতে হলে ভাল গুড়ের নিয়মিত জোগান দরকার, সে কথা বিলক্ষণ জানেন সরকারি কর্তারা। জয়নগরের ‘মোয়া বাঁচাও কমিটি’র তরফে বাবলু ঘোষ, রঞ্জিৎ ঘোষেরা জানান, ক’দিন আগে কমিটির কনভেনশনে ঠিক হয়, খেজুর গাছের চাষ করে ভাল গুড় জোগান দেওয়ার জন্য বলা হবে সরকারকে। মোয়া বানাতে বাঁকুড়া ও বর্ধমান থেকে উন্নতমানের খেজুর গুড় আনার কথা চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে বলে এ দিন বিধানসভায় জানিয়েছেন মন্ত্রী। তাঁর মতে, ওই সব অঞ্চলে অনেক ভাল মানের খেজুর গাছ থাকা সত্ত্বেও সেখান থেকে রস সংগ্রহের তেমন কোনও উদ্যোগ এখনও পর্যন্ত নেই। মোয়া ব্যবসায়ীদের আশা, বিদেশের বাজারে রফতানি শুরু হলে অনেকে হয়তো ব্যবসায় মন দেবেন। শিউলির পেশাতেও আসতে আগ্রহ বোধ করবে নতুন প্রজন্ম।
ভাল গুড় তৈরি হবে। বিধানসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে সুব্রতবাবু এ-ও বলেছেন, খেজুর রস যাঁরা সংগ্রহ করেন তাঁদেরকেও সরকারি অনুদান দেওয়া যাতে পারে। সরকারের চিন্তা-ভাবনাকে স্বাগত জানিয়েছেন জয়নগরের এসইউসি বিধায়ক তরুণ নস্কর।
|