গুড়ে পাক দেবে কে,
খুঁজছে জয়নগর-বহড়ু
শীত আছে নিজের মেজাজে। আগের মতো হাঁড়ি না উপচালেও খেজুরের রসও আছে।
শুধু নরেন মিত্রের গল্পের মাজু খাতুনেরা কোথায় যেন উবে গিয়েছে। হাতের সেই পাক আর নেই।
সেই সঙ্গে উধাও হয়েছে মিথ হয়ে যাওয়া ‘জয়নগরের মোয়া’র অমৃততুল্য স্বাদ-গন্ধও। বাঙালির শীত বলতেই যে সকালের মিঠে রোদে পিঠ দিয়ে জয়নগর আর বহড়ুর মোয়া, তার জোগানেই এখন টান।
অথচ মোয়া হয় যে ধানে, সেই কনকচূড়ের কোনও কমতি নেই। দক্ষিণ ২৪ পরগনার মন্দিরবাজার, কাকদ্বীপের কাশীনগর, রায়দিঘি, লক্ষ্মীকান্তপুর ও মথুরাপুরে ঢেলে সে ধানের চাষ হচ্ছে।
আর তার সঙ্গে লাগে নলেন গুড়। বিপত্তি সেখানেই।
শীতের তিন মাস কাকদ্বীপ, জয়নগর, রায়দিঘি, মথুরাপুর, মন্দিরবাজার, কুলপি এলাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে বহড়ুহাটে নলেন গুড় আসে। জয়নগর ও বহড়ুর কারিগরেরা তা কেনেন। যত দিন যাচ্ছে, ততই ভাল গুড়ের জোগান কমছে। আনাড়ি হাতের পাকে স্বাদ-গন্ধ হারিয়ে ফেলছে নলেন গুড়, সেই সঙ্গে মোয়াও।
গাছে হাঁড়ি বেঁধে খেজুর রস পেড়ে জ্বাল দেওয়ার লোক আগের তুলনায় কমলেও একেবারে উবে যায়নি। কোথাও তাদের বলে ‘গাছি’, কোথাও ‘শিউলি’। কিন্তু রস আর গুড় কি এক হল? গুড়ে সোয়াদ আনতে গেলে যে পাক লাগে, সেই হাতের তার আর আছে ক’জনের?
কাকদ্বীপের এক নলেন গুড় ব্যবসায়ী বিমল মাইতির কথায়, “সন্ধ্যায় গাছের ছাল কেটে মাটির হাঁড়ি ঝুলিয়ে পরের দিন ভোরে যে রস মেলে, তা ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে জ্বাল দিয়ে গুড় করতে হয়। না হলেই রস নষ্ট। খুবই পরিশ্রমের কাজ। নতুন প্রজন্মের ছেলেরা পড়াশোনা শেখার পরে এ কাজে আগ্রহ দেখাচ্ছে না।”
নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘রস’ গল্পে সুন্দরী নতুন বৌ ঘরে আনবে বলে মাজু খাতুনকে তালাক দিয়েছিল ‘গাছি’ মোতালেফ মিয়াঁ। তার আগে মাজুর হাতে পাক দেওয়া নলেন গুড় বেচেই সে দেনমোহরের (মুসলিম বিয়েতে কনের বাবাকে যে পণ দিতে হয়) টাকা তোলে। কিন্তু নতুন বৌ ফুলবানুর হাতে মাজুর মতো জাদু ছিল না। তার পাক দেওয়া গুড় বাজারে বিক্রিই হতে চায় না। তত দিনে মাজুও এক জনকে নিকাহ্ করে ফেলেছে। তবু দু’হাঁড়ি খেজুর রস নিয়ে শেষে তারই দ্বারস্থ হয় মোতালেফ ‘জ্বাল দিয়া দুই সের গুড় বানাইয়া দেওয়ার জইন্যে’।
চাইলেই হাতের কাছে একটা মাজু খাতুন আজ পাওয়া যায় না। পরিত্রাণের পথ খুঁজতে জয়নগর এবং বহড়ুর ব্যবসায়ীরা তাই ‘মোয়া বাঁচাও কমিটি’ গঠন করেছেন। আজ, বৃহস্পতিবার জয়নগরে তাঁদের কনভেনশন হওয়ার কথা। ব্যবসায়ীরা জানান, কাজটা খাটনির। প্রথমে কনকচূড় ধানের সঙ্গে টাটকা-তাজা নলেন গুড়ের পাক দেওয়া হয়। সেটা ঠান্ডা হলে ঘি, ছোট এলাচ গুঁড়ো, পেস্তা, কাজুবাদাম এবং নলেন গুড় দিয়ে ফের পাক দেওয়া হয়। শীতের তিন মাসে জয়নগর ও বহড়ু মিলিয়ে প্রায় আট-দশ কোটি টাকার ব্যবসা হয়। ব্যবসায়ী, কারিগর, চাষি, শিউলি মিলিয়ে প্রায় এক লক্ষ মানুষের রুজি-রোজগার হয়।
এক ব্যবসায়ীর কথায়, “অনেক ব্যবসায়ী আছেন, যাঁরা সারা বছরে ওই তিন মাসই রোজগার করেন।” কিন্তু ভাল গুড়ের অভাবে এখন তা শিকেয় ওঠার জোগাড়। এলাকার কোথাও খেজুর গাছের চাষ হয় না। পুকুরের ধারে বা রাস্তার পাশে যে গাছ বেড়ে ওঠে, সেটুকুই ভরসা। নতুন প্রজন্মের ছেলেরা না আসায় পুরনো শিউলিদের বয়স হয়ে গিয়েছে। গায়ে-হাত-পায়ে জোর কমছে। ফলে নলেন গুড়ের পরিমাণও কমছে। ‘মোয়া বাঁচাও কমিটি’র তরফে বাবলু ঘোষ এবং রঞ্জিত ঘোষ বলেন, “রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন করেছি, খেজুর গাছ চাষের কোনও ব্যবস্থা করা হোক।”
কিন্তু যাদের হাতের গুণে গুড় মিঠে হয়ে ওঠে, তেমন শিউলি আসবে কোথা থেকে?
বাবলুবাবুদের আশা, “মোয়ার ব্যবসায় জোয়ার এলে অনেকেই ফের গুড় তৈরিতে আগ্রহ দেখাবেন। যাঁরা পুরনো পেশা ছেড়ে এখন একশো দিনের কাজে দিনমজুরি করছেন, তাঁরাও ফের গুড় বানাবেন।” জয়নগরের এসইউসি বিধায়ক তরুণ নস্কর বলেন, “আমি ওঁদের বক্তব্য সুন্দরবন উন্নয়ন বোর্ডকে জানিয়েছি।” উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান তথা সাগরের তৃণমূল বিধায়ক বঙ্কিম হাজরা বলেন, “আলোচনা চলছে। কিন্তু এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি।”
শুকনো আলোচনায় কি আর মিঠে গুড় বা তোফা মোয়া ফলে?



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.