শব্দবাজির বিরুদ্ধে সরকারি প্রচার, পুলিশের হুঁশিয়ারিই সার। দেদার শব্দবাজির ব্যবহার থামেনি। আর থামেনি প্রতিবাদীর উপরে হামলা। শনিবার ও রবিবার এমন তিনটি ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইল পশ্চিমবঙ্গ। একটিতে উত্তর ২৪ পরগনায় এক জন খুনই হয়ে গিয়েছেন। দ্বিতীয়টিতে কলকাতায় এক প্রতিবন্ধী যুবককে ব্যাপক মারধর করা হয়েছে, ভেঙে দেওয়া হয়েছে তাঁর হুইলচেয়ার। কলকাতাতেই আর একটি ঘটনায় আক্রান্ত হয়েছেন এক মহিলা-সহ তিন জন। অভিযোগ, এঁরা সবাই শব্দবাজি ফাটানোর প্রতিবাদ করেছিলেন।
অশোকনগরের এজি কলোনির সুকান্তপল্লির বাসিন্দা পিন্টু বিশ্বাস (৪০) শনিবার রাতে পাড়ার ক্লাবের কিছু ছেলেকে শব্দবাজি ফাটাতে বারণ করেছিলেন। পরিবারের দাবি, পাড়ার এক বৃদ্ধা দিন চারেক আগে মারা গিয়েছেন, বাড়িতে রয়েছেন তাঁর অসুস্থ স্বামী। এ অবস্থায় বাজি ফাটানোয় আপত্তি তুলেছিলেন পিন্টুবাবু। আর্জি মানা তো হয়ইনি, উল্টে তাঁর সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়ে কিছু ছেলে। যার জেরে চপার দিয়ে কুপিয়ে, মাথায় শাবলের ঘা মেরে পিন্টুবাবুকে খুন করা হয়েছে বলে অভিযোগ। শনিবার রাতেই কলকাতার চারু মার্কেট থানার উল্টো দিকে শব্দবাজির প্রতিবাদ করায় রতন মুদি নামে এক প্রতিবন্ধী যুবকের হুইলচেয়ার ভেঙে তাঁকে রাস্তায় ফেলে দুষ্কৃতীরা বেধড়ক পেটায় বলে অভিযোগ। মারধরের জেরে রতনবাবুকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। রবিবারই অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে যে, শব্দবাজির প্রতিবাদ করে এ দিন দুপুরে টালিগঞ্জে প্রহৃত হয়েছেন একই পরিবারের এক মহিলা-সহ তিন জন। কলকাতার দুই ঘটনায় এ দিন রাত পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি। অশোকনগরের হত্যাকাণ্ডে দু’জন ধরা পড়েছে। উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “এই ঘটনায় গৌতম বল্লভ ও সুমিত বিশ্বাস নামে দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকি অভিযুক্তদের খোঁজ চলছে।” ধৃতদের চার দিনের পুলিশি হেফাজত হয়েছে। তবে পিন্টুবাবুর খুনের পিছনে পুরনো বিবাদের ছায়া দেখছে পুলিশ। পরিবেশমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষদস্তিদারেরও দাবি, “অশোকনগরের ঘটনা মূলত দু’দল দুষ্কৃতীর বিরোধের পরিণাম। এর সঙ্গে শব্দবাজি ফাটানোর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই।” |
স্থানীয় বাসিন্দা ও নিহতের পরিবার অবশ্য এই ‘তত্ত্ব’ মানতে নারাজ। পরিবারের অভিযোগ, শনিবার সন্ধে থেকে বিকট শব্দে বাজি ফাটানো হচ্ছিল। পিন্টুবাবুর প্রতিবাদ করায় পাড়ার কিছু ছেলের সঙ্গে তাঁর বচসার সূত্রপাত, যার জেরে ওঁকে পিটিয়ে-কুপিয়ে খুন করা হয়েছে। পিন্টুবাবুর স্ত্রী নমিতাও এই দাবি করছেন, যদিও ধৃত গৌতমের সঙ্গে পিন্টুর পুরনো শত্রুতার কথা তিনি অস্বীকার করেননি। নমিতার ব্যাখ্যা, তাঁদের কিশোরী মেয়েকে মাস কয়েক আগে প্রেম নিবেদন করেছিল গৌতম। পিন্টু সে জন্য ওকে মারধর করেছিলেন। গৌতম তার পরে মাস ছয়েক পাড়াছাড়া ছিল। পুলিশ-সূত্রের খবর, পিন্টুবাবুর নামেও পুলিশের খাতায় খুন-ডাকাতির একাধিক নালিশ আছে। জামিনে ছাড়া পেয়ে তিনি বছর দু’য়েক আগে এলাকায় জমি ও মাছের কারবার শুরু করেন। নমিতার কথায়, “আমার স্বামী অসামাজিক কাজকর্ম ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছিলেন। তা ছাড়া শব্দবাজির প্রতিবাদ করে উনি তো কোনও অন্যায় করেননি! তা হলে ওঁকে এ ভাবে মারা হল কেন?”
কী হয়েছিল শনিবার রাতে?
পিন্টুর স্ত্রী পুলিশকে জানিয়েছেন, পড়শি বৃদ্ধার সদ্য মৃত্যুর পরে তাঁর অসুস্থ স্বামীর কথা মাথায় রেখে পিন্টুবাবু ক্লাবের ছেলেদের গভীর রাতে বাজি ফাটাতে নিষেধ করেছিলেন। অভিযোগ: গৌতম-সুমিতের মতো পাড়ার কিছু উঠতি যুবক সে কথায় কান দেয়নি। তারা তর্ক শুরু করে। সুমিতকে চড় মারেন পিন্টুবাবু। তখন মোবাইলে ফোন করে বাইরের কিছু ছেলেকে ডেকে এনে তারা পিন্টুবাবুর উপরে চড়াও হয়। ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে দেওয়া হয়, সঙ্গে চলে চপারের কোপ। প্রত্যক্ষদর্শী-সূত্রের খবর, পিন্টুবাবু মার খেতে খেতে পাশের নর্দমায় পড়ে যান। সেখানেই তার মাথায় শাবলের ঘা পড়ে। আর্তনাদ শুনে কিছু প্রতিবেশী ছুটে এসেছিলেন। কিন্তু হামলাকারীরা তাঁদের ধারে-কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। দুষ্কৃতীরা চলে যাওয়ার পরে পিন্টুবাবুকে হাবরা স্টেট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার ডাক্তারেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
পরিবেশ-কর্মীরা ইতিমধ্যে পিন্টু বিশ্বাসকে পশ্চিমবঙ্গের ‘সপ্তম শব্দ-শহিদ’ আখ্যা দিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, এর আগে এ রাজ্যের ছ’জন শব্দ-দূষণের প্রতিবাদ করে প্রাণ হারিয়েছেন, পিন্টুবাবু সে তালিকায় নবতম সংযোজন। পরিবেশকর্মী তথা রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য আইন-আধিকারিক বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “পুরনো শত্রুতা যা-ই থাকুক, খুন হওয়ার ঠিক আগে শব্দবাজি ফাটানোকে কেন্দ্র করেই দুষ্কৃতীদের সঙ্গে ওঁর গণ্ডগোল হয়েছিল। পিন্টুবাবু শব্দবাজি ফাটানোর প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি অবশ্যই এ রাজ্যের সপ্তম শব্দ-শহিদ।” পিন্টু বিশ্বাস হত্যার নিন্দায় সরব হয়েছে সমাজের বিভিন্ন মহল। কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বর্বরোচিত আচরণ। সভ্য সমাজে থাকার অধিকার নেই এদের। সমস্ত মানুষ একত্রিত হয়ে এ সবের প্রতিবাদ করা উচিত। শব্দবাজি বিক্রেতারাও দায় এড়াতে পারেন না।” ১৯৯৭-এ ভগবতীবাবুর আমলেই কার্যত এ রাজ্যে শব্দ-বিধি বলবৎ হয়েছিল। প্রাক্তন বিচারপতির খেদ, “আজ পর্যন্ত কোনও শব্দ-শহিদের আততায়ীরা শাস্তি পায়নি।” আর বিশ্বজিৎবাবুর প্রশ্ন, “যেখানে আতসবাজি উন্নয়ন সমিতির শীর্ষ কর্তাই খোলাখুলি বলছেন যে, তাঁরা টন টন নিষিদ্ধ শব্দবাজি বানিয়ে বেচেছেন, সেখানে এই ধরনের ঘটনা কি খুব অস্বাভাবিক?” পরিবেশকর্মী নব দত্তের দাবি, “দোষীদের এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া উচিত, যাতে আর কেউ এমন কাজ করার সাহস না পায়। এ বার শব্দবাজি নিষিদ্ধ করা-না করাকে ঘিরে যা টালবাহানা গোড়া থেকে হয়েছে, তাতে এমন কাণ্ড ঘটা স্বাভাবিক ছিল।” বাজির কারবারীরা কী বলেন?
সারা বাংলা আতসবাজি উন্নয়ন সমিতির চেয়ারম্যান বাবলা রায়ের বক্তব্য, “বাজি ফাটানোকে কেন্দ্র করে এমন ঘটনা ঘটে থাকলে আমরা তীব্র প্রতিবাদ করছি। পুলিশকে অনুরোধ করছি চরমতম ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু আমার কাছে যা খবর, অশোকনগরে শব্দবাজি নয়, বোমা ফাটানো হচ্ছিল। সেই সঙ্গে দু’পক্ষের মধ্যে পুরনো গণ্ডগোলও ছিল।”
কলকাতার দু’টি ঘটনায় অবশ্য এখন পর্যন্ত ‘পুরনো শত্রুতা’র তত্ত্ব মাথা চাড়া দেয়নি। প্রতিবন্ধী রতনবাবুকে মারধর করা হয় চারু মার্কেট থানা এলাকার সুলতান আলম রোডে। ওই যুবক হুইলচেয়ারে চড়ে ঘুরে-ঘুরে মোমবাতি-ধূপকাঠি বিক্রি করেন। পুলিশ-সূত্রের খবর, শনিবার রাত সাড়ে দশটা নাগাদ খাবার কিনে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। ঠিক বাড়ির সামনে স্থানীয় দুই কিশোর আচমকা হুইলচেয়ারের নীচে চকোলেট বোমা ছুড়ে দেয়। প্রতিবাদ করলে তারা আরও শব্দবাজি ফাটায়। শেষে রতনবাবুকে শারীরিক নিগ্রহ করে বলে অভিযোগ। কী রকম?
এ দিন এমআর বাঙুর হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে রতন বলেন, “আমি ওদের বলেছিলাম, বাজি বন্ধ না-করলে পুলিশে খবর দেব। ওরা কান দেয়নি। ঠিক তখনই আমার মোবাইলে একটা ফোন আসে। ওরা ভাবে, আমি পুলিশকে খবর দিচ্ছি। দু’জন আমাকে ঘিরে ধরে মারতে শুরু করে।” প্রতিবন্ধী যুবকটির অভিযোগ, “মারতে মারতে আমাকে মাটিতে ফেলে দিল। তার পরেও লাঠি দিয়ে পেটাল! চলাফেরার একমাত্র সম্বল হুইলচেয়ারটাও ভেঙে দিয়েছে।”
পুলিশ জানিয়েছে, শনিবার রাতে রতনবাবুর এক আত্মীয় ও কয়েক জন পড়শি ওঁকে বাঙুর হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে চিকিৎসার পরে বাড়ি ফিরে এ দিন চারু মার্কেট থানায় অভিযোগ দায়ের করেন তিনি। বিকেলে অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে ফের হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছে। কলকাতার দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটেছে এ দিন বিকেলে, টালিগঞ্জ থানার ডাক্তার শরৎ ব্যানার্জি রোডে। পুলিশের খবর, লাগোয়া বস্তির এক মহিলা ছেলেকে নিয়ে হেঁটে ফিরছিলেন। আচমকা এক বহুতলের চারতলা থেকে শব্দবাজি এসে পড়ে ছেলের সামনে। মা প্রতিবাদ করতে বহুতলে ঢুকলে বাড়ির এক নিরাপত্তারক্ষী তাঁকে মারধর করেন বলে অভিযোগ। মহিলা ফিরে গিয়ে বাড়ির লোকজনকে খবর দেন। অভিযোগ, তাঁরা প্রতিবাদ জানাতে এলে তাঁদের ফের মারধর করা হয়, যাতে আরও দু’জন জখম হয়েছেন। |