নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
চিকিৎসার গাফিলতিতে এক রোগিণীর মৃত্যু ঘটানোর দায়ে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতাল ও তিন চিকিৎসককে ছ’কোটিরও বেশি (৬ কোটি ৮ লক্ষ ৫৫০) টাকা ক্ষতিপূরণ গুণতে হবে। বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট এই মর্মে নির্দেশ দিয়েছে। এ দেশে চিকিৎসায় গাফিলতির জন্য এত বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণের নজির নেই।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এস জে মুখোপাধ্যায় এবং বিচারপতি ভি গোপাল গৌড়ার বেঞ্চ এ দিন এই রায় দিয়ে জানিয়েছে, নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ-অঙ্কের উপরে বার্ষিক ৬% হারে ১৪ বছরের সুদও জুড়বে, যা পাবেন আবেদনকারী প্রবাসী চিকিৎসক কুণাল সাহা। ১৯৯৮-এ স্ত্রী অনুরাধার মৃত্যুর পরে চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ এনে মামলা করেছিলেন কুণালবাবু। এই নির্দেশের ফলে তাঁর সব মিলিয়ে মোট ১১ কোটি টাকা পাওয়ার কথা। আট সপ্তাহের মধ্যে তা মিটিয়ে দিতে বলেছে সুপ্রিম কোর্ট। |
আমেরিকার বাসিন্দা কুণালবাবু ১৯৯৮-এ এক আত্মীয়ের বিয়ে উপলক্ষে সস্ত্রীক কলকাতায় এসেছিলেন। অনুরাধা আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায়ের কাছে তাঁর চিকিৎসা হয়। শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ায় অনুরাধাকে প্রথমে ঢাকুরিয়ার আমরি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। অবস্থার আরও অবনতি হওয়ায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় মুম্বইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে। সেখানেই ধরা পড়ে অনুরাধার আসলে একটি বিরল ধরনের চর্মরোগ হয়েছে। যার নাম ‘টক্সিক এপিডার্মাল নেক্রোলাইসিস’। ডাক্তাররা সংক্ষেপে বলেন ‘টেন’। কুণালবাবুর দাবি, “কলকাতার চিকিৎসকরা ভুলবশত ডেপোমেড্রল ইঞ্জেনকশন দেওয়ায় এই রোগ আরও মারাত্মক আকার নেয়।” এবং শেষ পর্যন্ত ২৮ মে, ১৯৯৮ ব্রিচ ক্যান্ডিতেই মৃত্যু হয় মধ্য ত্রিশের অনুরাধার, যিনি নিজেও ছিলেন চিকিৎসক, পেশায় শিশু মনোবিদ।
স্ত্রীর চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ এনে কলকাতার পাঁচ চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায়, বৈদ্যনাথ হালদার, বলরাম প্রসাদ, অবনী রায়চৌধুরী ও কৌশিক নন্দী এবং আমরি-কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে পুলিশ ও ক্রেতা-সুরক্ষা আদালতে মামলা করেন কুণালবাবু। মামলা গড়ায় সুপ্রিম কোর্টে। এ দিন শীর্ষ আদালত তারই চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে দিল। মামলা চলাকালীন অবনীবাবু মারা গিয়েছেন। আর কৌশিকবাবুকে সুপ্রিম কোর্ট আগেই নির্দোষ ঘোষণা করেছে।
আইনজীবী ও ভুক্তভোগীরা মনে করছেন, চিকিৎসা-সহ বিভিন্ন পরিষেবায় যাঁরা গাফিলতির শিকার, সুপ্রিম কোর্টের এই রায় তাঁদের সামনে সুবিচার লাভের রাস্তা খুলে দিল। আইনজীবী মহলের একাংশের মতে, অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবশালীরা ক্রেতা-আদালতের সুপারিশ এড়িয়ে যান। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতের এ হেন রায়ের জোরে প্রতারিত উপভোক্তারা আইনি লড়াইয়ের সুযোগ পাবেন। উল্লেখ্য, ভারতে এ যাবৎ চিকিৎসায় গাফিলতির সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণ ছিল ১ কোটি টাকা। ২০০৯-এ প্রশান্ত ধানাঙ্কা নামে এক রোগীর মামলায় সুপ্রিম কোর্টই নির্দেশটি দিয়েছিল। বুকের টিউমার আপারেশনের সময়ে কোমরের নীচ থেকে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন বেঙ্গালুরুর ওই তেইশ বছরের যুবক। |
নিজের মামলায় আমেরিকা থেকে এসে সুপ্রিম কোর্টে নিজেই সওয়াল করেছিলেন কুণালবাবু। এ দিন রায় ঘোষণার সময়ে তিনি ছিলেন ওয়াইহোতে। সেখান থেকে বলেন, “উত্তেজনায় সারা রাত ঘুমোতে পারিনি। কেন যেন মনে হচ্ছিল, অনুরাধা এ বার সুবিচার পাবে। সেটাই হল। ইতিহাস তৈরি হয়ে গেল!” এক যুগ ধরে মামলা চালিয়ে যাওয়া ক্যানসার-গবেষক কুণালবাবুর কথায়, “কাজ ফেলে বারবার দেশে যেতে হয়েছে। কলকাতা, দিল্লি ছোটাছুটি করতে হয়েছে। প্রশাসনের কারও সাহায্য পাইনি। বরং অসহযোগিতাই পেয়েছি। তবু হার মানিনি। জলের মতো টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু ভারতীয় আইনের উপরে, সর্বোচ্চ আদালতের উপরে ভরসা রেখেছি।”
এবং তাঁর এই জয় দেশের হাজার হাজার বাবা-মা-ভাই-বোন-পুত্র-কন্যা-স্বামীকে গাফিলতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শক্তি জোগাবে বলে মনে করছেন কুণালবাবু। তাঁর আশা, চিকিৎসকেরাও এ বার থেকে অনেক বেশি সচেতন হবেন। কেন?
প্রবাসী চিকিৎসকের ব্যাখ্যা, “মাত্র এক-দু’লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে ক্রেতা-সুরক্ষা আদালতে পার পেয়ে যাওয়া যায় বলে বহু ডাক্তার বা হাসপাতাল গাফিলতিকে গুরুত্ব দেন না। ক্ষতিপূরণের অঙ্ক এত বেশি হলে ওঁদের পকেটে সত্যিই টান পড়বে। গাফিলতি করার আগে তাই দু’বার ভাববেন।” অনুরাধা-মামলায় জড়িত চিকিৎসকেরা কী বলছেন?
রায় শুনে স্বভাবতই ওঁরা খুশি নন। সুকুমারবাবুর প্রতিক্রিয়া, “ডাক্তারদের নামে নালিশ করাটা প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বার চিকিৎসকেরা কিছুটা রক্ষণশীল হয়ে পড়বেন। অকারণে গাদা গাদা টেস্ট করাতে দেবেন। কেউ ঝুঁকি নেবেন না।” আর ডাক্তারেরা আদৌ কেন ক্রেতা-সুরক্ষার আওতায় আসবেন, বলরামবাবু তুলেছেন সেই প্রশ্ন। “চিকিৎসা ব্যাপারটা তো আলু-পটল বেচা নয়! এখন থেকে আমরা প্রথাগত চিকিৎসায় ফিরে যেতে বাধ্য হব। ছোটখাটো সমস্যাতেও টেস্ট করাতে বলব। রোগীদেরই অসুবিধে হবে।” মন্তব্য তাঁর। তিনি এ-ও বলেন, “রোগীদের বোঝা উচিত, কোনও ডাক্তার ইচ্ছে করে ভুল চিকিৎসা করেন না বা রোগীকে মারতে চান না।” |
চিকিৎসক
বৈদ্যনাথ হালদার |
চিকিৎসক
সুকুমার মুখোপাধ্যায় |
|
অন্য দিক দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অবশ্য কিছুটা হলেও স্বস্তি দিয়েছে তিন চিকিৎসককে। কী ভাবে?
২০১১-য় জাতীয় ক্রেতা-সুরক্ষা আদালত অনুরাধা-মামলায় মোট ১ কোটি ৩৪ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ধার্য করেছিল। যার মধ্যে তিন চিকিৎসকের ভাগে পড়েছিল মোট ৯০ লক্ষ। সুকুমারবাবুকে দিতে বলা হয়েছিল ৪০ লক্ষ, বৈদ্যনাথবাবুকে ২৫ লক্ষ ও বলরামবাবুকে ২৫ লক্ষ। তিন জন তা মিটিয়ে দেন, পাশাপাশি ক্ষতিপূরণের অঙ্ক কমানোর আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টে। এ দিন সুপ্রিম কোর্ট ওঁদের আর্জি মেনে নিয়েছে। কুণালবাবুর কৌঁসুলি টি ভি জর্জ জানিয়েছেন, সুকুমারবাবুর প্রদেয় অঙ্ক কমে হয়েছে ১০ লক্ষ। বলরামবাবুর ক্ষেত্রে হয়েছে ৫ লক্ষ, বৈদ্যনাথবাবুর ১০ লক্ষ।
অর্থাৎ সুকুমারবাবুরা এ বার টাকা ফেরত পাবেন। আবার বাড়তি আর্থিক দায় চাপবে আমরি হাসপাতালের উপরে। তাদের প্রতিক্রিয়া কী?
এ দিন প্রশ্ন করা হলে আমরি-র এক মুখপাত্র বলেন, “রায় সম্পর্কে শুনেছি। কাগজপত্র এখনও হাতে পাইনি। নথিপত্র না-দেখে মন্তব্য করা হবে না। তবে আদালত কোনও নির্দেশ দিলে তা তো মানতেই হবে।” |
কী বলল সুপ্রিম কোর্ট |
• কুণাল সাহা পাবেন ৬ কোটি ৮ লক্ষ ৫৫০ টাকা
• সঙ্গে ৬% হারে ১৪ বছরের সুদ
• চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায় ও বৈদ্যনাথ হালদার দেবেন ১০ লক্ষ করে
• চিকিৎসক বলরাম প্রসাদ দেবেন ৫ লক্ষ টাকা
• ক্রেতা-আদালতের নির্দেশে ইতিমধ্যে অনেক বেশি দিয়েছেন তিন জন
• আমরি-র কাছ থেকে তাঁরা বাড়তি দেওয়া টাকা ফেরত পাবেন
• পাওনাগন্ডা মেটাতে আমরি সময় পাবে আট সপ্তাহ |
|
সুপারিশ |
• বেসরকারি হাসপাতাল-নার্সিংহোম নিয়ন্ত্রণে কড়া আইন
• মেডিক্যাল কাউন্সিলের উপরে কঠোর নজরদারি
• দুরারোগ্য ব্যাধির নয়া চিকিৎসা-পদ্ধতি নিয়ে সচেতনতা
• চিকিৎসক ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি |
|