অনুরাধা সাহা মামলায় রায় ঘোষণার সময়ে সুপ্রিম কোর্ট মন্তব্য করেছিল, রোগীরা সম্মান নিয়ে সুস্থ ভাবে বাঁচার জন্য প্রচুর টাকা খরচ করেন। তার পরেও চিকিৎসায় গাফিলতি হলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও হাসপাতাল-নার্সিংহোমের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কিন্তু ওই মামলায় ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে ‘কড়া ব্যবস্থা’র বিষয়টি শীর্ষ আদালত নিজেই এড়িয়ে গেল কি না, এ বার সে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। তা তুলছেন বিচারবিভাগের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাই।
এর কারণ, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে শুধু অনুরাধার চিকিৎসা-ব্যয় এবং আদালতের খরচ-খরচার কথাই উল্লেখ করা হয়েছে, ১৪ বছরের সুদ জুড়ে যার অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১১ কোটি টাকা। পাবেন অনুরাধার স্বামী কুণাল সাহা, স্ত্রীর মৃত্যুতে গাফিলতির অভিযোগ এনে যিনি মামলা করেছিলেন। এবং গাফিলতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত তিন চিকিৎসক (সুকুমার মুখোপাধ্যায়, বৈদ্যনাথ হালদার, বলরাম প্রসাদ) ও সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের (আমরি) তরফে কুণালবাবুকে তা মিটিয়ে দিতে হবে। তবে এটা শুধুই খরচ পোষানো। বিদেশে এমন ঘটনায় শাস্তি হিসেবে দায়ী পক্ষের মোটা জরিমানাও হয়। কিন্তু অনুরাধার মৃত্যুর ক্ষেত্রে তা হয়নি।
পাশাপাশি এই মামলায় দু’বছর আগে জাতীয় ক্রেতা-আদালত তিন চিকিৎসকের থেকে যে ক্ষতিপূরণ আদায় করেছিল, বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট তার বহরও কমিয়ে দেওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে। কুণালবাবু এ বার যে টাকাটা পাবেন, কার্যত একা আমরি-কর্তৃপক্ষকেই তার পুরোটা গুনতে হবে। বিচারমহলের একাংশের বক্তব্য, “অনুরাধার মৃত্যুতে তিন চিকিৎসকের ভূমিকা কী ছিল, রায়ে তা পরিষ্কার করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। তবু তাঁদের প্রদেয় অর্থের পরিমাণ কমানো হল কেন?” ওঁদের আরও প্রশ্ন, “দোষী হাসপাতাল ও ডাক্তারদের দায় তো সমান! তা হলে চিকিৎসকেরা ছাড় পাবেন কেন?” |
কুণালবাবু তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু ঘটানোর জন্য বিভিন্ন খাতে মোট ৯৭ কোটি ৫৬ লক্ষ ৭ হাজার টাকা দাবি করেছিলেন। সুপ্রিম কোর্টে তাঁর পেশ করা আবেদন মোতাবেক, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে তিনি চেয়েছিলেন ১৮ কোটি। সুপ্রিম কোর্টের ক্ষতিপূরণ-নির্দেশে তা মানা হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের এক প্রাক্তন বিচারপতির কথায়, “বিদেশে নাগরিক অধিকার জিনিসটা বেশ কড়া। সামাজিক-সুরক্ষাও বেশি। তাই ওখানে গাফিলতিতে মৃত্যু ঘটানোর জন্য বিশাল জরিমানা আদায়ের নজির রয়েছে। ডাক্তারেরা তা ভাল জানেন। তাই তাঁরা অনেক বেশি সতর্ক থাকেন।” কলকাতা হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, “ভারতের আর্থ-সামাজিক অবস্থা উন্নত দেশের মতো নয়। তাই এখানে এমন মামলায় ক্ষতিপূরণের অঙ্ক কম।”
কিন্তু ক্ষতিপূরণের আর্থিক দায়ভার চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে হাল্কা কেন?
অনুরাধা মামলায় অভিযুক্ত এক ডাক্তারের তরফে একদা লড়েছিলেন, এমন এক আইনজীবীর দাবি, “গাফিলতির অভিযোগ উঠলে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল-নার্সিংহোম ও চিকিৎসকদের সমান দায়ী হওয়ার কথা। দু’পক্ষের দেয় ক্ষতিপূরণও সমান হওয়া উচিত।” প্রাক্তন বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়েরও আশঙ্কা, “শুধু বেসরকারি হাসপাতালের ঘাড়ে ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপতে থাকলে হয় তারা ব্যবসা বন্ধ করে দেবে, কিংবা ঝুঁকি এড়াতে এত বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাবে যে, সাধারণ লোক ফতুর হয়ে যাবে।”
অনুরাধার ঘটনায় তিন ডাক্তারের দায়বদ্ধতা কী, বৃহস্পতিবার কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট তা পরিষ্কার করে দিয়েছে। শীর্ষ আদালত স্পষ্ট বলেছে, ‘সুকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতো প্রথিতযশা চিকিৎসক যে ভাবে নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়েছেন, তা কল্পনার অতীত। রোগীকে গুরুত্ব না-দিয়ে তিনি নিজের পেশার প্রতি অশ্রদ্ধা দেখিয়েছেন। বৈদ্যনাথ হালদার নিজের গাফিলতি অন্যের উপরে চাপিয়েছেন, তিনিও পেশাকে অসম্মান করেছেন। আর স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বলরাম প্রসাদ নিজে মেডিক্যাল প্র্যাকটিশনার। সিনিয়রদের নির্দেশ মতো চলেছেন বলে তিনি দায় এড়াতে পারেন না।’
অথচ এত কড়া মন্তব্য করেও সুকুমারবাবুর প্রদেয় ক্ষতিপূরণের অঙ্ক ৪০ লক্ষ থেকে কমিয়ে ১০ লক্ষ টাকা কেন করা হল, অনেকের তা মাথায় ঢুকছে না। বৈদ্যনাথবাবু-বলরামবাবুরও ক্ষেত্রেও টাকার অঙ্ক কমেছে। “মেডিকো-লিগ্যাল কেসে এত দিন দেখেছি, গাফিলতির মূল দায় ডাক্তারের। এখন উল্টো দেখলাম!” মন্তব্য রাজ্য ক্রেতা-সুরক্ষা পর্ষদের সদস্য প্রবীর বসুর। অন্য দিকে রাজ্য ক্রেতা-সুরক্ষা আদালতের এক কর্তার অভিমত, গাফিলতির ক্ষতিপূরণের দায় হাসপাতালের উপরে চাপানো ভাল। তাঁর যুক্তি, “অধিকাংশ হাসপাতাল ভিজিটিং ডাক্তারের গাফিলতির দায় নিতে চায় না। দায় চাপলে তারা রোগীর বেশি খেয়াল রাখবে। ডাক্তারদেরও বাধ্য হয়ে সজাগ থাকতে হবে।” চিকিৎসক সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (আইএমএ)-এর রাজ্য সম্পাদক শান্তনু সেনের দাবি, “ওষুধ দেওয়া বা রোগ নির্ণয়ে ভুল হলে ডাক্তার কাঠগড়ায় দাঁড়াবেন। কিন্তু তাঁর নির্দেশমতো চিকিৎসা না-হলে, ওষুধ-ইঞ্জেকশন-স্যালাইন-অক্সিজেন দিতে দেরি হলে, যন্ত্রপাতি চালাতে ভুল হলে দায়ী থাকবে হাসপাতাল। দেখতে হবে, কুণালবাবুর মূল অভিযোগ কার বিরুদ্ধে।” কুণালবাবু কী বলেন?
শুক্রবার মার্কিন মুলুক থেকে কুণাল সাহা ফোনে জানান, “সুপ্রিম কোর্টে সওয়ালে আমি বলেছি, হাসপাতাল ওই চিকিৎসকদের নিযুক্ত করেছে, তাদের ডাকেই ওঁরা এসেছেন, হাসপাতালই ওঁদের পরিকাঠামো দিয়েছে। তাই আশি ভাগ টাকা হাসপাতালেরই দেওয়া উচিত। সুকুমারবাবু দিন ১৫%। বাকি দুই চিকিৎসক মিলে বাকি ৫%। সুপ্রিম কোর্ট পুরোটাই হাসপাতালের উপরে চাপিয়ে দিল!”
এ অবস্থায় হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের এখন ওই চিকিৎসকদের থেকে ক্ষতিপূরণের অর্থ আদায় করা করা উচিত বলে মনে করছেন কুণালবাবু। উপরন্তু শাস্তিমূলক জরিমানার ব্যাপারটা সুপ্রিম কোর্ট কেন এড়িয়ে গেল, সেটাও তিনি বুঝতে পারছেন না। “দায়বদ্ধতার অভাবের কথা রায়ে বললেও সুপ্রিম কোর্ট ওদের শুধু সতর্ক করে ছেড়ে দিয়েছে। জরিমানা করেনি। করলে ডাক্তারেরা ও হাসপাতালগুলো আরও হুঁশিয়ার হতো।” মন্তব্য কুণালবাবুর। তাঁর দাবি, ইউরোপ-আমেরিকা হলে এমন ঘটনায় জরিমানা-ক্ষতিপূরণ মিলিয়ে মোট অঙ্কটা ৬০-৭০ কোটিতে দাঁড়াত।
তবে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে কুণালবাবু মোটের উপর খুশি।
তিনি বলছেন, “জাতীয় ক্রেতা-সুরক্ষা আদালত আমাকেও অভিযুক্ত করেছিল, অনুরাধার চিকিৎসায় নাক গলানোর দায়ে। তাই মোট ক্ষতিপূরণের ১০% কেটে নিয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট আমাকে মুক্তি দিয়েছে। আর অনুরাধা যে মৃত্যুযন্ত্রণা পেয়েছে, তার ক্ষতিপূরণ ধার্য করেছে ১০ লক্ষ টাকা! ভারতে এই প্রথম।”
গাফিলতি-মৃত্যুর ক্ষেত্রে এটা নতুন দিকনির্দেশ বলে মনে করছেন কুণাল। “এ-ই তো সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।” প্রবাস থেকে ভেসে আসে অনুরাধা সাহার স্বামীর কণ্ঠস্বর। |