মনোরঞ্জন...
এক তুলসী চক্রবর্তী তিন উত্তমকুমার
সিনেমা মহলের সব চেয়ে প্রাণ জুড়োনো খবর হল, তরুণ মজুমদার একটা বড় কাজ শেষ করলেন।
হলে বসে দেখার ছবি নয়, ঘরে বসে টিভির পরদায়। বড় বলছি, কারণ ছবিটা ধারাবাহিক। ধারণা ছিল, দু’আড়াই শো’ এপিসোডে ধরা।
তরুণবাবু সংশোধন করে দিয়ে বললেন, “পুরো কাজটা বাহান্ন থেকে ষাট এপিসোডে দেখানো যাবে। প্রতি এপিসোড এক ঘণ্টা করে।”
কাজটা বড় আরেক ভাবে। কারণ, বিষয় বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’।
বাইশ পরিচ্ছেদে বলা কাহিনির পরিচ্ছেদগুলো মাঝে মাঝেই বেশ ছোটও, কিন্তু তরুণবাবুর মনে হয়েছে যে, তার একেকটি যেন সিনেমার সিকোয়েন্স। এতটাই ‘ফোকাসড’, এত মসৃণ ভাবে এগিয়ে নিয়ে যায় গল্পকে।
জানতে চাইলাম, “এত দিন পর ছোট পরদায় এলেন কেন?’
ফের সংশোধন করে দিয়ে বললেন, “এত দিন পর নয়। মাঝখানে আমি ‘চিরকুমার সভা’ করেছিলাম ছোট পরদার জন্য। পরেও হয়েছে ‘চিরকুমার সভা’ টিভিতে, তবে আমারটাই প্রথম। আর কী জানেন, আমি কিন্তু ছোট পরদা, বড় পরদা বলে ব্যাপারটা দেখি না। ছবি নিয়ে আমার যে ভাবনাচিন্তাগুলো আছে, তা আমি দর্শকের সঙ্গে শেয়ার করে নিতে চাই। যাই করি, ফিচার ফিল্ম কী টিভি সিরিয়াল এটাই কিন্তু মূল কথা। যা বলতে চাইছি, তা দর্শকের কাছে পৌঁছে দিতে পারছি কিনা, পরদার আকার যা-ই হোক। আমার সমস্যা সেটাই।”
বললাম, “পুরো ছবিটাই তো আপনি তুলে ফেলেছেন। এপিসোড করে করেও তো তুলতে পারতেন।” তরুণবাবু বললেন, “বলতে পারেন, দুটো কারণ। এক হচ্ছে, আমি ফিল্ম করি তো। ফিল্মে শ্যুটিংকরার ধরনটা হচ্ছে এই রকম। একটা সেট তৈরি করলাম, সেই সেটে পুরো চিত্রনাট্যের যা কিছু ঘটছে তা পর পর শু্যট করে অন্য সেটে চলে গেলাম। এতেই আমি অভ্যস্ত।”
“আর দ্বিতীয় কারণটা হল টেলি সিরিয়াল তোলার যে-ধারা এখানে... অর্থাৎ এক দিকে নতুন এপিসোড তোলা হচ্ছে, অন্য দিকে ছবি দেখানো শুরু হয়ে যাচ্ছে... তাতে নির্মাতার উপর একটা চাপ সৃষ্টি হয়, যে-করেই হোক কাজ তুলে দিতে হবে। আমি ওই চাপের মধ্যে নিজেকে ফেলতে চাইনি। “কী করে ‘দুর্গেশনন্দিনী’ করায় এলাম তারও একটা কাহিনি আছে। হায়দরাবাদ থেকে অফার এসেছিল বঙ্কিমের ছ’টা কাহিনি করার ওদের ‘চিরন্তনী’ সিরিজে। তার মধ্যে ‘দুর্গেশনন্দিনী’ও ছিল। আমি যে প্রথম কাজ হিসেবে এটিকে বাছলাম, তা এ জন্য নয় যে ‘দুর্গেশনন্দিনী’ বাংলা ভাষার প্রথম সার্থক উপন্যাস এবং বঙ্কিমেরও প্রথম। বাছলাম কারণ আঙ্গিকের দিক থেকে এবং বিষয়বস্তুর দিক থেকেও এর মধ্যে অনেক চিত্তাকর্ষক ক্ষেত্র পেলাম। যা আমার কাছে অসম্ভব ইন্টারেস্টিং।
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।
“বঙ্কিমের উপন্যাস ছবিতে ধরতে গিয়ে যদি তার বর্ণনার অংশগুলো বাদ দিই, তো দেখব যে এর বৃত্তান্ত এত ছোট, পরিমিত এবং টু দ্য পয়েন্ট যে আমি সঙ্গে সঙ্গে একটা ছবি দেখতে পাই। এতটাই সিনেম্যাটিক।
“একটা উদাহরণ দিই। যেখানে এক রাতে বিমলা লুকিয়ে জগৎ সিংহকে মন্দারণ প্রাসাদে নিয়ে আসছে তিলোত্তমার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়ার জন্য, ওকে এনে পাশের ঘরে অপেক্ষা করিয়ে রেখেছে, কিন্তু বলছে না ওকে এই কারণেই নিয়ে এসেছে। তার পর ‘একটা কাজ সেরে আসছি’ বলে চলেও গেছে।
“জগৎ সিংহ ভাবছেন, কী হল? যখন ভাবনায় পড়েছেন জগৎ সিংহ থাকবেন কি থাকবেন না, তখনই সংলগ্ন কক্ষের দরজা খুলে গেল। জগৎ সিংহ দেখলেন বিমলা দাঁড়িয়ে আছে। জগৎ সিংহ কাছে গেলেন, সামনে বিমলা দাঁড়িয়ে, পিছনে কী আছে, বোঝা যাচ্ছে না। বিমলা বললে, একেবারেই চলে যাবে? বলেই চট করে পাশে সরে গেল। সরে যেতেই জগৎ সিংহের সামনে কী আছে সেটা ধরা পড়ল। সামনে আরেকটা ঘর। বঙ্কিমের ভাষায় ‘যুবরাজ দেখিলেন সুবাসিত কক্ষ, রজৎপ্রদীপ জ্বলিতেছে, কক্ষপ্রান্তে অবগুণ্ঠনবতী রমণী সে তিলোত্তমা।’ আমার তো মনে হয় এ একদম ছবি।”
বললাম, “আপনার বলা দৃশ্যের প্রসঙ্গে মনে পড়ছে দেবমন্দিরের সেই দৃশ্যও, যেখানে অন্ধকারে লুকিয়ে আছে মেয়েরা। জগৎ সিংহ এসে দরজায় করাঘাত করলেন। ভয়ে কেউই উত্তর করল না। অনেক পরে নারীকণ্ঠে ‘আপনি কে?’ একটা উপন্যাসের শুরু হিসেবেও এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য কী হতে পারে?”
তরুণবাবু সোৎসাহে বললেন, “মনে হয় না একেবারে সিনেমার জন্য তৈরি করে রাখা? কিংবা সিনেমার থেকে উঠে আসা? বলার এত সুন্দর ঢং এবং বাঁধুনি। যাকে বলে প্রিসাইজ আঙ্গিকের দিক থেকে এটাই আমাকে টেনেছে। আর বিষয়বস্তুর দিক থেকে যদি বলেন তা হলে বলি...
“‘দুর্গেশনন্দিনী’ কাহিনি বিন্যাসে বঙ্কিম একেক জায়গায় কিছু কিছু ফাঁক রেখে গেছেন। সাহিত্য হিসেবে উতরে গেছে লেখার গুণে, কিন্তু একটু তলিয়ে ভেবে দেখুন। যেমন ওসমানের সৈন্যদলের হাতে আক্রান্ত জগৎ সিংহ আয়েষার শোবার ঘরে। এক রাজপুত যুবরাজ কী করে এক পাঠান রমণীর ঘরে আশ্রয় পাচ্ছেন তা নিয়ে বঙ্কিমের কিন্তু কোনও উচ্চবাচ্য নেই। একটি দৃশ্যের পর তিনি চলে যাচ্ছেন পরের দৃশ্যে, মাঝখানে সম্পূর্ণ নীরব থেকে। আমাকে কিন্তু ছবিতে এই শূন্যস্থানগুলো পূর্ণ করার চেষ্টা করতে হয়েছে। উপন্যাসের চিত্রায়ণ একটা চ্যালেঞ্জের মতো। দেখবেন, এ রকম কোনও কোনও পরিস্থিতিতে আমাকে কাহিনির লজিক তৈরি করে নিতে হয়েছে। যা দাঁড়িয়ে গেছে চিত্রনাট্য ও সিনেমার লজিকেও। আজ থেকে পাঁচশো বছর আগেকার এক ঘটনায়, আয়েষার জগৎ সিংহের প্রেমে পড়ায়, হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের একটা ছবি যুক্তি দিয়ে গড়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছি আমি।”
“দুর্গেশনন্দিনী-কে খুব রোম্যান্টিক করে তুলে দেখানোর চেষ্টা করেছেন তরুণ মজুমদার?” প্রশ্নটা শুনে প্রথমে একটু ইতস্তত করছিলেন পরিচালক। তার পর কিছুটা বিনয় করেই বললেন, “দেখুন, অত বড় বড় কথা বলার যোগ্যই হয়তো আমি নই। তবে কী, উপন্যাসটা তো চতুষ্কোণ প্রেমের একটা উপাখ্যান এ ওকে চায়, সে তাকে চায় এ একে ভালবাসে, সেও একে ভালবাসে, এ ভাবে জিনিসটা ক্রমশ জটিল হতে থাকে, কিছুটা নিয়ম বহির্ভূতও তো বটে। না হলে একটা মুসলিম মেয়ের এক হিন্দু ছেলের প্রেমে পড়া... মনস্তত্ত্বের বন্ধনগুলো খুলে খুলে দেখানোর মধ্যে তো একটা চাওয়া-পাওয়ার রোম্যান্টিসিজম আসেই।”

চাওয়াপাওয়া
‘দুর্গেশনন্দিনী’ প্রসঙ্গ থেকে অতি অনায়াসে যে-ছবির কথায় চলে গেলাম তা তরুণবাবুর প্রথম কাজ উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত ‘চাওয়া পাওয়া’।
বললাম, “এই ‘দুর্গেশনন্দিনী’ ছবি করা কি এক অর্থে আপনার ছবির জীবনের গোড়ায় চলে যাওয়া? যখন আপনি ‘যাত্রিক’ গোষ্ঠীর একজন হয়ে খুব সুন্দর একটা ছবি করেছিলেন ‘চাওয়াপাওয়া’? সেখানেও তো বিষয় প্রেম, একটা পালিয়ে যাওয়া, বেশ একটা সাসপেন্স, তার পর ঘুরেফিরে আসা নারী-পুরুষের...
তরুণবাবু বললেন, “দেখুন ‘চাওয়া পাওয়া’-তে সিচ্যুয়েশনটা এক রকম ছিল, এখানে আরেক রকম। কিন্তু যে-মনটা এই দুই ছবি করেছে সেটা তো এক।
ছবি: সমর দাস।
“এর মধ্যে অনেক সময় কেটে গেছে, ভালবাসা দেখানোর রীতিরও বিবর্তন ঘটে গেছে, আমার কিন্তু বরাবরই ভালবাসা ফুটিয়ে তোলার ধারাটা সহজ, সরল ও স্বচ্ছ রাখার চেষ্টা থেকেছে। ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’ এই কথাগুলো ঠিক এই ভাষায় না হলেও সিনেমার ফর্মে খুব সহজ করে বুঝিয়ে দেওয়ার পথে থেকেছি বরাবর। ভালবাসার জটিলতাগুলোও সহজ করে দেখানোর রাস্তা নিয়েছি। ধরুন, ‘বালিকা বধূ’ ছবিটার কথাই। কেউ যদিও বলেনি সেখানে ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’। কিন্তু অন্য একটা প্রসঙ্গ এনে কথাটা কিন্তু বলে দেওয়া গেছে। বলি...
“‘বালিকা বধূ’ মাঝে মাঝে বাপের বাড়ি যায়। তাতে ওর বর কষ্ট পায়। বা রজনী এসেছে বাপের বাড়ি থেকে, তখন ছেলেটির বোন ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করে, ‘অ্যাই রান্নাবান্না জানিস?’ মেয়েটি বলে, ‘জানি। ভাত ডাল মাছ....।’ বোন জিজ্ঞেস করে, ‘মোচার ঘণ্ট? শিখে নিবি, দাদা খুব ভালবাসে....।’
“এই ভাবেই চলে। বাপের বাড়ি যায়, ফিরে আসে, যায়, ফের আসে...এ ভাবেই যেতে-আসতে, যেতে-আসতে এক সময় তার মনেও একটা পরিবর্তন এসে গেছে। শেষে একদিন স্বামীকে ও বলে, ‘আমার খুব ইচ্ছে করে এরকম জোছনার রাতে বাইরে গিয়ে দৌড়োই।’ তা শুনে বর বলে, ‘তা হলে চলো দৌড়ই।’ ওরা তার পর চাঁদনি রাতে দৌড়তে থাকে, তার পর দৌড়তে দৌড়তে এক সময় হাঁপিয়ে বসে পড়ে এক জায়গায়। কিছুক্ষণ পর মেয়েটি বলে, ‘তোমায় একটা কথা বলব?’ বর জিজ্ঞেস করে, ‘কী?’ মেয়েটা বলে, ‘আমি ...’ কথাটা শুরু করেই বরের দিক থেকে চোখ নামিয়ে নেয়। এটুকুতে যা বলার সেটা বলে দেওয়া হয় যেন। অর্থাৎ, তুমি যে-ভাবে আমাকে চেয়েছ সে-ভাবেই নিজেকে তৈরি করেছি।’ ভালবাসা বোঝাতে আর কী চাই বলুন?” তরুণবাবু যখন এই দৃশ্য বর্ণনা করছেন আমি মনে মনে তখন আরেকটি চাঁদনি রাতের দৃশ্য পাশাপাশি দেখছি। চাঁদের আলোয় ছাদে দাঁড়িয়ে উত্তম শোনাচ্ছেন সুচিত্রাকে, ‘যদি ভাবো এ তো খেলা নয়, ভুল সে তো শুরুতেই।’ কণ্ঠ হেমন্ত, ছবি ‘চাওয়া-পাওয়া’।
এই সময় একটা ভাবনাও এল তরুণবাবুর তোলা একাধিক প্রেমের ছবির একটা প্রধান লক্ষণ নিয়ে। প্রেমের নিষ্পাপ মাধুর্য।
সে শুরুর ছবি ‘চাওয়া-পাওয়া’ হোক, ‘বালিকা বধূ’ তো বটেই, পাশাপাশি ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘ফুলেশ্বরী’, এমনকী ‘পলাতক’। কথাটা বলতে তরুণবাবু যোগ করলেন ‘দাদার কীর্তি’, ‘ভালবাসা ভালবাসা’। তার পর বলে চললেন, “নিষ্পাপতাই তো প্রেম। কামনা-বাসনা তো পরে আসে। ‘দুর্গেশনন্দিনী’-তেও তো এই নিষ্পাপতার ছবি আমরা পাচ্ছি।”
কাজেই জিজ্ঞেস করতেই হল,“এখনকার বাংলা ছবিতে প্রেমের ট্রিটমেন্ট আপনার কেমন ঠেকে?”
তরুণবাবু প্রথমে একটু চুপ করে রইলেন, তার পর বললেন, “দেখুন, আজকে যারা ছবি করছে তারা বয়সে সবাই আমার থেকে অনেক ছোট। তাদের কাজ নিয়ে মন্তব্য আমি কখনও করতে চাই না। করাটা উচিত হয় না।
“তবে যেহেতু প্রেমের ট্রিটমেন্টের কথাটা তুলছেন, তাই ও দিক থেকে আমার ভাবনাটা শোনাতে পারি। তা হল এখনকার ছবিতে প্রেমের রূপায়ণে অনাবশ্যক জটিলতা দেখি। যেন সরল কথাকে এঁকেবেঁকে জটিল করে বলা। যেখানে সিনেমার মতো মাধ্যম বরং দাবি করে জটিলতাকেও সরল, স্বচ্ছ করে বলা। আর এই সহজ হওয়াটা কিন্তু ততটা সহজ কাজ নয়।
ঋতুপর্ণ নিয়ে প্রতিক্রিয়া
বেশ মিশ্র। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে
নিয়ে ওই তথ্যচিত্র
কী হয়েছে ওটা?
অনীক দত্তর ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’
ইন্টারেস্টিং। তবে ছবির
স্টাইলটা যত ইন্টারেস্টিং,
কনটেন্টের দিকটায় তত কিছু নেই।
“সিনেমায় সমস্ত সহজ হওয়ার পিছনে কত যে জটিলতা পেরিয়ে আসা থাকে, তা ছবি করতে নামলে হাতেনাতে প্রমাণ পাওয়া যায়। কোনও পরিচালক যদি প্রেমের জটিলতাকে ছবিতে ধরবেন বলে মনস্থ করেন, তাঁকে সেই জটিলতাকে সরলতায় ট্রান্সলেট করারও রাস্তা বের করতে হবে। তাতে সাধারণ দর্শকও খুব সহজে সেই জটিলতার মধ্যে পৌঁছে যেতে পারবেন; আর এ শুধু প্রেম বিষয়েই নয়, গোটা চলচ্চিত্র মাধ্যমটাতে এই স্বচ্ছ চলনটা ধরে রাখার প্রয়োজন। “যা দেখছি, বিনা বিচারে সে ভাবেই দেখালে একটা তাৎক্ষণিক মজা হয়তো আসে, যা কালে কালে হারিয়েও যায়। আধুনিকতা মানেই জটিলতা নয়, জটিলতাতেও পৌঁছতে হবে একটা সরলতার মাধ্যমে। যেমনটি দেখেছি আমরা ‘চারুলতা’-য়। শেষ দৃশ্যে দু’টো হাত যখন কাছাকাছি এসেও মিলতে পারছে না, তখন তো দর্শককে বলে দিতে হচ্ছে না ‘এর মানে কিন্তু এই’। সিনেমার ভাষা কিন্তু তার নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছে।”

সরল ও বক্র
এখন একটা কথা মাঝে মাঝেই ব্যবহার করা হয় লিনিয়ার ন্যারেটিভ। সরলরৈখিক কথন। যে ধরনের মধ্যে তরুণবাবু ও ওঁর সময়কার তাবড় চিত্রনির্মাতাদের ফেলা হয়। আর নতুন চলচ্চিত্র কথনপ্রণালী হতে হবে বক্র, চক্র ইত্যাদি ইত্যাদি। কী ভাবে নেন তরুণবাবু এই সব বর্গীকরণ?
জানতে চাইলাম, “গত দশ বা পনেরো বছরে কোন ছবি দেখে মনে হয়েছে তাতে কিছু পাচ্ছেন?”
তরুণবাবু ফের চুপ রইলেন কিছুক্ষণ, যেন ছবির নাম হাতড়াচ্ছেন। তার পর বললেন, “ভাবতে হবে। ওঁকে সাহায্য করার জন্য কয়েকটা নাম ধরে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। প্রথমেই নাম করলাম ‘শব্দ’। তরুণবাবু বললেন, “ছবিটা দেখা হয়নি। তবে অনেক প্রশংসা শুনেছি।”
কিংবা ‘C/O স্যর’। বললেন, “না, ওটাও দেখা হয়নি এই সিরিয়ালের এডিটিংয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকায়।”
তা হলে অনীকের ছবি ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’? তরুণবাবু বললেন, “ইন্টারেস্টিং। ওটা সম্পর্কে যেটা বলার আছে তা হল ছবির স্টাইলটা যত ইন্টারেস্টিং, কনটেন্টের দিকটায় তত কিছু নেই। তবে ভদ্রলোকের প্রশংসা করব। ওঁর কাজ দেখে মনে হয়েছে উনি হাতে সে রকম জিনিস পেলে কৃতিত্বের সঙ্গে বার করে দেবেন।” জিজ্ঞেস করলাম, “গৌতমের (ঘোষ) কী ছবি ভাল লেগেছে গত দশ-পনেরো বছরে?” বললেন, “সত্যি কথা বলতে ওর ছবির অনেক গুণ আছে। তবে শেষ অবধি যেন মনে হয় অনেক কিছু থাকা সত্ত্বেও কিছু যেন নেই। এত কিছু, তবু কী যেন নেই।”
“তা হলে আজকের দিনে তেমন কি কেউ আছে যার ছবির অপেক্ষায় থাকেন আপনি?” জিজ্ঞেস করলাম।
বললেন, “একটা সময় পর্যন্ত অপর্ণার ছবি। ওই যে ছবিটা করল ঋতুপর্ণাকে নিয়ে। মা ও মেয়ের বিষয় নিয়ে। ওর পরের ছবিগুলো যেন একটু আনইভেন লেগেছে। ঋতুুপর্ণ (ঘোষ) সম্পর্কে আমার প্রতিক্রিয়া বেশ মিশ্র। সম্প্রতি চলে গেছে বেচারা, সমালোচনা করতে খারাপই লাগছে। সর্বশেষ কাজ যেটা দেখলাম ওর রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তথ্যচিত্র কী হয়েছে ওটা? ঋতুপর্ণ রবীন্দ্রনাথকে দেখছে, না রবীন্দ্রনাথ ঋতুপর্ণকে দেখছেন? কেন, কী জন্য? আমার তো মনে হয়েছে ছবিটা নার্সিসাস কমপ্লেক্স ও মেগালোম্যানিয়ার সংমিশ্রণ। আত্মপ্রেম ও আত্মসর্বস্বতার যজ্ঞ।”
নতুন পরিচালকদের সম্পর্কে কী অভিমত? বললেন, “আমার সব শুভেচ্ছা ওদের জন্য। আমি চাই ওরা ছবি করে আমায় চমকে দিক।”
বললাম, “তা হলে বলুন আপনার প্রিয় পাঁচজন বাঙালি পরিচালক কারা? ইন অর্ডার অব প্রেফারেন্স?”
তরুণবাবু শোনালেন, “পছন্দ অনুসারে এক, দুই, তিন করে বললে প্রথমেই সত্যজিৎ রায়। তার পর দেবকী বসু। তার পর বলব তপন সিংহ। তার পর বলব ঋত্বিক ঘটক। তার পরে বলব অসিত সেন। আর তার পরেও যদি আমাকে আরও দু’টো নাম যোগ করতে দেন তো বলব অজয় কর আর রাজেন তরফদার।”
জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি তো ভাল ছাত্র ছিলেন, পড়াশোনার মধ্যেই ছিলেন। ভাল ছবিটবিও আঁকতেন। তো হঠাৎ ছবি করতে এলেন কেন? তখন তো একে বলত সিনেমার ভূত। আর এখন সেটাই হয়ে গিয়েছে মেনস্ট্রিম।”
  ওঁর পছন্দ  
অভিনেতা
  অভিনেত্রী  
তরুণবাবু বললেন, “আমি যেখানে বড় হয়েছি, সেই ছোট্ট শহর এখন বাংলাদেশে পড়ে গেছে। সেখানে দু’টো শো হাউস ছিল সিনেমা দেখানোর। তো সেখানে ইংরেজি ছবি এলে আসত চার্লি চ্যাপলিন কি বাস্টর কিটনের ছবি। বাংলা হলে নিউ থিয়েটার্সের ছবি আসত, আর হিন্দি হলে বম্বে টকিজের। আমার বাবা যেহেতু স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন, তাই তাঁর বেশির ভাগ সময়টাই জেলে জেলে কাটত। ছবি দেখার পয়সা যদি জোগাড় করতে পারতাম, তা হলে ছবি দেখার কোনও নিষেধ ছিল না।”
“সেই সময় থেকেই একটা ব্যাপার ঘটতে শুরু করেছিল আমার মধ্যে। ওই অন্ধকার হলে বসে ছবি দেখতে দেখতে ভাবা ধরেছিলাম পাত্রপাত্রীর এ যদি এ রকম হত, এ রকম করত, আর কাহিনি যদি এ ভাবে গড়াত...এই সব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ খেয়াল করতাম ছবি অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। তার পর বাড়ি ফিরে এসেও টের পেতাম সিনেমার ওই আলো-আঁধারি মাথার মধ্যে জেঁকে বসে আছে। ভাবতাম ক্লোজ-আপ-এর কী অসীম ক্ষমতা! মানুষের মুখ অত কাছে টেনে এনে কত কিছু বলে দিচ্ছে কথা না বলেও।
“ওই যে তাড়া করা শুরু করল সিনেমা, সেটাই চলল বয়সকালে। তার পর তো কলকাতা চলে এলাম, দেশভাগ হব-হব করছে, দাঙ্গা দেখলাম, কলেজে ভর্তি হলাম, কিন্তু সিনেমা তখনও আমায় টানছে। মেট্রো, লাইটহাউসে ছবি দেখা শুরু হল। সময়টা হলিউডের গোল্ডেন ডেজ। সিনেমা বোঝার জন্য হাতের কাছে বই আর কী? ওই পল রোঠার একটা বই।
“এর পর একদিন আবিষ্কার করলাম মেট্রোর পাশের গলিতে একজন মাটিতে ফেলে বিক্রি করেন মেট্রোতে দেখানো সব ছবির চিত্রনাট্য। এগুলো আসত এ দেশে ওই সব ছবির সেন্সরিংয়ের জন্য। পরে ওজন করে ও সব বিক্রি হত।
“ওই সব স্ক্রিপ্ট কিনে ছবির পড়াশোনা শুরু হল। সিনেমার ভূত বলা হচ্ছে যাকে তা মগজে এমনই চেপে বসেছে এক সময় যে কানন দেবীর বাড়িতে ওঁদের ফিল্ম প্রোডাকশনের কাজ করার জন্য রোজ যাওয়া শুরু হল। শুধু কাজ শেখার নেশাতেই যাওয়া দিনের পর দিন।
“সে এক দীর্ঘ কাহিনি। তার পর তো এক সময় তিন বন্ধু মিলে যাত্রিক গোষ্ঠী করে ছবিই শুরু করলাম ‘চাওয়া পাওয়া’। এর পিছনেও একটা কাহিনি আছে উত্তমকুমারকে নিয়ে। তখন কাননদেবীর প্রোডাকশনে ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ হচ্ছে। আমার উপর দায়িত্ব পড়েছিল উত্তমবাবুকে নিয়ে রাজগির যাওয়ার। “সেখানে গরমের মধ্যে শ্যুটিংশেষ করে ফিরছি, দেখি সারি দিয়ে গরুর গাড়ি যাচ্ছে। তাদের পিছন থেকে সূর্যের আলো ঠিকরোচ্ছে। দৃশ্যটা দেখে বলে ফেলেছিলাম দিলীপ মুখোপাধ্যায়কে, যিনি পরে যাত্রিকের একজন হয়েছিলেন, ‘ইস্, এই দৃশ্যটা যদি তোলা যেত!’ পিছনে থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এল, ‘নিজে ছবি করেন না কেন?’ ঘুরে দেখি উত্তমকুমার।
“শুধু এটুকু বলেই থেমে যাননি উত্তমবাবু। সে রাতে ফের বললেন, ‘যদি ছবি করেন এবং আমাকে প্রয়োজন হয় নির্দ্বিধায় বলবেন। আমি করব। ওদিকে মিস সেনও প্রায় একই কথা বলেছিলেন দিলীপবাবুকে। এ দুজনকে পেয়ে যেতে ‘চাওয়া-পাওয়া’ দাঁড় করাতে অসুবিধে হয়নি।”
মহানায়কের প্রসঙ্গে অবধারিত ভাবে অভিনয়ের প্রসঙ্গ এসে গেল। বললাম, “আপনার বিবেচনায় বাংলায় সেরা পাঁচ অভিনেতা কে কে হবেন?”
তরুণবাবু উত্তর করলেন, “আমার কাছে এক নম্বরে তুলসীদা (চক্রবর্তী)। ছবিদাকে (বিশ্বাস) তার পর। নিশ্চিত রাখব উত্তমবাবুকে। সৌমিত্রবাবুকে রাখব। হয়তো রাখব রবিকে (ঘোষ)।”
আর প্রিয় নায়িকাদের একটা তালিকা করতে যদি বলা হয়?” জিজ্ঞেস করতে বললেন, “এক নম্বরে রাখব মাধবীকে। তার পর সাবিত্রী। তার পর কাবেরী (বসু)। মিসেস সেন (সুচিত্রা)। সন্ধ্যা (রায়)।”
‘চাওয়া-পাওয়া’ করে যাঁর জীবনের কাজ শুরু, সিনেমা বা জীবন থেকে যত যাই পেয়ে থাকুন, তাঁর চাওয়া কিন্তু কোনও দিনই খুব বেশি ছিল না। তবে মনের কোণে ছোট্ট একটু দুঃখ হয়তো থেকে গেছে, যেটা তাঁর অগণিত বাঙালি ভক্তের কাছে একটা বড় দুঃখ। তাঁর ‘বালিকা বধূ’ বার্লিন, মানহাইম, লোকার্নো, মন্ট্রেয়েল ইত্যাদি চলচ্চিত্রোৎসবে আমন্ত্রিত ছবি হলেও তিনি যোগ দিতে যেতে পারেননি ছবি নিয়ে। কারণ? বিদেশযাত্রার জন্য ভারত সরকারের তখন বিদেশি মুদ্রার অনুমোদন ছিল মাথা পিছু পাঁচ ডলার মাত্র! বললেন, “ওই ক’টা টাকা নিয়ে কী করে যাই বলুন?”
উঠে আসার আগে হঠাৎ মনে এল যে, তরুণবাবু নতুন একটা ছবিতে হাত লাগাচ্ছেন বলে খবর আছে। জিজ্ঞেস না করে পারলাম না, “শোনা যাচ্ছে আপনি নাকি ঋতুপর্ণাকে নিয়ে ছবি করছেন?” তরুণবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “খবরটা কোথায় পেলেন?”
বললাম, “খবরের কাগজে খবর এসে যায়।” তরুণবাবু বললেন, “আর কী শুনেছেন?”
বললাম, “শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস ‘জনপদবধূ’ নিয়ে ছবি।”
তরুণবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “হুঁ, ঠিকই শুনেছেন। আর কী?” “শুনেছি, ঋতু নায়িকা, ছবি নিয়ে ওঁর সঙ্গে অনেকটাই কথাবার্তা গড়িয়েছে।” তরুণবাবু বললেন, “এও সত্যি। ছবির ব্যাপারস্যাপার নিয়ে বসছি ওর সঙ্গে। আশা করছি, খুব শিগগিরই কাজটা শুরু করা যাবে।” আমি বললাম, “অনেক শুভেচ্ছা রইল।”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.