ক্ষতিপূরণের নির্দেশ হয়। কিন্তু তা মানেন ক’জন?
পরিসংখ্যান বলছে, চিকিৎসায় গাফিলতির ক্ষেত্রে এ রাজ্যে বিভিন্ন সময়ে যত চিকিৎসককে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের ৩০ শতাংশেরও বেশি ওই নির্দেশ মানেননি। বিভিন্ন দরজায় ঘুরে জুতোর শুকতলা ক্ষইয়ে শেষ পর্যন্ত বাস্তবটা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন ভুক্তভোগীদের অনেকেই। আবার মামলা দায়ের করার পরে বছরের পর বছর কেটে গেলেও শুনানির ডাক আসেনি এমন পরিবারের সংখ্যাও কম নয়।
অনুরাধা সাহা মামলায় সুপ্রিম কোর্টের বৃহস্পতিবারের রায় এ বার এ রাজ্যের ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে ভিড় জমানো বহু মানুষকে আশার আলো দেখাবে বলে মনে করছেন অনেকেই।
লেকটাউনের বাসিন্দা অনিরুদ্ধ সমাজপতি হাতের একটি অস্ত্রোপচারের জন্য ইএম বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। অস্ত্রোপচারের তিন ঘণ্টার মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়। চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ এনে তাঁর পরিবার সংশ্লিষ্ট অর্থোপেডিকের বিরুদ্ধে ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে মামলা করে। আদালত চিকিৎসককে ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিয়েছিল। চার বছর পরেও সে টাকা পাননি অনিরুদ্ধবাবুর প্রৌঢ়া স্ত্রী। শুক্রবার তিনি বলেন, “অন্যায়ের প্রতিকার চাইতে গেলে লেগে থাকতে হবে, হাল ছাড়লে চলবে না। সুপ্রিম কোর্টের রায় শুনে এই শিক্ষাটাই পেলাম। এ বার জেলা আদালতে যাব।”
২০০৯ সালের মে মাসে সল্টলেকের এক বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছিল বালিগঞ্জের বাসিন্দা দীপ্তি সেনের। একই দিনে পরপর পাঁচটি স্টেন্ট বসেছিল। অস্ত্রোপচারের দু’সপ্তাহের মাথায় তিনি মারা যান। চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ তুলে জেলা ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের দ্বারস্থ হন দীপ্তিদেবীর পরিবারের লোকেরা। অভিযুক্ত চিকিৎসকের কাছ থেকে ৭০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেন তাঁরা। শুক্রবার দীপ্তিদেবীর স্বামী দীপক সেন বলেন, “গত চার বছরে নিষ্পত্তি তো দূরের কথা, এক দিনও শুনানির জন্য ডাকা হয়নি আমাদের।”
শুক্রবার রাজ্য ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের কর্তাদের এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তাঁরা বলেন, “এমন অভিজ্ঞতা যাঁদের হয়েছে তাঁরা দফতরে এসে যোগাযোগ করুন। প্রয়োজনে লিখিত অভিযোগ দায়ের করুন।” অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে ক্রেতা সুরক্ষা দফতরও আরও নড়েচড়ে বসবে বলে মনে করছেন ভুক্তভোগীরা। রাজ্য ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের রেজিস্ট্রার দেবীপ্রসাদ জানা বলেন, “গত এক বছরে ক্রেতা সুরক্ষা মামলার পরিমাণ ৬০ শতাংশ বেড়েছে।” মহিলা, তপসিলি জাতি এবং উপজাতিভুক্ত কেউ বা ষাটোর্ধ্ব কোনও ব্যক্তি কমিশনে অভিযোগ জানাতে এলে আইনজীবী সহায়তা থেকে শুরু করে আর্থিক সহায়তাও পাবেন তাঁরা। আধিকারিকেরা মানছেন, দীর্ঘদিন পর্যন্ত ক্রেতা সুরক্ষা দফতর নিয়ে মানুষের কোনও ধারণাই ছিল না। “ইদানীং দফতর বিভিন্ন মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রমশ মানুষের মনে সচেতনতা বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। এখন এটা ধরে রাখাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।” এবং এই ধরে রাখার চ্যালেঞ্জটা যে সব সময় রাখা যায়নি, একাধিক পরিবারের অভিজ্ঞতা সেটা ইতিমধ্যেই দেখিয়েছে। বৃহস্পতিবারের পরে ছবিটা কিছুটা বদলাবে বলে আশা করছেন সব পক্ষই।
ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের তিনটি স্তর থাকে। জেলা, রাজ্য এবং জাতীয় আদালত। নিয়ম অনুযায়ী ২০ লক্ষ টাকার কম অঙ্কের ক্ষতিপূরণের জন্য জেলা আদালত, ২০ লক্ষ থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণের জন্য রাজ্য আদালত এবং তার উপরে জাতীয় আদালত। জাতীয় আদালতের রায়ে যদি কেউ সন্তুষ্ট না হন, তা হলে তিনি সুপ্রিম কোর্টে যেতে পারেন।
রাজ্য ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের আইনজীবী প্রবীর বসু বলেন, “আইন অনুযায়ী তিন মাসের মধ্যে মূল মামলার সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তিন মাস তো পরের কথা, পাঁচ-সাত বছর ঘুরে যায়। বহু ক্ষেত্রে আবার তড়িঘড়ি রায় দিতে গিয়ে ঠিক ভাবে সাক্ষী-সাবুদ নেওয়া হয় না। ফলে রায়ে সন্তুষ্ট না হয়ে ক্রেতারা আপিল করতে বাধ্য হন।” আইনজীবীদের একটা বড় অংশের অভিযোগ, নিম্ন আদালতগুলির রায়ে এত ফাঁকফোঁকর থাকছে যে জাতীয় আদালতে আপিলের পাহাড় জমছে।
কিন্তু ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের নির্দেশ কোনও চিকিৎসক বা হাসপাতাল যদি না মানেন, তা হলে? বিচারপতিরা জানিয়েছেন, এ ক্ষেত্রে জাতীয় ক্রেতা সুরক্ষা আইনের ২৫ ও ২৭ ধারায় আদালতের নির্দেশ না মানার জন্য নতুন করে মামলা করা যায়। অভিযোগ প্রমাণ হলে জেল কিংবা জরিমানা অথবা দুই-ই হতে পারে। এ রাজ্যে এমন নজিরের কথা অবশ্য কেউই মনে করতে পারেননি। |