শব্দ-শহিদের ছয় মামলায় শাস্তি দূর অস্ত
হিসেব দাঁড়াচ্ছে ৬-০। শব্দবাজির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গত ১৬ বছরে রাজ্যে খুন হয়েছেন ছ’জন। কিন্তু ছ’টি ঘটনায় কোনও অপরাধীই সাজা পায়নি।
শাস্তি দেওয়া দূরে থাক, ১৯৯৭ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ওই ছ’টি ঘটনার মধ্যে একটি ক্ষেত্রে এ-পর্যন্ত কোনও মামলাই করেনি পুলিশ! আর বাকি পাঁচটি ক্ষেত্রে শুনানি থমকে রয়েছে।
পুলিশকর্তারা বলে থাকেন, অপরাধীদের কড়া সাজা দিলে সংশ্লিষ্ট অপরাধ অনেক কমে যায়। ধর্ষণের মামলায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান সেই জন্যই। ওই সব মামলার দ্রুত বিচারের ব্যবস্থাও হয়েছে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে। প্রশ্ন উঠছে, শব্দ-শহিদের ক্ষেত্রে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করে দুষ্কৃতীদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে না কেন? এ বার কালীপুজোর রাতে উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরে পিন্টু বিশ্বাস সপ্তম শব্দ-শহিদ হওয়ার পরে এই প্রশ্ন জোরদার হয়েছে।
পিন্টু-হত্যায় কোন কোন ধারায় মামলা করা যায়, তা ঠিক করতে আগের ছ’টি ক্ষেত্রে কী করা হয়েছিল, পুলিশকর্তারা তা খতিয়ে দেখছেন। সোমবার সেই পর্যালোচনাতেই দেখা যায়, আগের ছ’টি ক্ষেত্রে কারও শাস্তি হয়নি। ওই ছ’টি মামলা কী অবস্থায় আছে, তার খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। যে-সব জেলায় ওই ছ’টি ঘটনা ঘটেছে, সেখানকার পুলিশ সুপারদের রিপোর্ট চেয়েছে পুলিশ ডিরেক্টরেট। প্রথম ছয় শব্দ-শহিদের মধ্যে দু’জন উত্তর ২৪ পরগনা, এক জন দক্ষিণ ২৪ পরগনা, এক জন পুরুলিয়া, এক জন হুগলি এবং এক জন পূর্ব মেদিনীপুরের। তাঁদের মধ্যে একমাত্র মহিলা শব্দ-শহিদ বকুল অধিকারী ছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার বীজপুর এলাকার পূর্ব কাবারিপাড়ার বাসিন্দা।
ওই সব মামলা এগোয়নি কেন?
সরাসরি জবাব মিলছে না। পুলিশি সূত্রের খবর, ছ’টির মধ্যে মামলা হয়েছে পাঁচটিতেই। সপ্তম তথা এ-পর্যন্ত শেষ শব্দ-শহিদ পিন্টুবাবুর ক্ষেত্রেও খুনের মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু হয়েছে। তবে পরিবেশকর্মীরা যাঁকে ষষ্ঠ শব্দ-শহিদ গণ্য করেন, ৭০ বছরের সেই পীযূষকান্তি সরকারের মৃত্যু নিয়ে মামলা হয়নি। তাঁর পরিবার কোনও অভিযোগও দায়ের করেনি। স্থানীয় বাসিন্দারা অবশ্য সুবিচার চেয়ে জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে গণস্বাক্ষরিত আবেদনপত্র পাঠিয়েছেন।
বাইপাস সার্জারি হয়েছিল পীযূষবাবুর। গত বছর কালীপুজোর পরের দিন, ১৩ নভেম্বর তাঁর বাড়ির সামনে শব্দবাজি ফাটানোর প্রতিবাদ করেন তিনি। রবীন্দ্রনগর থানায় অভিযোগও জানান। লাভ হয়নি। হতাশায় বাড়ি ফিরে যান তিনি। শুরু হয় বুকে ব্যথা। হাসপাতালে মারা যান বৃদ্ধ। প্রথম শব্দ-শহিদ শ্রীরামপুরের পিয়ারপুর-পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা দীপক দাস। তিনি মারা যান ১৯৯৭-এর ৩১ অক্টোবর। সেই বছর অক্টোবরেই রাজ্যে শব্দবাজি নিষিদ্ধ করা হয়। দীপক-হত্যায় অন্যতম অভিযুক্ত গৌতম মণ্ডল ১৯৯৯-এর ২৫ এপ্রিল খুন হন। তখন তিনি জামিনে মুক্ত ছিলেন। ২০০৮-এর ২৫ নভেম্বর চুঁচুড়ার জেলা সেশন জজ ন’জন অভিযুক্তকেই বেকসুর খালাস দেন। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ এ ব্যাপারে পুলিশকে হাইকোর্টে যেতে বলে। কিন্তু পুলিশ এখনও হাইকোর্টে আবেদন করেই উঠতে পারেনি!
শব্দবাজির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গত ১৬ বছরে প্রাণ দেন পাঁচ জন। তীব্র স্বরে মাইক বাজানোর প্রতিবাদ করায় ২০১১-র ২৮ মে খুন করা হয় পূর্ব মেদিনীপুরের দুর্গাচকের মনোরঞ্জন কুইতিকে। রাজ্যের পঞ্চম শব্দ-শহিদ তিনিই। শব্দ-শহিদদের থেমে থাকা মামলাগুলি যাতে নতুন করে খতিয়ে দেখা হয়, গত ডিসেম্বরে পুলিশের ডিজি-র কাছে সেই আবেদন করেন পরিবেশকর্মীরা। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতর থেকে তাঁদের চিঠি দিয়ে জানানো হয়, ওই সব মামলা নতুন করে খতিয়ে দেখতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তার পরে বিষয়টি আর এগোয়নি।
সংশ্লিষ্ট জেলাগুলি থেকে এ ব্যাপারে নবান্নে রাজ্য পুলিশের সদর দফতরে যে-সব রিপোর্ট এসেছে, তা দেখে পুলিশকর্তারা বিস্মিত। প্রতিটি ক্ষেত্রেই অভিযুক্তদের শনাক্ত করা হলেও এক জনেরও শাস্তি হয়নি। আইজি (আইনশৃঙ্খলা) অনুজ শর্মা সোমবার বলেন, “আমরা খোঁজ নিয়ে দেখছি, শব্দ-শহিদের মামলাগুলি কোন অবস্থায় আছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে ঠিক কী ঘটনা ঘটেছিল, সেটা আমরা নতুন করে খতিয়ে দেখছি। তার পরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এত দিনেও ওই সব মামলার নিষ্পত্তি না-হওয়ায় প্রাক্তন বিচারপতি থেকে শুরু করে পরিবেশকর্মী পর্যন্ত সকলে পুলিশকেই কাঠগড়ায় তুলেছেন। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশ্ন, পুলিশ এত দিন কী করছিল? তাঁর কথায়, “পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার জন্যই শব্দ-শহিদ মামলায় হত্যাকারীদের সাজা হয়নি। ফলে শব্দদৈত্যের শক্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। যারা শব্দবাজি ব্যবহার করে, তাদের স্পর্ধা আর ঔদ্ধত্য বেড়েছে।” তিনি মনে করেন, পুলিশ অন্তত দু’তিনটি ঘটনায় দোষীদের সাজার ব্যবস্থা করতে উদ্যোগী হলে শব্জবাজি ফাটানোর দুঃসাহস কিছুটা কমত। শব্দবাজির প্রতিবাদে সরব মানুষদের হত্যা বা নিগ্রহের ঘটনায় রাশ টানা যেত।
পরিবেশকর্মী ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য আইন আধিকারিক বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, “মামলাগুলির দ্রুত নিষ্পত্তি চেয়ে শীঘ্রই কলকাতা হাইকোর্টে জনস্বার্থের মামলা করব। শব্দ-শহিদের সব মামলা তো বটেই, সেই সঙ্গে কলকাতায় শব্দবাজির প্রতিবাদ করায় প্রতিবন্ধী যুবককে মারধরের ঘটনায় রুজু হওয়া মামলারও দ্রুত নিষ্পত্তি চাই আমরা।”
পরিবেশ নিয়ে কর্মরত বিভিন্ন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সংগঠন ‘সবুজ মঞ্চ’-এর পক্ষে নব দত্ত বলেন, “নাগরিক সমাজ ফের পথে নামবে। যে-ভাবে শব্দবাজির বিরুদ্ধে পথে নেমেছিলাম, মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দাবি করেছিলাম, এ ক্ষেত্রেও তা-ই হবে।”

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.