নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
বিদেশে আকছার হয়। কিন্তু এ দেশেও যে এমনটা হতে পারে, তার নজির তৈরি করল সুপ্রিম কোর্ট। চিকিৎসায় গাফিলতির জেরে মৃত্যুতে দেশের সর্বোচ্চ আদালত এমন মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করায় ‘ধর্মযুদ্ধে জয়’ হল বলে মনে করছেন অনেকেই। চিকিৎসায় কোনও না কোনও গাফিলতির কারণে যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন, তাঁদের অনেকেরই ধারণা, সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের পরে গাফিলতির অভিযোগ আরও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হবে। শুধু চিকিৎসায় গাফিলতিতেই নয়, ইদানীং ক্রেতারা যে ভাবে নানা ক্ষেত্রে প্রতারিত হচ্ছেন, সেই সংক্রান্ত মামলাগুলিতেও সুপ্রিম কোর্টের এ দিনের নির্দেশ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে মনে করেন ক্রেতা সুরক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা।
এই রায়ে সাধারণ মানুষ আদালত ও ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের মতো সংস্থাগুলির উপর আরও বেশি করে ভরসা করতে পারবেন বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি এবং বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অশোককুমার গঙ্গোপাধ্যায়। রায় জানার পর তিনি বলেন, “এই রায়ে শুধু চিকিৎসকই নয়, সব পেশার মানুষ, বিশেষ করে সেবা ও মানবাধিকার রক্ষা সংক্রান্ত কাজ করেন যাঁরা, তাঁরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে আরও বেশি সতর্ক হবেন।”
চিকিৎসক-সহ হাসপাতাল এবং নার্সিংহোমগুলিকে এই রায়ের ফলে পরোক্ষ ভাবে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে বলে জানাচ্ছেন রাজ্য ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের রেজিস্ট্রার দেবপ্রসাদ জানা। তা ছাড়া, অন্য যে সব মামলায় ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছেন, তাঁদের স্বার্থও সুরক্ষিত হবে বলে মনে করেন তিনি। দেবপ্রসাদবাবু বলেন, “বহু ক্ষেত্রেই চিকিৎসক এবং হাসপাতালগুলির গাফিলতি থাকলেও সাধারণ মানুষ কোনও রকম বিচার পান না। এই রায় রোগী এবং তাঁর পরিবারের জন্য সুফল আনবে।
একই ভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যাঁরা প্রতারিত হচ্ছেন, তাঁরাও ভবিষ্যতে সুবিচার পাবেন।”
এই রায়কে ‘যুগান্তকারী’ বলে মনে করছেন আইনজীবীরাও। আইনজীবী তপেন রায়চৌধুরীর কথায়, “আমাদের দেশে এর আগে কোনও এক জন ব্যক্তি এই বিপুল পরিমাণ টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে পাননি। দেশের চিকিৎসা-আইনে এটা একটি দৃষ্টান্ত। আশা করছি, ভবিষ্যতে এই ধরনের অন্য মামলাতেও এই রায়কে আইনজীবীরা নজির হিসেবে উল্লেখ করবেন। শুধু চিকিৎসায় গাফিলতি নয়, যে সব ক্ষেত্রে ক্রেতারা ঠকে গিয়েছেন বলে মনে করছেন, সেই সব ক্ষেত্রেও এই রায় উল্লেখ করা চলবে।”
রোগীদের স্বার্থে কাজ করে এমন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তরফে দেবপ্রিয় মল্লিক বলেন, “সুবিচার না পেয়ে পেয়ে যাঁরা সব ভরসা হারিয়ে ফেলেছিলেন, এ বার তাঁদের ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এল। রোগীদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে যে পার পাওয়া যায় না, ডাক্তারদের একাংশ এ বার তা বুঝতে বাধ্য হবেন। ক্ষতিপূরণের বিপুল অঙ্ক তাঁদের মনে এ বার আতঙ্ক তৈরি করবে।” এক বেসরকারি হাসপাতালে নিজের মেয়ের মৃত্যুর পরে চিকিৎসায় গাফিলতির বিরুদ্ধে লড়তে ওই সংগঠন চালু করেছেন দেবপ্রিয়বাবু।
এমনই আর একটি সংগঠনের সহ-সভাপতি মিহির বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এই রায় একটা মাইল ফলক। ডাক্তাররা এ বার সতর্ক হয়ে চিকিৎসা করতে বাধ্য হবেন।” ২০০১ সালে নিজের ১২ বছরের মেয়েকে হারিয়েছেন মিহিরবাবু। পেটের সমস্যা থেকে বমি হচ্ছিল মেয়ের। সঙ্গে পেট খারাপও। কোন্নগরের একটি নার্সিংহোমে ভর্তি করার ১০ ঘণ্টার মধ্যেই মেয়ে মারা যায়। মিহিরবাবুর অভিযোগ, “ক্যানসারের কেমোথেরাপির পরে বমি বন্ধ করতে যে ওষুধ দেওয়া হয়, আমার মেয়েকেও সেটাই দেওয়া হয়েছিল। ওটা ওর শরীরে সহ্য হয়নি। মেডিক্যাল কাউন্সিলের দ্বারস্থ হয়েছিলাম। কিন্তু সুবিচার পাইনি। এখন মনে হচ্ছে, হাল ছাড়লে চলবে না।”
রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে চিকিৎসায় গাফিলতির শিকার বহু মানুষেরও একই অভিমত। হাওড়ার এক নার্সিংহোমে মানসিক প্রতিবন্ধী বোনকে ভর্তি করেছিলেন শিখা পোদ্দার। পায়ের একটি অস্ত্রোপচার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু অপারেশন থিয়েটারেই তার মৃত্যু হয়। চিকিৎসার গাফিলতিতেই ওই মৃত্যু বলে অভিযোগ করে ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন শিখাদেবী। আদালত ওই মামলায় অভিযুক্ত চিকিৎসককে এক লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু নির্দেশই সার, মাসের পর মাস কেটে গেলেও সেই টাকা আদায় হয়নি। এ দিন শিখাদেবী বলেন, “টাকাটা বড় কথা নয়। কিন্তু মানুষের জীবনের দাম মাত্র এক লক্ষ টাকা! তাও কী অবলীলায় ডাক্তাররা তা অবজ্ঞা করতে পারেন দেখে সমস্ত আশা-ভরসা নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। সুপ্রিম কোর্ট আবার নতুন ভরসা দিল। লড়াইটা ছাড়ব না।” ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের এমন অনেক নির্দেশই অনেক ক্ষেত্রে কার্যকর হয় না। এ দিনের নির্দেশের পরে সর্বোচ্চ আদালতও যে এমন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে, তার নজির তৈরি হল। যার ফলে ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের নির্দেশও এ বার গুরুত্ব পাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
চিকিৎসক সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (আইএমএ) অবশ্য এই রায়ের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে খানিকটা সতর্ক। সংগঠনের রাজ্য শাখার সম্পাদক শান্তনু সেন বলেন, “চিকিৎসা পরিষেবাকে আর পাঁচটা পণ্যের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা কতটা যুক্তিযুক্ত, সে বিষয়ে আমাদের সংশয় রয়েছে। সব পেশাতেই কিছু খারাপ মানুষ থাকেন। চিকিৎসাক্ষেত্রেও হয়তো রয়েছেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কিছু রোগী বা তাঁদের পরিবার ডাক্তারের কাছ থেকে টাকা আদায়ের জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এই প্রবণতাও ক্ষতিকর।” অভিযুক্ত দুই চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায় ও বলরাম প্রসাদ মনে করেন, সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের ফলে চিকিৎসকেরা আরও বেশি রক্ষণাত্মক হয়ে পড়বেন। তাঁরা অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষার সুপারিশ করবেন বেশি করে। যার চাপ শেষমেশ গিয়ে পড়বে রোগী ও তাঁর আত্মীয়দের উপরেই।
দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর জয়ী প্রবাসী চিকিৎসক কুণাল সাহা অবশ্য ভুক্তভোগী রোগী ও তাঁদের পরিবারকে হাল না-ছাড়ার পরামর্শই দিয়েছেন। তাঁর নিজের উদাহরণ দিয়ে জানিয়েছেন, ১৯৯৯ সালে জাতীয় ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে মামলা করার পর ২০০৬ সালে আদালত অভিযুক্তদের মুক্ত করে দেয়। ২০০৭-এ তিনি সুপ্রিম কোর্টে যান। দু’বছর মামলা চলার পর ২০০৯ সালে সুপ্রিম কোর্ট অভিযুক্তদের দোষী চিহ্নিত করে মামলা আবার ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে পাঠায়। কিন্তু সেখানে যে ক্ষতিপূরণ ঠিক করা হয়েছিল, তা মনঃপূত না-হওয়ায় কুণালবাবু আবার ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন। তারই ভিত্তিতে এ দিনের রায়। কুণাল সাহার কথায়, “লড়াইয়ের মনটাকে জিইয়ে রাখতে হবে।”
অভিযুক্ত চিকিৎসকদের ক্ষতিপূরণের পরিমাণ সুপ্রিম কোর্ট কমিয়ে দেওয়ায় তাঁর এই আন্দোলন কি কিছুটা বাধাপ্রাপ্ত হবে না? কুণালবাবুর মন্তব্য, “আমি তো ৭৭ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত কোর্ট যে টাকা ধার্য করেছে, সেটাও কম নয়। ৫ কোটি ৯৬ লক্ষ টাকা ছাড়াও ১৪ বছরের সুদ মিলিয়ে প্রায় ১১ কোটি টাকা আমরির দেওয়ার কথা। আমার টাকার প্রয়োজন নেই। মামলা করতে এত টাকা খরচও হয়নি। চিকিৎসকমহলকে গাফিলতির বিরুদ্ধে সজাগ করতে এবং একটা নজির তৈরি করতেই আমি বেশি টাকা চেয়েছিলাম। সেই উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে।” |