নাটক সমালোচনা...
মধ্যরাতের মহাকাব্য
খন মহানগরীর মধ্যরাত শাসন করে এক মহাকাব্য!
রাত বাড়ে...বেড়ে চলে...আর স্নায়ুতন্ত্র ততই সজাগ হয়ে উঠতে থাকে বাংলা রঙ্গমঞ্চের। এই অভিজ্ঞতা কি আগে কখনও হয়েছে এ মহানগরীর? রাতচরা পাখির মতো কলকাতা ভিড় করে এসেছে...চেয়ে থেকেছে রাতভর, শুধু একটিমাত্র নাটকের জন্য? দীর্ঘ ছ’ঘণ্টা ধরে যে আখ্যান রচিত হয় প্রেক্ষাগৃহে এবং অবশ্যই প্রেক্ষাগৃহের বাইরে, তার জন্য এই হাপিত্যেশ প্রত্যক্ষ করাটাও একটা অভিজ্ঞতা বইকী! ‘কসবা অর্ঘ্য’ প্রযোজিত ‘ঊরুভঙ্গম’ আসলে এক পরিক্রমা, মহাভারতের আশ্রয়ে জীবনের পাকদণ্ডী বেয়ে চলা। কিন্তু ছ’ঘণ্টাতেও কি মহাভারতের সুবিশাল আখ্যান বর্ণনা করা সম্ভব? অর্ঘ্য অবশ্য সেই চেষ্টা করেনি। বরং, ভারতীয় নাটকের চিরকালীন আবেদনকে অক্ষুণ্ণ রেখে মঞ্চে যে কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছে তা আমাদের চমৎকৃত করে।
কেরলে সংস্কৃত নাটকের প্রাচীন আধার কুটিয়াট্টম, কথাকলি, কেরলের মার্শাল আর্ট কালারিপায়াট্টু, কর্নাটকি থিয়েটারের ফর্ম ইয়াকসাগানা, তামিলনাড়ুর লোকনাট্য থেরুকুথু, ছত্তীসগঢ়ের পাণ্ডবানী, এই বাংলার ছো এবং ঝুমুর সব কিছুর এমন সুনিপুণ মিশেল এত ক্ষণ ধরে প্রত্যক্ষ করাটাও এক মধুর অভিজ্ঞতা। তার সঙ্গে ভারতীয় ট্র্যাডিশনাল সঙ্গীতের অনবদ্য সঙ্গত। কণ্ঠের সঙ্গেই ব্যবহৃত হয়েছে সরোদ, তানপুরা, পাখোয়াজ, চেন্ডা, ধামসা, বাঁশি, তুংধা, এমনকী তিব্বতি গংস এবং ডাফলিও।
অভিজিৎ চক্রবর্তীর সঙ্গীত পরিচালনা এই নাট্যের সম্পদ। নাটকের ভাষা তিনটি বাংলা, সংস্কৃত ও ইংরেজি। অর্ঘ্য-র নিজস্ব কলাকুশলীরা ছাড়াও শিল্পীরা এসেছেন কেরল, ছত্তীসগঢ়, উত্তরপ্রদেশ এবং অসম থেকে। যেমন, কুটিয়াট্টমের প্রথিতযশা শিল্পী সুরজ নাম্বিয়ার এই নাটকে অভিনয় করতে আসেন কেরল থেকে, নৌটঙ্কি শিল্পী পুনীত মিশ্র উত্তরপ্রদেশ থেকে, অসম থেকে কল্পনা বড়ুয়া, ঊষা বার্গলে পাণ্ডবানী করতে আসেন ছত্তীসগঢ় থেকে। তাঁদের সঙ্গেই আছেন ভরতনাট্যম শিল্পী অম্বালী প্রহরাজ।
গোটা মঞ্চ জুড়ে রাজত্বের বিস্তার করতে থাকেন রণিত মোদক। রণিত কিন্তু নির্দিষ্ট একটি চরিত্রে অভিনয় করেননি। তা হলে? পরাশর, সত্যবতী, দুষ্ম্যন্ত, শকুন্তলা, ব্যাস, গণেশ, বিচিত্রবীর্য, শান্তনু, অম্বা, অম্বালিকা, শকুনি মুহূর্তে মুহূর্তে বদলে যেতে থাকে চরিত্র আর রণিতও লহমায় প্রবেশ ও প্রস্থান করতে থাকেন এক চরিত্র থেকে আর এক চরিত্রে। প্রতিটি চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গেই বদলাতে থাকে রণিতের শরীরী ভাষা ও কণ্ঠস্বর। মঞ্চ জুড়ে অনবদ্য উপস্থিতি রাজু বেরার। গণেশের ভূমিকায় ছাড়াও বিভিন্ন মুহূর্তের নানা ভাব ফুটিয়ে তুলতে এসে মঞ্চে প্রায় পাখির মতো উড়ে বেড়ান রাজু।
তাঁর ও রণিতের অস্ত্রশিক্ষার মুহূর্তগুলি অনবদ্য। মঞ্চে সীমা ঘোষের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। কথক ও গান্ধারীর ভূমিকায় অভিনয়ের পাশাপাশি প্রেক্ষাগৃহের বাইরে পাণ্ডবানী পরিবেশন করেন সীমা।
‘ঊরুভঙ্গম’ চলাকালীন চার-চারটি দীর্ঘ বিরতির সময়েও কিন্তু দর্শকদের জন্য বড় ধরনের চমক অপেক্ষা করে। নাটকের নির্দেশক মণীশ মিত্রের কথায়: “বিরতিগুলিও নাটকেরই অংশ। প্রেক্ষাগৃহের মধ্যেকার নাটক চলতে চলতে যেন বাইরে বেরিয়ে আসে। দর্শকও সঙ্গে সঙ্গে বাইরে আসেন, আবার ভিতরে যান।”
মণীশ জানান, দীর্ঘ তিন বছর ধরে ‘ঊরুভঙ্গম’-এর প্রস্তুতির সময় ভাস ছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসুর ‘প্রথম পার্থ’, রাজশেখর বসুর ‘মহাভারত’, কাশীদাসী মহাভারত, শাহযাদ ফিরদৌস-এর উপন্যাস ‘ব্যাস’, শিবাজি সাওন্তের মরাঠি উপন্যাস ‘মৃত্যুঞ্জয়’, ধর্মবীর ভারতীর ‘অন্ধযুগ’, তিজন বাঈ-এর ভাষ্য এবং অভীক ভট্টাচার্যের ‘আরোহলিপি’ থেকে প্রচুর ভাবনা নেওয়া হয়েছে।
আসলে, এখন মহানগরীকে জাগিয়ে রেখে মধ্যরাত শাসন করছে এক মহা-নাট্য!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.