সিনেমা সমালোচনা...
ডায়ালগবাজি নেই আছে সাহসী প্রশ্ন
মনটাই তো হয়।
২০০৭-এ এবিপি আনন্দ অফিসে হামলা হয়েছিল। গ্রেফতারও হয়েছিল দু’জন। ২০১৩-তে সেই মামলার আসামি শনাক্তকরণের জন্য যখন আদালতে ডাকা হল অভিযোগকারী হিসেবে, তখন স্মৃতি থেকে বিলকুল মুছে গেছে মুখগুলো অথচ তত দিনে বেশ কিছু দিন জেল খেটে ফেলেছে অভিযুক্তরা!
প্রচারনির্ভর যুগে পাবলিসিটির ঢক্কানিনাদ ছাড়া হনসল মেহতার নতুন ফিল্ম ‘শাহিদ’ এমনই অজস্র সৎ, বাস্তব আর সাহসী প্রশ্ন তোলে ব্যবস্থা আর রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ে। একই সঙ্গে বলতে থাকে, “ইফ ইউ ওয়ান্না চেঞ্জ দ্য সিস্টেম, বি আ পার্ট অব ইট।”
এই ফিল্ম আইনজীবী শাহিদ আজমির বায়োপিক, যাঁকে ২৬/১১ মুম্বই আক্রমণে অভিযুক্ত ফাহিম আনসারির হয়ে মামলা লড়ার সময়ে কুরলার কাছে তাঁর অফিসের মধ্যে ঢুকে গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়, মাত্র ৩২ বছর বয়েসে। ৭ বছর প্র্যাকটিস করে ১৭টা অ্যাকুইটাল করানোর বিরল-উজ্জ্বল ট্র্যাক রেকর্ড যাঁর, তাঁকেও জীবদ্দশায় আদালত-চত্বরেই তাঁর অতীত নিয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণের মুখোমুখি হতে হয়েছে বারবার। কোন অতীত? ষোলো বছর বয়সে কাশ্মীরে গিয়ে হাতে বন্দুক তুলে নেওয়ার অতীত, উগ্রপন্থীদের মতাদর্শের সঙ্গে মতভেদের অতীত, ক্যাম্প থেকে ফিরে আসার অতীত, টাডা আইনে ১৯৯৪ সালে গ্রেফতার হওয়ার অতীত আর পাঁচ বছর তিহাড় জেলে কাটানোর অতীত।
অতীত থেকে অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত শাহিদ দর্শকদের সামনে পরদায় বেড়ে ওঠে, বিন্দুমাত্র অতিনাটকীয়তা ছাড়া জীবনের গতিপথ পালটে ফেলা বাঁকগুলো নেয় এবং ‘তারিখ পে তারিখ’-এর মতো ডায়ালগবাজি ছাড়াই সিস্টেমের ফাঁকফোকরগুলোর দিকে আঙুল তোলে। সমস্ত অভিযুক্তকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ তকমা সেঁটে জিঘাংসায় চার টুকরো করে হাততালি কুড়নোর বলিউডে তাঁর এ ছবি তৈরি করে নতুন ইতিহাস। মুদ্রার উলটো পিঠে আলো ফেলার সাহসী ইতিহাস।
শাহিদ
রাজকুমার যাদব, প্রভলিন সাঁধু
গোটা ফিল্ম জুড়ে রয়েছে অদ্ভুত এক সাধারণত্ব। ‘সিনেমায় যেমন হয়’-এর মায়া-বাস্তব ছাড়িয়ে ‘যেটুকু না-হলে-নয়’-এর বাস্তবতাটাই এ ছবির বৈশিষ্ট্য। ডিজিটাল ডলবি-বাহিত রুদ্ধশ্বাস আবহসঙ্গীতের বদলে স্বাভাবিক নৈঃশব্দ্যও যে কত সিনেমাটিক হতে পারে, বুঝিয়ে দিলেন পরিচালক।
সেই স্বাভাবিকত্ব মুড়ে রেখেছে শাহিদের ভূমিকায় রাজকুমার যাদবের অভিনয়কেও। ‘কাই পো চে’-র সেই গোবিন্দ পটেল বিন্দুমাত্র মুখভঙ্গি বা ন্যূনতম শারীরিক অভিনয় না করে যে অনায়াসে ক্রোধ, ক্ষোভ, হতাশা আর বুকের ভেতরের যাবতীয় ঝড়ঝাপটাকে পরদায় ফুটিয়ে তুলেছেন, বলিউডে তার সাম্প্রতিক নমুনা একমাত্র ইরফান খান। শাহিদের স্ত্রী মারিয়মের ভূমিকায় প্রভলিন সাঁধুও সমানে পাল্লা দিয়েছেন যুগ্মদৃশ্যে। সরকারি আইনজীবীর ভূমিকায় শালিনী ভাটসা এতই যথাযথ যে ফিল্মে এ যাবৎ দেখা কোর্ট সিনগুলো আপনার অবাস্তব ও অতি নাটকীয় লাগতে বাধ্য।
অবশ্যই বলতে হবে কে কে মেননের কথা, যিনি স্রেফ কয়েক মিনিটের একটা ‘ক্যামিও’ রোল করে শুধু যে গোটা ছবিতে ছাপ ফেললেন তাই না, মনে পড়িয়ে দিলেন ‘শৌর্য’ ছবির সেই ব্রিগেডিয়ার রুদ্রপ্রতাপ সিংহকেও। কাশ্মীর উগ্রপন্থী ক্যাম্প ছেড়ে শাহিদের পালিয়ে আসার দৌড় দেখে আপনার টম হ্যাঙ্কসের ‘ফরেস্ট গাম্প’ মনে পড়তে পারে, তবে দ্রুত এ ফিল্মের ‘অরিজিনালিটি’ সব খুঁত ঢেকে দেয়। চিত্রনাট্যে অবহেলিত অংশগুলো, যেমন, কাশ্মীরের ক্যাম্পে শাহিদের ভূ্মিকার অস্পষ্টতা, টাডায় গ্রেফতার হয়েও খালাস পাওয়ার ব্যাখ্যার অভাব ততটা চোখে পড়ে না সেই মৌলিকত্বে। এমনকী, শাহিদের হত্যার পিছনে কারা জরুরি এ প্রশ্নও যে এড়িয়ে গেলেন পরিচালক তা কি ছবিটিকে নিছক রাজনীতির ছোঁয়ামুক্ত রেখে ঝামেলা এড়াতেই? আদালত চত্বরে শাহিদ আজমির ওপর আক্রমণ দৃশ্যটা মনে করিয়ে দিল ১৩ বছর আগের কথা। ২০০০ সালে ‘দিল পে মত লো ইয়ার’ ছবির নবীন পরিচালককে শিবসেনার হাতে হেনস্তা হওয়ার খবরটা যদি এই পেশাদার সাংবাদিক ভুলতে না পারে, স্বয়ং পরিচালক এই ছবির দৃশ্যায়নে তা ভোলেন কী করে?
যেমন ভুললে চলবে না সংবাদমাধ্যমের ভূমিকার আত্মবীক্ষণও। যে দেশে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই ‘মিডিয়া ট্রায়াল’-এ অভিযুক্তদের ফাঁসি চাওয়া হয়, সরকারের তৎপরতা ও সদিচ্ছা মাপা হয় ‘দ্রুত গ্রেফতার’-এর নিরিখে, সে দেশে আবেগের তাপে ঝলসে যে অর্ধ-সত্যও প্রতিষ্ঠিত হবে জনমানসে তাতে আর বিস্ময় কী? এক দিকে গ্রেফতারির সংখ্যা ‘ব্রেকিং নিউজ’-এ উঠে প্রশাসনিক দক্ষতার জয়ধ্বনি করে, অন্য দিকে আদালতে দীর্ঘ বিচারপর্ব শেষ হওয়ার ঢের আগে গ্রেফতারিতেই অভিযুক্তকে ‘দোষী’ সাব্যস্ত করে সমাজ।
ফাহিম আনসারি নামে মুম্বই হামলায় যে অভিযুক্তর পক্ষ নিয়ে বাস্তবে লড়েছিলেন শাহিদ, তাঁর হত্যার পর সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে বেকসুর খালাস করে দেয়। কাজেই সিস্টেমের ‘শাহিদ’ ফাহিমের পাশে স্রোতের উলটো পথে দাঁড়াতে চাওয়া শাহিদদের দূরবিন দিয়ে খুঁজতে হয়, আজও। সত্যভাষণ আর সত্যদর্শন সময়-সময়ে সমান অস্বস্তিকর। কখনও একটা পদবিও তো এই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দেশেও সব পালটে দেয়, একটা পদবিই ‘সন্ত্রাসবাদী’ তকমা সেঁটে দেয়। হাজতে শাহিদকে নগ্ন করে অত্যাচার চলছে, নাকি ‘গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ’ ব্যবস্থাটারই খোলস ছাড়ানো হচ্ছে এ ছবি দেখতে দেখতে গুলিয়ে যাবেই। শাহিদ যখন ভরা কোর্ট রুমে চিৎকার করে বলেন, তাঁর ক্লায়েন্টের নাম ‘জাহির’ না হয়ে ম্যাথু, ডোনাল্ড, সুরেশ বা মোরে হলে তাঁকে কিছুতেই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে হত না বিশ্বাস করুন বুক কেঁপে ওঠে।
হলের বাইরে এসে হাঁপ ছাড়ি।
ভাগ্যিস আমি সংখ্যাগুরুর দলে!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.