ভোলবদল লোধাপাড়ার।
রুটি রুজির টানে কয়েক দশক আগে পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে বেশ কয়েক ঘর লোধা সম্প্রদায় আসেন চাকদহের নাথপুকুরপাড়ে। দিনমজুরি ও গাছ গাছড়ার শেকড় বিক্রি করে কোনওক্রমে দিন গুজরান করত ওই পরিবারগুলি। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর কোনও বালাই ছিল না। ২০০৬ সালে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক শিক্ষা কেন্দ্রের উদ্যোগে ওই এলাকায় শিক্ষার আলো পৌঁছয়। বারো জন পড়ুয়াকে নিয়ে শুরু হয় শিক্ষাকেন্দ্র। সংখ্যাটা এখন দাঁড়িয়েছে ৫৬। পড়ুয়ারা শিক্ষাকেন্দ্রে আসছে। শিখছে নাচ, গান ও আবৃত্তি। ব্যবস্থা রয়েছে কম্পিউটার শেখারও। শিক্ষিকা অর্পনা রায়চৌধুরী বলেন, “স্কুলে যা পড়ানো হয়, এখানে তা শিখিয়ে দেওয়া হয়। গান-কবিতাও শেখানো হয়। পড়ুয়ারা শেখে মনের আনন্দে।”
ছেলেমেয়েরা শিক্ষার আলোতে আসায় খুশি অভিভাবকরা। স্থানীয় বাসিন্দা বাসন্তী মান্ডি বলেন, “স্বপ্নেও ভাবিনি আমাদের ঘরের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখবে। বড় হবে। লোকশিক্ষা কেন্দ্রের উদ্যোগে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করেছে। আমার দুই ছেলের মধ্যে একজন সপ্তম শ্রেণিতে ও অন্যজন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে।”
|
চাকদহের নতুনপুকুরে সেই বিদ্যালয়। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য। |
কীভাবে সম্ভব হল এই উদ্যোগ? চাকদহ পুরসভার মাধ্যমে লোধাপাড়ার অশিক্ষার কথা জানতে পারেন লোকশিক্ষা কেন্দ্রের সুপারভাইজার মলয় ভট্টাচার্য। শুনেই মলয়বাবু মনে মনে ঠিক করে নেন দিন আনা দিন খাওয়া লোধা পরিবারের বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখাতে হবে। তিনি বলেন, “ছ’মাস ধরে লোধাদের সম্পর্কে নানারকম তথ্য সংগ্রহ করা হয়। পরিবারগুলির সঙ্গে একাত্ম হয়ে বোঝার চেষ্টা করি তাঁদের মনের কথা। লেখাপড়ার কথা বলতেই ওরা প্রস্তাবটা লুফে নেন। তারপর গড়া হয় শিক্ষাকেন্দ্র। আমার ধারণা, আগামীতে অনেক পড়ুয়াই মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোবে।”
শিক্ষার আঙিনায় আসা ওই ছাত্র-ছাত্রীরা সকলেই প্রথম প্রজন্মের। চোদ্দ পুরুষের মধ্যে তারাই প্রথম স্কুলের চৌকাঠে পা দিয়েছে। লেখাপড়ার সুযোগ পেয়ে বেজায় খুশি খুদে পড়ুয়ারা। সপ্তম শ্রেণির সুখলাল মান্ডি, রাজা মান্ডিরা হাসতে হাসতে বলে, “আমরা স্কুলে যাই। পড়াশুনা করি। স্কুলে যেতে বেশ ভালোই লাগে। স্যার ও দিদিমনিরা আমাদের খুব স্নেহ করেন।” বছর বারো হতে না হতেই একই সময় লোধা পরিবারের মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাওয়াই ছিল দস্তুর। এখন পাল্টেছে সে রীতি। সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী শুকুলি মল্লিক বলেন, “দিদির অনেক ছোটবেলায় বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আমি তা করব না। পড়াশুনা করব। জীবনে বড় হতে চাই।”
কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই কর্মসূচির প্রোগাম কো-অর্ডিনেটর নিলাদ্রীশেখর বিশ্বাস বলেন, “পিছিয়ে পড়া লোধাপাড়ার সার্বিক উন্নয়নের কাজে হাত লাগানো হয়েছে। স্কুল গড়া হয়েছে। বয়স্ক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রোগাক্রান্তদের চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা হয়। বাল্য বিবাহের ক্ষতিকর দিকগুলি সম্পর্কে অবহিত করতে এলাকায় প্রচার চালানো হয়।”
সত্যিই পরিবর্তনের জোয়ারে ভাসছে লোধাপাড়া। |