শেষ পর্যন্ত বিতর্কে ইতি টেনে দিল আলিমুদ্দিন। বর্ধমানের পুরভোটে প্রার্থী প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের পাশ থেকে সরেই দাঁড়াল তারা। সন্ত্রাসের কারণ দেখিয়ে ভোটের দিন ময়দান ছাড়ার সিদ্ধান্ত ঠিক হয়নি বলে জানিয়ে দিল সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর লিখিত রিপোর্ট। লড়াইয়ের মানসিকতা দেখাতে না-পারার জন্য তিরস্কৃত হতে হল চাকদহের স্থানীয় নেতৃত্বকেও।
পঞ্চায়েত ভোটের রেশ কাটার আগেই সেপ্টেম্বরে ভোট হয়েছিল ১২টি পুরসভায়। শাসক দলের সন্ত্রাস এবং তা নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের নিষ্ক্রিয়তার কথা বলে ভোট শুরুর কয়েক ঘণ্টা পরেই বর্ধমান পুরসভা থেকে প্রার্থী প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জেলা নেতৃত্ব। তার পরে একই ঘটনা ঘটেছিল চাকদহ পুরসভাতেও। নদিয়া জেলা নেতৃত্বের অনুমতি না নিয়েই চাকদহের স্থানীয় সিপিএম নেতৃত্ব সে দিন ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে দলের পর্যালোচনায় উঠে এসেছিল। তার প্রেক্ষিতেই রবিবার আলিমুদ্দিনে রাজ্য কমিটির বৈঠকে পেশ-হওয়া রাজ্য সম্পাদকের রিপোর্টে প্রার্থী প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তকে নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, ‘দুর্বল মানসিকতা’র জন্য রিপোর্টে সমালোচনা হয়েছে উত্তর ২৪ পরগনার পানিহাটিরও। দলের অন্দরে বর্ধমানের কৌশলের বিরোধিতায় সরব ছিল গৌতম দেবের জেলাই।
আলিমুদ্দিনের বিশ্লেষণে, উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে পুরভোটে সন্ত্রাস ও ভয়-ভীতি অপেক্ষাকৃত কম ছিল। সর্বত্রই সন্ত্রাসের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হলেও লড়াইয়ের রাজনৈতিক সদিচ্ছা কেন হারিয়ে ফেলতে হবে, সেই প্রশ্নই তুলতে চেয়েছেন রাজ্য নেতৃত্ব। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘সন্ত্রাস সত্ত্বেও যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দৃঢ়তা নিয়ে পার্টির লড়াই করার প্রয়োজন ছিল, সর্বত্র তা সমান ভাবে সম্পন্ন হয়নি।’ এই সূত্রেই এসেছে চাকদহের কথা। যেখানে বলা হয়েছে, ‘নদিয়ার চাকদহ পুরসভায় লড়াইয়ের মানসিকতার গুরুতর অভাব স্থানীয় ভাবে প্রবল ছিল’। আর বর্ধমানের ক্ষেত্রে রাজ্য নেতৃত্বের মত, সেখানে ২০১১ সাল থেকেই লাগাতার সন্ত্রাস চলছে। পুরভোটে বেশ কিছু বুথে পোলিং এজেন্ট দেওয়া যায়নি। এজেন্টদের কয়েকটি বুথ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে এবং প্রার্থীদের উপরেও হামলা হয়েছে। রিপোর্ট সাফ বলছে: ‘এই অবস্থায় প্রার্থী প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হওয়ায় প্রার্থী ও পোলিং এজেন্ট সকলেই বেরিয়ে এসেছেন। রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী প্রার্থী প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি বলে মনে করে’।
ভোটের ময়দানে টিকে থাকতে পারলে যেখানে যেখানে কিছুটা সুষ্ঠু ভোট হচ্ছে, সেখানে জনমত যাচাই করার সুযোগ পাওয়া যায়। এই যুক্তির উপরে দাঁড়িয়েই বর্ধমানের সিদ্ধান্তের সমালোচনা হচ্ছিল দলে। কিন্তু সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্বকে আরও ভাবিয়েছে, বর্ধমানের সৌজন্যে রণে ভঙ্গ দেওয়ার বার্তা ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা। রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “ভোট হচ্ছিল ১২টি পুরসভায়। বর্ধমান হঠাৎ করে সরে দাঁড়াল! চাকদহেও একই জিনিস ঘটল। এর ফলে অন্য অনেক জায়গাতেও মানুষ মনে করে থাকতে পারেন, যারা লড়তে পারছে না বা চাইছে না, তাদের সমর্থন করে কী লাভ!” বস্তুত, পানিহাটির সমালোচনা করলেও রাজ্য নেতৃত্বের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, বর্ধমানের সিদ্ধান্ত সেখানে খানিকটা প্রভাব ফেলেছিল।
দক্ষিণবঙ্গে পঞ্চায়েত ভোটে বামেরা তুলনামূলক ভাবে ভাল ফল করেছিল নদিয়ায়। সেই জেলারই চাকদহে ভোট থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত সিপিএমের মধ্যেই বড় বিস্ময় তৈরি করেছিল। নদিয়া জেলা সম্পাদক সুমিত দে সেই ২১ সেপ্টেম্বর তারিখ দলেরই কর্মসূচিতে রাজ্যের বাইরে ছিলেন। বয়কটের পথে যাওয়ার জন্য শেষ পর্যন্ত তোপের মুখে পড়তে হয়েছে চাকদহের স্থানীয় নেতৃত্বকেই। রাজ্য নেতৃত্বের রিপোর্ট অনুযায়ী, ‘বর্ধমানে প্রার্থী প্রত্যাহারের পরে চাকদহে নদিয়া জেলা নেতৃত্বের অনুমোদন ছাড়াই স্থানীয় নেতৃত্ব সন্ত্রাসের কারণে প্রার্থী প্রত্যাহার ও ভোট বয়কট করেন। নদিয়া জেলা কমিটিতে চাকদহ লোকাল ও জোনাল নেতৃত্বের তীব্র সমালোচনা করা হয় এবং তাঁরা তা গ্রহণ করেন’। রাজ্য নেতৃত্বের রিপোর্টই বিপক্ষে যাওয়ায় এ দিন রাজ্য কমিটির বৈঠকে বিতর্ক বাড়াতে চাননি বর্ধমান জেলা নেতৃত্ব। বর্ধমানের পরিস্থিতি বিচার করেই যে ওই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল, এটুকুই ফের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন তাঁরা। আর জবাবি ভাষণে রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর বার্তা, প্রতিকূলতার মধ্যেও সামনের ভোটে ‘দৃঢ়তা সহকারে’ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। কারণ, মানুষের কাছে দলের বক্তব্য পৌঁছে দেওয়া কর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। |